images

রাজনীতি

অর্থবহ সংলাপের সম্ভাবনা কতটুকু?

বোরহান উদ্দিন

১৬ অক্টোবর ২০২৩, ০৭:৪৫ এএম

  • যুক্তরাষ্ট্রের পরামর্শের পর সরব সবপক্ষ
  • নিঃশর্ত হলে আপত্তি নেই আওয়ামী লীগের
  • আগ্রহ নেই, তবু সতর্ক বিএনপি
  • অর্থবহ সংলাপের বিকল্প দেখছেন না বিশ্লেষকরা

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আবারও রাজনৈতিক অঙ্গনে সমঝোতা আনতে শুরু হয়েছে সংলাপের আলোচনা। আন্তর্জাতিক মহলও জোর দিচ্ছে সংলাপে। তবে দেশে ভোটের আগের একাধিকবার একটেবিলে বসলেও বিএনপি-আওয়ামী লীগের মধ্যে অর্থবহ সংলাপের ঘটনা কখনো ঘটেনি। ফলে এ নিয়ে এবারও আশা দেখছেন না কেউ।

অন্যদিকে পুরোপুরি বিপরীত মেরুতে অবস্থান করা বড় দুই দলের এক পক্ষ বলছে শর্তহীন সংলাপ হলে বসতে রাজি। আর নির্বাচনকালীন সরকারসহ প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়নের উদ্যোগ দেখলে বিএনপিরও আপত্তি নেই।

তবে সংবিধানের আলোকে নির্বাচনে পূর্ণ প্রস্তুত থাকা আওয়ামী লীগ ও রাজপথে আন্দোলনে থাকা বিএনপির অনড় অবস্থানের মধ্যে কার্যকর সংলাপের সম্ভাবনা ক্ষীণ বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। অবশ্য দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফেরাতে যেভাবেই হোক দুই দলকে সংলাপের টেবিলে দেখতে চান তারা।

 

আরও পড়ুন

অর্থবহ সংলাপসহ ৫ দফা সুপারিশ মার্কিন প্রতিনিধি দলের 

 

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘দেশকে সংঘাতের হাত থেকে রক্ষায় ছাড় দেওয়ার মানসিকতা নিয়ে বড় রাজনৈতিক দলগুলোকে একসঙ্গে বসতে হবে। আলোচনার টেবিলে সমাধানে আসতে হবে। অর্থবহ সংলাপ বলতে যা বোঝায় তা হতে হবে। অন্যথায় নির্বাচনকে ঘিরে হয়তো সংঘাত বাড়ার আশঙ্কা থেকে যাবে।’

এদিকে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বলছেন, তারা সংবিধানের বাইরে যাবেন না। তবে শর্তহীন সংলাপে তারা প্রস্তুত। এতে আইনিও কোনো বাধা নেই।

বিএনপি নেতারা মনে করছেন, তফসিল ঘোষণার আগ পর্যন্ত রাজপথে শক্ত অবস্থান নেওয়া গেলে আন্তর্জাতিক মহল আরও সক্রিয় হবে। সরকারের প্রতি সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের চাপ বাড়বে। 

আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ইতোমধ্যে জানিয়েছেন, ‘বিএনপি চায় প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ, সংসদ ভেঙে দেওয়া, নির্বাচন কমিশন বাতিল করা এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করা। সংলাপের চিন্তা করব তখন, যখন তারা তাদের এসব শর্ত প্রত্যাহার করে নেবে। শর্তযুক্ত কোনো সংলাপের ব্যাপারে আমাদের কোনো চিন্তাভাবনা নেই। শর্ত তারা প্রত্যাহার করলে দেখা যাবে।’

America

আর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও সংলাপ ইস্যুতে জানিয়েছেন, ‘আমরা বরাবরই বলেছি, নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আলোচনা হতে পারে। আমরা আলোচনার পক্ষে। তবে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারসহ কয়েকটি এজেন্ডা ছাড়া আলোচনা অর্থবহ হবে না।’

এবার যেভাবে এলো সংলাপের আলোচনা

সম্প্রতি ঢাকায় সফর করে যাওয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল বাংলাদেশের সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে অর্থবহ সংলাপসহ পাঁচ দফা সুপারিশ পেশ করেছে। গত ৭ থেকে ১২ অক্টোবর ঢাকা সফর শেষে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে তারা এক বিবৃতিতে মোট পাঁচটি সুপারিশ তুলে ধরেন। শনিবার (১৪ অক্টোবর) ওয়াশিংটন থেকে প্রচারিত বিজ্ঞপ্তিতে প্রথমেই বলা হয় সংলাপের কথা। প্রতিনিধি দল মনে করে- নির্বাচনের গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হতে পারে উদার কথাবার্তা, উন্মুক্ত এবং গঠনমূলক সংলাপ।

আরও পড়ুন

দুই দলই অনড়, কূটনৈতিক তৎপরতায় বরফ কি গলবে?

এরপরই বিষয়টি নিয়ে রাজনীতির ভেতরে বাইরে বেশি আলোচনা শুরু হয়। কথা বলেন রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা।

অবশ্য চলতি সপ্তাহে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বিএনপি মহাসচিবের রুদ্ধদ্বার এক বৈঠক হয়েছে। যেখানে আগামী নির্বাচন নিয়ে দলের অবস্থান আবারও তিনি পরিষ্কার করেছেন বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে। অবশ্য এমন বৈঠকের কথা বিএনপির তরফে অস্বীকার করা হয়েছে।

রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা চলছে, ২০১৪ সালে জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর মধ্যস্থতায় যেভাবে সংলাপ হয়েছিল এবারও তেমন সংলাপ করার উদ্যোগ নেওয়া হতে পারে। এর আগে অবশ্য গত জুনে আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা আমির হোসেন আমুর বক্তব্যে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় সরকার সংলাপে রাজি এমন কথা উঠে এসেছিল। অবশ্য এমন বক্তব্য দিয়ে কিছুটা তোপের মুখে পড়েছিলেন বর্ষীয়ান এই নেতা।

সংলাপ নিয়ে আলোচনায় এক এগারোর সময় মো. আব্দুল জলিল ও মান্নান ভূঁইয়ার সংলাপও ঠাঁই পাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত সেই সংলাপও আলোর মুখ দেখেনি। তাই সংলাপে ভরসা পাচ্ছেন না কোনো পক্ষ।

কী বলছে বিএনপি?

তবে বিএনপি নেতারা অতীত অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে বলছেন, খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার অনুমতি দিয়ে বিদেশে পাঠানোর সুযোগ তৈরির মাধ্যমে সংলাপ শুরু হতে পারে। কূটনীতিকদের সঙ্গে একাধিক বৈঠকে নেতারা এমন মনোভাব প্রকাশ করেছেন। তবে তাদের আশঙ্কা ২০১৪ ও ’১৮ সালের সংলাপের মতো তিক্ত অভিজ্ঞতার মধ্যে পড়া নিয়ে।

যে কারণে সংলাপের বিষয়ে ‘সতর্ক’ভাবে তারা পা ফেলতে চান। যাতে করে সরকারের কৌশলের কাছে হেরে যেতে না হয় বিএনপিকে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে দলটির একজন ভাইস চেয়ারম্যান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গত নির্বাচনের আগে গণভবনে সংলাপ হয়েছে। অনেক ভালো ভালো কথা বলেছে সরকারি দল, একটা প্রতিশ্রুতিও রক্ষা করেনি। প্রার্থীদের রক্তাক্ত করেছে। ভোটের মাঠে দাঁড়াতেই দেয়নি।’

আরও পড়ুন

আন্দোলনের পাশাপাশি ভোটের প্রস্তুতিও বিএনপিতে

২০১৪ সালের নির্বাচনের আগের সংলাপের কথা তুলে ধরে সাবেক এই ছাত্রনেতা বলেন, ‘তারানকোর মধ্যস্থতায় বলা হয়েছিল ৫ জানুয়ারি নিয়মরক্ষার নির্বাচন হবে। পরে কী করেছে সরকার তা তো সবাই জানে। তাই এমন ফাঁদে পড়তে চাই না।’

League-BNP

দলটির মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা বলছেন, আন্তর্জাতিক মহলের চাপ এড়াতে সরকার সংলাপে জোর দিতে পারে। কিন্তু এজেন্ডা ঠিক করে, তার বাস্তবায়ন কীভাবে হবে সেসব চূড়ান্ত না করে সংলাপ হলে কোনো সুফল আসবে না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক যুবদলের কেন্দ্রীয় একজন সহ-সভাপতি ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আবারও সংলাপের ফাঁদে পা দিয়ে দলের বিপদ ডেকে আনার সঙ্গে যারা জড়িত হবেন তাদেরও চিহ্নিত করতে হবে। বারবার রাজনৈতিক ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার খেসারত মাঠের কর্মীরা বেশি দেয়। হাইকমান্ডকে এটা বুঝতে হবে।’

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, সংলাপের আলোচনা চললেও মাঠ ছাড়বে না বিএনপি। গত দুই নির্বাচনের আগে লম্বা সময় ধরে কঠোর কর্মসূচি দিলেও এবার অল্প সময় নিতে চায় দলটি। চলতি মাসের শেষ সপ্তাহকে সেজন্য বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি।

সংবিধানের আলোকে নির্বাচনে পূর্ণ প্রস্তুত থাকা আওয়ামী লীগ ও রাজপথে আন্দোলনে থাকা বিএনপির অনড় অবস্থানের মধ্যে কার্যকর সংলাপের সম্ভাবনা ক্ষীণ বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। অবশ্য দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফেরাতে যেভাবেই হোক দুই দলকে সংলাপের টেবিলে দেখতে চান তারা। 

বিএনপি নেতারা মনে করছেন, তফসিল ঘোষণার আগ পর্যন্ত রাজপথে শক্ত অবস্থান নেওয়া গেলে আন্তর্জাতিক মহল আরও সক্রিয় হবে। সরকারের প্রতি সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের চাপ বাড়বে।

আরও পড়ুন

নির্বাচনে ‘ভারত ফ্যাক্টর’, কী বলছে রাজনৈতিক দলগুলো?

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘বিএনপি সংলাপের বিরোধিতা কখনো করেনি। কিন্তু সেটা অর্থবহ সংলাপ হতে হবে। অতীতের মতো ধোঁকা দেওয়ার চিন্তা করলে তা সফল হবে না।’

আওয়ামী লীগ নেতারা কী বলছেন?

নির্দলীয় সরকারের অধীনে বিএনপি যখন ভোটের দাবিতে অনড় তখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের তত্ত্বাবধায়কের চিন্তা মাথা থেকে বাদ দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। একইসঙ্গে বিএনপির সঙ্গে আপস ও সমঝোতা করবে না বলেও সাফ জানিয়ে দেন।

অবশ্য শুক্রবার এমন বক্তব্য দিলেও রোববার কিছুটা সুর বদলে তিনি জানান, বিএনপি শর্ত প্রত্যাহার করলে সংলাপে রাজি। মার্কিন প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দলের সুপারিশ নিয়ে কোনো আপত্তি নেই বলেও জানান ওবায়দুল কাদের।

আর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সংলাপে আইনি বাধা নেই এমনটা জানিয়ে বলেছেন, নির্বাচন নিয়ে সংবিধানের বাইরে কোনো সংলাপ হতে পারে না।

বিইউ/জেবি