images

রাজনীতি

ফের চাপে জাপা, জোরালো হচ্ছে নিষিদ্ধের দাবি

৩০ আগস্ট ২০২৫, ১০:২৩ পিএম

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর চাপে পড়ে তাদের ‘গৃহপালিত’ বিরোধী দলের খেতাব পাওয়া জাতীয় পার্টিও। কারণ, শেখ হাসিনার পাতানো নির্বাচন যখন সব বড় দলগুলো বর্জন করেছে, তখন তারা ভোটে গিয়ে বিরোধী দল হয়েছে এবং কার্যত ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ‘হাতের পুতুল’ হয়ে সংসদে থেকেছে।

ফলে গত বছরের ৫ আগস্টের পর অন্তর্র্বতী সরকার দায়িত্ব নিলে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবির সঙ্গে দলটির দোসর হিসেবে জাতীয় পার্টির নেতাদের বিচারের দাবিও উঠতে শুরু করে। বিক্ষিপ্ত ভাবে ওঠে তাদের নিষিদ্ধের দাবিও। পরে সরকার আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে জাপা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা অনেকটাই স্তিমিত হয়ে যায়। 

Japa1
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে জাপার জিএম কাদের-রওশন এরশাদরা। ফাইল ছবি।

তবে হঠাৎ করে আবারও বিতর্কের কেন্দ্রে সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদের প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টি। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ফের চাপে দলটি। এবারের চাপটা প্রবল, সঙ্গে পতিত আওয়ামী লীগের দোসর হিসেবে জোরেশোরে উঠেছে তাদের নিষিদ্ধের দাবি। রাজনীতির মাঠসহ সামাজিক মাধ্যমেও এ নিয়ে ব্যাপক শোরগোল।

এই দাবি আর আলোচনার মাঝেই শুক্রবার (৩০ আগস্ট) সন্ধ্যায় জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে দলটির নেতাকর্মীদের সঙ্গে গণঅধিকার পরিষদের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ বাধে। অভিযোগ ওঠে, দলবল নিয়ে জাপার কেন্দ্রীয় কার্যালয় দখল করতে গিয়েছিল গণঅধিকার পরিষদ। জাপার নেতাকর্মীরা তা প্রতিহত করতে গেলেই সংঘর্ষ শুরু হয়।

Nur
গুরুতর আহতাবস্থায় ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন নুরুল ইসলাম নুর। ছবি- সংগৃহীত।

এসময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ ও যৌথবাহিনী ব্যাপক লাঠিচার্জ করে। এতে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরসহ প্রায় অর্ধশত নেতাকর্মী আহত হন। এর মধ্যে গুরুতর অবস্থায় নুর বর্তমানে ঢাকা মেডিকেলের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন। তিনি মস্তিষ্কে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন এবং নাকের হাড় ভেঙে গেছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।

সেই ঘটনার রেশ না কাটতেই শনিবার (৩০ আগস্ট) বিকেলে আবারও জাপার কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সংঘর্ষে জড়ায় দলটির নেতাকর্মীরা ও গণঅধিকার পরিষদ। ভাঙচুর করা হয় জাপার কার্যালয়, দেওয়া হয় আগুন। এতে ভেতরে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন জাপার মহাসচিব শামীম হোসেন পাটোয়ারসহ বেশ কয়েকজন নেতা। 

Japa2
সংঘর্ষের জেরে জাপা কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন দলটির মহাসচিব শামীম হোসেন পাটোয়ারী। ছবি- ঢাকা মেইল

এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ এগিয়ে গেলে তাদের সঙ্গে হামলাকারীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও ইটপাটকেল ছোড়ার ঘটনা ঘটে। পরে পুলিশ জলকামান ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে হামলাকারীদের সরিয়ে দেয় এবং অবরুদ্ধ জাপা মহাসচিবসহ নেতাকর্মীদের উদ্ধার করে বাইরে নিয়ে আসে। বর্তমানে সেখানে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে।

যে কারণে জাপা নিষিদ্ধের দাবি জোরালো হচ্ছে

জিএম কাদেরের নেতৃত্বাধীন এই দলটি ‘গণহত্যাকারী’র তকমা পাওয়া আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ। গণঅভ্যুত্থানের আগে চুপচাপ সমর্থন জানালেও গত এক বছর ধরে দলটি দাবি করছে, তারা হাসিনার দুঃশাসনের প্রতিবাদ করেছিল এবং ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছিল।

Kader
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের পক্ষে নন বলে একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিচ্ছেন জাপার চেয়ারম্যান জিএম কাদের। ছবি- সংগৃহীত।

অন্যদিকে আবার জাপার চেয়ারম্যান বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গিয়ে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের প্রতিবাদও করছেন। পাশাপাশি টানা ১৬ বছর রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে না দিলে সেটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে না বলেও মন্তব্য করে চলেছেন প্রতিনিয়ত। এমন দ্বিচারিতার জন্য জাপা নিষিদ্ধের দাবি আগে থেকেই ছিল, নুরের ওপর হামলার পর সেটি আরও জোরালো হয়েছে।

জাপা নিষিদ্ধে ৪৮ ঘণ্টা সময় বেঁধে দিয়েছেন রাশেদ

জিএম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করতে অন্তর্র্বতী সরকারকে ৪৮ ঘণ্টা সময় দিয়েছেন গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান। শনিবার (৩০ আগস্ট) দলের কার্যালয়ের সামনে সংবাদ সম্মেলনে তিনি এই দাবি জানিয়েছেন।

Rashed
জাপাকে নিষিদ্ধের দাবিতে বক্তব্য দিচ্ছেন গণঅধিকারের রাশেদ খান। ছবি- সংগৃহীত।

রাশেদে বলেছেন, ‘শুক্রবারের ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে। নেতাকর্মীদের ওপর হামলার ঘটনায় দায় নিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ করতে হবে। এছাড়া আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করতে হবে।’

জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধের দাবিতে একমত জামায়াতে ইসলামী

জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধের যে দাবি গণঅধিকার পরিষদ তুলেছে, তার সঙ্গে একমত পোষণ করেছে জামায়াতে ইসলামী। শনিবার (৩০ আগস্ট) ঢাকা মেডিকেলে আহত নুরকে দেখতে গিয়ে এ কথা জানান দলটির নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। পাশাপাশি তার দাবি, নুরের ওপর সুপরিকল্পিতভাবে হামলা করা হয়েছে।

taher
জাপা নিষিদ্ধের দাবিতে বক্তব্য দিচ্ছেন জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের, সঙ্গে অন্য নেতারা। ছবি- সংগৃহীত 

একই ইচ্ছা হেফাজতে ইসলামেরও

ফ্যাসিবাদের দোসর আখ্যা দিয়ে জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধের দাবি জানিয়েছে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশও। শনিবার (৩০ আগস্ট) বিকালে এক বিজ্ঞপ্তিতে সংগঠনটির মহাসচিব মাওলানা সাজেদুর রহমান ও জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা জুনাইদ আল হাবিব এ দাবি জানান।

নেতৃদ্বয় নুরের ওপর হামলার তীব্র নিন্দা জানান এবং বলেন, ‘ভারতীয় আধিপত্যবাদের চিহ্নিত এজেন্ট জাতীয় পার্টিকে বিচারিক প্রক্রিয়ায় নিষিদ্ধ করতে সরকারের প্রতি জোর দাবি জানাই। জাতীয় পার্টিকে ঘিরে আওয়ামী ফ্যাসিবাদ পুনর্বাসনের অপচেষ্টা সফল হতে দেওয়া হবে না, ইনশাআল্লাহ।’

H
হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। ফাইল ছবি।

নিষিদ্ধের ব্যাপারে অ্যাটর্নি জেনারেল যা বলছেন

বিগত সময়ে আওয়ামী লীগের সব বিতর্কিত নির্বাচন ও জুলাই বিপ্লবে আওয়ামী লীগের দমন-পীড়নে জাতীয় পার্টি সহযোগিতা করেছে বলে অভিযোগ অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামানের। তিনি বলেছেন, ‘জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধের যে দাবি উঠেছে, এর আইনগত দিক যাচাই-বাছাই করে কী করা যায় দেখব।’

শনিবার (৩০ আগস্ট) ঝিনাইদহে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আঞ্চলিক কার্যালয় উদ্বোধন শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন।

Asad
জাপাকে নিষিদ্ধ করা যায় কি না, সে ব্যাপারে কথা বলছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান। ছবি- সংগৃহীত।

অ্যাটর্নি জেনারেলের প্রশ্ন, ‘গণহত্যা, সন্ত্রাস ও ফ্যাসিবাদের কারণে যদি আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হতে পারে, তবে জাতীয় পার্টি কেন নিষিদ্ধ হবে না?’ তিনি বলেন, ‘জাতীয় পার্টি ১৯৮২ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত দেশের মানুষের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করেছে, মানুষের রক্ত নিয়ে খেলেছে।’

এদিকে শুধু রাজনৈতিক দলগুলোই নয়, জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধের দাবি তুলেছে নেটমাধ্যমের বহু মানুষ। ফলে এই মুহূর্তে দারুণ বেকায়দায় জিএম কাদেররা। একে তো দলের মধ্যে দফায় দফায় ভাঙন, সেইসঙ্গে ‘মড়ার উপর খাড়ার ঘা’ হিসেবে চারিদিক থেকে নিষিদ্ধের দাবি। অদূর ভবিষ্যতে কী আছে দলটির ভাগ্যে, সেদিকেই তাকিয়ে গোটা দেশ।

এএইচ