বোরহান উদ্দিন
০১ জুলাই ২০২৫, ১০:০৪ এএম
চব্বিশের জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থান, শোক ও বিজয়ের প্রথম বর্ষপূর্তি গুরুত্বের সঙ্গে পালন করতে যাচ্ছে বিএনপি। ইতোমধ্যে বর্ষপূর্তি পালন নির্বিঘ্ন করতে ৫৮ সদস্যের কমিটি করেছে দলটি। তবে মূল কমিটিতে ঠাঁই মেলেনি বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের আন্দোলনে শহীদ হওয়া কোনো পরিবারের সদস্যের। শুধু তাই নয়, মূল কমিটি ছাড়াও মাসব্যাপী এই আয়োজন ঘিরে যেসব উপ-কমিটি হয়েছে তাকে জায়গা পেয়েছেন আওয়ামী লীগ ঘরানার পেশাজীবী লোকজন। ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় থাকা লোকজনও রয়েছেন সেখানে। আবার মূল দল ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাদের উপ-কমিটিতে পদ দেওয়ার ক্ষেত্রেও উঠেছে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের অভিযোগ।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা স্ট্যাটাস দিয়ে দলের ত্যাগী নেতাদের পেছনে ফেলে ‘চাটুকার’দের পদ দেওয়া হচ্ছে- এমন অভিযোগ তুলছেন। অনেকে কোণঠাসা হয়ে পড়ার ভয়ে মুখ খুলছেন না। তবে কমিটিতে অজানা-অচেনা লোকদের পদ পাওয়া নিয়ে নিজেদের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা চলছে বলে জানা গেছে।
৫৮ সদস্যের উপযাপন কমিটিতে আহ্বায়ক হয়েছেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। সদস্য সচিব হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক মোর্শেদ হাসান খান।
এছাড়াও বিএনপি গঠিত কমিটিকে সার্বিক সহযোগিতা করার জন্য অভ্যর্থনা, আপ্যায়ন, ব্যবস্থাপনা ও যোগাযোগ উপ-কমিটি করা হয়েছে। জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থান নিয়ে ‘সবুজ পল্লবে স্মৃতি অম্লান' শীর্ষক উপ-কমিটির কথাও জানানো হয়েছে দলের পক্ষ থেকে।
৯৬ সদস্যের অভ্যর্থনা উপ-কমিটিতে আহ্বায়ক হাবিব উন নবী খান সোহেল, সদস্য সচিব শামা ওবায়েদ। ৭৩ সদস্যের আপ্যায়ন উপ-কমিটির আহ্বায়ক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স ও সদস্য সচিব নুরুল ইসলাম নয়ন। ২০ সদস্যের ব্যবস্থাপনা উপ-কমিটিতে আহ্বায়ক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি ও সদস্য সচিব ড. আব্দুল্লাহ আল মামুন। ২০ সদস্যের যোগাযোগ উপ-কমিটিতে আহ্বায়ক ড. মাহদী আমিন ও সদস্য সচিব এহসান মাহমুদ।
‘সবুজ পল্লবে স্মৃতি অম্লান' শীর্ষক উপ-কমিটিতে আহ্বায়ক করা হয়েছে কৃষিবিদ হাসান জারিফ তুহিন ও সদস্য সচিব করা হয়েছে আতিকুর রহমান রুমনকে। ১৯ সদস্যের মিডিয়া উপ-কমিটির আহ্বায়ক ডা. মওদুদ হোসেন আলমগীর (পাভেল), সদস্য সচিব আতিকুর রহমান রুমন।
বিএনপির কেন্দ্রীয় একজন সহ-সম্পাদক নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘এই কমিটিতে কিছু লোককে আমরাও চিনি না। কাউকে দেখেছি সরকার পতনের পর। কারও বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের লোকজনের সঙ্গে সখ্যতার অভিযোগ আছে, ছবি আছে। জিয়া পরিবারকে নিয়ে কটূক্তি, শেখ মুজিবর রহমান, শেখ হাসিনার গুনগান গাওয়া লোকও জায়গা পেয়েছেন। এগুলো দেখে সত্যি লজ্জা পাচ্ছি। কিন্তু কাকে বলব এই কথা।’
আক্ষেপ প্রকাশ করে সাবেক এই ছাত্রনেতা বলেন, ‘কারা দলের ত্যাগীদের বাদ দিয়ে হাইব্রিড, তেলবাজদের সামনে এনে দলের ক্ষতি করছে তাও বুঝতেছি না। আমরা অনেকটা অসহায়।’
বিএনপির মূল কমিটিতে কেন্দ্রীয় কমিটির নেতাদের বাইরে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের সভাপতি -সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা মহানগরের দুই শীর্ষ নেতাকে রাখা হয়েছে। এছাড়া রয়েছেন ‘আমরা বিএনপি পরিবার’–এর আহ্বায়ক আতিকুর রহমান, সদস্য সচিব মোকসেদুল মোমিন, নাটোর জেলার যুগ্ম আহ্বায়ক ফারজানা শারমিন পুতুল, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শামীমা সুলতানা, অধ্যাপক নাহরীন খান, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তৌফিকুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবদুল্লাহ আল মামুন, সাংবাদিক আমিরুল ইসলাম কাগজী, সাইয়্যেদ আবদুল্লাহ, এহসান মাহমুদ এবং সাঈদ খান।
তবে সাংবাদিক হিসেবে এহসান মাহমুদ নামে যাকে মূল কমিটিতে রাখা হয়েছে তার বিরুদ্ধে পতিত সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ করেছেন খোদ বিএনপির লোকজন। দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগ বলয়ে থাকা, আওয়ামী লীগ সরকার ও ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে সখ্যতা থাকার পরও তিনি কীভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই আয়োজনে পদ পেয়েছেন তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। মূল কমিটির বাইরেও তাকে যোগাযোগ উপ-কমিটির সদস্য সচিব করা হয়েছে। যেখানে ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেন থেকে শুরু করে অনেক পরিচিত এবং মাঠে আন্দোলন করা নেতা সদস্য হিসেবে নিচের দিকে জায়গা পেয়েছেন।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, বিএনপিতে সংস্কারবাদী হিসেবে পরিচিত এক নেতার মাধ্যমে বিএনপিতে আসার সুযোগ পেয়েছেন এহসান মাহমুদ। পরবর্তী সময়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা থেকে শুরু করে যারা দলের কার্যনক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন তাদের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়িয়ে এই পদ বাগিয়ে নিয়েছেন তিনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির কেন্দ্রীয় এক নেতা ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘গত এক মাস ধরে এই এহসান মাহমুদ নামের লোকটাকে দেখতেছি। নেতাদের কাউকে সালাম দিয়ে, পানির বোতল এগিয়ে দিয়ে যদি দায়িত্ব পাওয়া যায় তাহলে আর মিছিল-মিটিং করে লাভ কী?’
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সদস্য আরিফা সুলতানা রুমা ফেসবুকে ছাত্রলীগের একাধিক অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া চয়ন ফারিয়া ইসলাম মেঘলা নামের একজনের ছবি পোস্ট শেয়ার করেছেন। যিনি অভ্যর্থনা কমিটির সদস্য। অথচ তাকে ছাত্রদলের রাজনীতিতে কখনো সক্রিয় দেখা যায়নি।
ফেসবুক পোস্টে রুমা লিখেছেন, ‘এটাই এখন বর্তমান রাজনীতির অবস্থা। সিন্ডিকেট সদস্যরা গর্বের সহিত এই সকল আওয়ামী দালালদের পুনর্বাসনে ব্যস্ত। ত্যাগীরা অভিমানে মুখ লুকিয়ে ফেলছে এই সকল দালালদের ভিড়ে। ত্যাগীদের জন্য কথা বলার কেউ নাই।’
ইডেন কলেজ ছাত্রদলের আহ্বায়ক রেহানা আক্তার শিরিনও একই মেয়ের ছবি পোস্ট করে লিখেছেন, ‘৪ সালের ২৮ অক্টোবর থেকে ২৫ সালের ৫ই জানুয়ারি পর্যন্ত যতগুলো রাজপথের দুঃসাহসিক দলীয় কর্মসূচিতে শরীরের ঘাম ঝরিয়েছি ৫ই আগস্টের পর আসা বসন্তের কোকিলেরা সেই পরিমাণ পানিও পান করে নাই। ফ্যাসিষ্টের সঙ্গে আঁতাত করা সন্ত্রাসী সংগঠন ছাত্রলীগ করা মেয়ের নিচের আমার নাম হবে কেন? পদ পদবী জুনিয়র সিনিয়র না জেনে চিনে জুলাই আগষ্ট গণঅভ্যুত্থান, শোক ও বিজয়ের বর্ষপূর্তি পালন অভ্যর্থনা উপ-কমিটিতে তার নাম আসে কিভাবে? এই সিন্ডিকেট কারা?’
সার্বিক বিষয় নিয়ে কথা বলতে উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক রুহুল কবির রিজভীকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। সদস্য সচিব মোর্শেদ হাসান খানকে ফোন করলেও ধরেননি। পরে হোয়াটসআপে প্রশ্ন পাঠালেও উত্তর পাওয়া যায়নি।
বিইউ/জেবি