images

রাজনীতি

ডাকসু ও জাকসুতে বিপর্যয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে এনসিপি?

ঢাকা মেইল ডেস্ক

১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০১:২২ পিএম

ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ফলাফলে ভরাডুবি হয়েছে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ বা বাগছাসের। এক বছর আগে যে তরুণদের নেতৃত্বে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে, মাত্র এক বছরের ব্যবধানে সেই নেতৃত্বের একটা বড় অংশ কেন এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হলো সেই প্রশ্নও সামনে আসছে। শুধু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সংগঠনই নয়, চরম ভরাডুবি হয়েছে ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন কিংবা বাম ছাত্রসংগঠনগুলোর প্রার্থীদেরও।

গত বছর আগস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই দেশের বিভিন্ন ক্যাম্পাসে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবিতে সবচেয়ে বেশি সরব ছিলেন বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী ও গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীরা। যে কারণে অনেকের মধ্যে ধারণাও তৈরি হয়েছিল, বৈষ্যমবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বা বাগছাস প্যানেলের প্রার্থীরাই এই ডাকসু-জাকসুসহ বিভিন্ন ছাত্র সংসদে ভালো ফলাফল পেতে পারে। এবং এই নির্বাচনে জয়ের ফলাফল ঘরে তুলবে ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি। কিন্তু এমন ভরাডুবির পর বিষয়টি নতুন করে ভাবাচ্ছে এনসিপিকে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সদস্য সচিব ও বর্তমানে এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব আরিফ সোহেল বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, যদি বাগছাস এই ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগরে ভালো ফল করতে পারতো তার ইতিবাচক প্রভাব এনসিপির রাজনীতিতেও পড়তো। তবে তারা এটিও মনে করছেন যে, গণঅভ্যুত্থানের পর বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের কিছু কিছু কর্মকাণ্ডের নেতিবাচক প্রভাব ছাত্র সংসদ নির্বাচনে পড়েছে। যে কারণে হতাশাজনক ফলাফল এসেছে ডাকসু কিংবা জাকসুতে।

অন্যদিকে, সারাদেশে বিএনপি নেতাকর্মীদের সন্ত্রাস-চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের প্রভাব এই নির্বাচনে পড়েছে বলেও মনে করছেন বিশ্লেষকরা। আর নির্বাচনের ফলকে প্রত্যাখ্যান না করলেও বাম সংগঠনগুলো এমন ফলাফলকে একেবারেই স্বাভাবিকভাবে দেখছেন না। যে কারণে তারা এই কারণগুলো মূল্যায়নের কথাও জানিয়েছে।

Jaksu
জাকসুতেও ভূমিধস বিজয় পেয়েছে ছাত্রশিবির। ছবি: সংগৃহীত

বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন, দলীয় লেজুরবৃত্তিক ছাত্র রাজনীতির কারণে ছাত্রদল এবং 'কিংস পার্টি' হিসেবে এনসিপির পরিচিতি তৈরি হওয়ার বিষয়টি বাগছাসের ফলাফলে প্রভাব ফেলেছে।

বাগছাসের পরাজয়ের কারণ কী?

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন আয়োজনের জন্য সবচেয়ে বেশি সরব ছিল বাগছাস ও বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীরা। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব যারা দিয়েছে, তারা ছাত্র সংসদ নির্বাচনে চমক দেখাতে পারলে এনসিপির রাজনীতিতে ইতিবাচক সাড়া ফেলবে, এমন ধারণা এনসিপি নেতাদের মধ্যে শুরু থেকে ছিল। যে কারণে ক্যাম্পাসগুলোয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবিতে যে সব আন্দোলন হয়েছে, সেখানে নেতৃত্বেও ছিলেন বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীরা।

কিন্তু ডাকসুর নির্বাচনি প্রক্রিয়া শুরুর পর দেখা গেছে, বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী ও এনসিপির কেউ কেউ আলাদা তিনটি প্যানেলে নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। পরবর্তী সময়ে সে বিরোধ মেটানোর চেষ্টা করলেও ডাকসুর কেন্দ্রীয় সংসদের কোনো পদেই জয় পায়নি বাগছাসের নেতৃত্বাধীন প্যানেল।

আরও পড়ুন

এনসিপি আত্মঘাতী পথে ধাবিত হচ্ছে: টিআইবি

অন্যদিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু নির্বাচনে কেন্দ্রীয় সংসদের ছোট দুটি পদে জয় পেয়েছে বাগছাস প্যানেল। এমন ভরাডুবির পর এ নিয়ে অসন্তোষও কাজ করছে দলটির মধ্যে।

ডাকসুতে বিভিন্ন পদে বাগছাস প্যানেলের প্রার্থীদের ভোটও পেয়েছে অনেক কম। প্যানেলগত অবস্থানের দিক থেকেও সেই চতুর্থ কিংবা পঞ্চম।

বড় দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনের এমন ফলাফলের কারণ হিসেবে নিজেদের সাংগঠনিক দুর্বলতা ও কিছু কিছু নেতাকর্মীর নেতিবাচক ইমেজকে দায়ী করছেন এনসিপির নেতারা।

এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব আরিফুল ইসলাম আদীব বিবিসি বাংলাকে বলেন, একেতো প্রস্তুতি নেওয়ার ঘাটতি ছিল। অন্যদিকে বাগছাসের সাংগঠনিক কাঠামোও ছিল দুর্বল। যে কারণে আশানুরূপ ফল পায়নি এনসিপি।

অন্যদিকে গণঅভ্যুত্থানের পর সরকারের উপদেষ্টা থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের নেতিবাচক কর্মকাণ্ড প্রভাব ফেলেছে বলেও মনে করছেন দলটির নেতাদের কেউ কেউ।

এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব আরিফ সোহেল বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘আমাদের কেউ কেউ রাষ্ট্র পরিচালনার খুব কাছাকাছি চলে গিয়েছিল। তাদের অনভিজ্ঞতা, অক্ষমতা কিংবা তাদের নিয়ে মিডিয়া ট্রায়ালও হয়েছে। ফলে একটা বিতর্কিত ইমেজ তৈরি হয়েছে। যার প্রভাব পড়তে পারে এই নির্বাচনে।’

এর বাইরেও দেশের বিভিন্ন স্থানে চাঁদাবাজি কিংবা অন্যান্য নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে এনসিপি নেতাদের কেউ কেউ জড়িয়েছেন। যার কারণে ছাত্রদের এই সংগঠনটির ভোটে প্রভাব পড়েছে বলেও দলটির নেতারা মনে করছেন।

DD
ডাকসুর প্রথম সভা। ছবি: সংগৃহীত

রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলছিলেন, আরও একটি কারণ আছে বাগছাসের এমন পরাজয়ের পেছনে সেটি হলো অনেকেই এনসিপিকে কিংস পার্টি মনে করে। আর শিক্ষার্থীরা সব সময় স্টাবিলিশমেন্টের বিপক্ষে যে কারণে এই প্রভাবও পড়েছে তাদের নির্বাচনে।

ব্যর্থতার কারণ মূল্যায়ন করছে ছাত্রদল

ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনের প্রচার প্রচারণায় ব্যাপক সরব দেখা গেছে বিএনপি ও ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের। কিন্তু ভোটের ফলে গিয়ে দেখা গেছে দুটি বিশ্ববিদ্যালয়েই চরম ভরাডুবি হয়েছে ছাত্রদলের। ডাকসু এবং জাকসুর কেন্দ্রীয় সংসদের কোন পদেই জয় পায়নি ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের প্রার্থীরা। তবে দুটি নির্বাচনেই ভোটের দিন সকাল থেকেই নানা ধরনের অভিযোগের কথা গণমাধ্যমে বলছিলেন ছাত্রদলের প্রার্থীরা।

গত বৃহস্পতিবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচনের দিন বিকেলে অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার অভিযোগ তুলে ভোট বর্জনের ঘোষণাও দেয় ছাত্রদলের প্যানেল।

আরও পড়ুন

এনসিপি’র নামই শোনেননি ৩৭ শতাংশ মানুষ

দেশের বড় দুটি ক্যাম্পাসে এই মুহূর্তে দেশের সর্ব বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপির ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের এমন ভরাডুবি হবে, সেটি আগে থেকে আঁচ করতেই পারেনি বিএনপি।

জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের এমন ফলাফল কেন হলো সেটি আমরা মূল্যায়ন করার চেষ্টা করছি। এর নেপথ্যে কী ছিল সেটিও আমরা মূল্যায়নের প্রচেষ্টা চালাচ্ছি।’

ছাত্রদলের এই শীর্ষ নেতা এটিও বলেছেন যে, শিগগিরই তারা এই মূল্যায়নের কাজ শেষ করে দুর্বলতাগুলোকে কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করবেন।

জাকসু নির্বাচনের ভোট গ্রহণের শেষ দিকে এসে ছাত্রদল নির্বাচন বর্জনের ঘোষণাও দেয়। ছাত্রদল সভাপতি রাকিব বিবিসি বাংলাকে বলেন, তাদের কাছে যে তথ্য আছে তাতে তারা মনে করেন, জাকসু নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম ও কারচুপি হয়েছে। যে কারণে ছাত্রদল সেখানে নির্বাচন বয়কটও করেছে।

Jaksu2
জাকসু নির্বাচন নিয়ে নানা অনিয়মের অভিযোগও আছে। ছবি: সংগৃহীত

ডাকসুর সাবেক জিএস মুশতাক হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর ছাত্রদলের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ এসেছে। ছাত্রদের অনেকে মনে করেছে ছাত্রদলের আচরণ হতে পারে ছাত্রলীগের মতো। আর ছাত্রদল জিতলে সেই পুরনো কায়দার রাজনীতি ফিরতে পারে। সেই আশঙ্কা থেকে হয়তো অনেকে ছাত্রদলকে ভোট দেয়নি।’

এসব অভিযোগকে খারিজ কিংবা গ্রহণ কোনোটিই আপাতত করছে না ছাত্রদল। দলটি পরবর্তী রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচন নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে। এর পাশাপাশি ব্যর্থতার মূল্যায়ন করেই সামনের নির্বাচনগুলোতে জয় পেতে চাচ্ছে বলে জানিয়েছেন ছাত্রদল সভাপতি।

নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন বাম সংগঠনের

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও প্রগতিশীল ও বাম সংগঠনগুলো বিভিন্ন প্যানেলে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। জাকসুতে প্রগতিশীল শিক্ষার্থীদের সম্প্রীতির ঐক্য, ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্র ফ্রন্টের সংশপ্তক পর্ষদ, ছাত্র ফ্রন্টের একাংশ ছোট একটি প্যানেল ঘোষণা করে আলাদা আলাদা ভোটে অংশ নিয়েছিল।

আরও পড়ুন

রাজনীতিতে এনসিপির নীতি-আদর্শ কী হবে, জানালেন নাহিদ ইসলাম

তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভোট বর্জন না করলেও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার অন্তত ঘণ্টাখানেক পরে বাম সংগঠনগুলো নির্বাচন বয়কট করে।

ডাকসু এবং জাকসু নির্বাচনে ভোটের ফলাফল প্রকাশের পর দেখা গেছে, দুটি নির্বাচনেই চরম ভরাডুবি হয়েছে এই বাম সংগঠনগুলোর।

RR_2
ভরাডুবির কারণ খুঁজছে ছাত্রদল। ছবি: সংগৃহীত

সত্তর কিংবা আশির দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে বাম সংগঠনের প্যানেল থেকে অনেক নেতৃত্ব তৈরি হতো। অনেককে ভিপি জিএসসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে জয়লাভও করতে দেখা যেতো। কিন্তু এবার ডাকসু কিংবা জাকসুতে ভোটের ফলাফলে দেখা গেছে বাম সংগঠনগুলোর ফলাফলও ছিল বেশ হতাশাজনক। তবে এই ফলাফলকে স্বাভাবিক মনে করছেন না প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতারা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মাঈন আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, আমরা এই নির্বাচন প্রত্যাখ্যান না করলেও এই দুটি নির্বাচন নিয়েই আমাদের যথেষ্ট সংশয় ও সন্দেহ আছে। এই বিষয়গুলোর উত্তর খুঁজছি আমরা।

আরও পড়ুন

জামায়াতসহ ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে যাচ্ছে না এনসিপি

ছাত্র ইউনিয়নের এই নেতা মনে করছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনিয়ম না হলেও কোনো না কোনো ইঞ্জিনিয়ারিং হয়েছে। আর জাহাঙ্গীরনগরে অনিয়ম বিশৃঙ্খলার বিষয়টিকেই গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন তিনি।

এর বাইরে প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর অনেকেই মনে করছেন, গণঅভ্যুত্থানের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে যে শৃঙ্খলা কমিটি হয়েছে, সেখানে দায়িত্ব পালনে ছিলেন শিবির নেতাদের অনেকেই।

সেই কমিটিকে কাজে লাগিয়ে তারা এই নির্বাচনের ফলাফল ঘরে তুলেছে বলেও মনে করছেন বাম সংগঠনগুলোর নেতারা। এটিকে প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের পরাজয়ের একটি কারণ মনে করছেন তারা। সূত্র: বিবিসি বাংলা

জেবি