images

মতামত

দুর্গাপূজার স্মৃতিকথা

ঢাকা মেইল ডেস্ক

০২ অক্টোবর ২০২২, ০৩:২৬ পিএম

১. মহালয়া, দেবীপক্ষের সূচনা! বেজে উঠল ঐশ্বরিক কণ্ঠে মহালয়ার স্তোত্র। সেই ছোটবেলার ভোরবেলায় উঠে শ্রী বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের ঐশ্বরিক কন্ঠে মহিষাসুরমর্দিনী পাঠ রেডিওতে শুনতাম।

সেই ঐশ্বরিক কণ্ঠ শোনার সাথে সাথে শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যেত, যেন মা দুর্গার সান্নিধ্য পাওয়ার অনুভূতি। সেই অনুভূতি এখনও জীবন্ত!

২. এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম স্ক্রলিং করার সময় যখন মহালয়ার সেই ঐশ্বরিক কণ্ঠ বেজে উঠে, আমি তৎক্ষণাৎ থেমে যাই। সেই সুর কানে আসতেই ছোটবেলার শিহরণ অনুভব হয়। এটা অকৃত্রিম, পবিত্র এবং ঐশ্বরিক অনুভব যার কোনো মরণ নাই!

ছোটবেলা, তখন একটা ক্রেজ ছিল, কিউরিসিটি থাকতো যে, কোন প্রতিমা বেশি সুন্দর হবে, কোন মণ্ডপে বেশি আরতি হবে, কতক্ষণ আরতি করতে পারবো, কেমন লাগবে দেখতে ইত্যাদি ইত্যাদি।

৩. মহালয়ার ভোরে বাজছে মহালয়ার স্তোত্র! সঙ্গে শঙ্খধ্বনি! মাঝে মধ্যে মা জেঠিদের উলুধ্বনি! এ যেন এক অদ্ভুত রোমাঞ্চ!

আমার কাছে এই রোমাঞ্চ কোনো ধর্মের নয়, আবার আমার একারও নয়। এটি সম্প্রীতির, এটি সার্বজনীন! সবাই মিলে উদযাপন করার!

My observation:

‘This festival is not religion, this is our heritage, our traditions and our rituals.’

৪. ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আখাউড়া থানার অন্তর্গত রাধানগর গ্রামে আমার জন্ম। আমাদের বাড়ির সামনেই একটি বিশাল দীঘি রয়েছে, লোকমুখে এই দীঘি 'রাণীর দীঘি' নামে পরিচিত। এই দীঘির উত্তর পাড়ে ঘোষ পাড়া, দক্ষিণে দাস পাড়া, পূর্বে শীল পাড়া আর পশ্চিমে পাল পাড়া। সাহা পাড়া ছিল আমাদের বাড়ির ঠিক দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে লালবাজার সংলগ্নে।

আরও পড়ুন: ‘শৈশবে দুর্গাপূজা মানেই ছিল মামাবাড়ি যাওয়া’

পূজোর মণ্ডপ বা মন্দিরের সুন্দর অবস্থান বোঝাতে দীঘির পাড়ের বর্ণনা অনুভব করলাম। আমাদের গ্রামের মানুষের মধ্যে একে অপরের প্রতি একটা টান ছিল, ছিল দারুণ সম্প্রীতি। বোধ করি এখনও তা তাজা।

৫. তখন আমাদের গ্রামে তিনটা দুর্গাপূজা হতো। ১. রাধামাধব আখড়ায়, ২. দাস পাড়ায় এবং ৩. সাহা পাড়ায়। পূজোর এক-দেড় মাস আগে থেকেই প্রতিমা তৈরির কাজ শুরু হতো।

৬. তখন থেকেই আমার মনের মধ্যে পূজোর আনন্দ-অনুভূতি জাগত। প্রাথমিক এবং উচ্চমাধ্যমিকে থাকার সময় স্কুলের পড়াশোনার ফাঁকে আমরা পাড়ার কয়েকজন মিলে ওই তিন মন্দিরের প্রতিমা তৈরি দেখতে যেতাম আর ভাবতাম কবে পূজোর দিনটি আসবে।

৭. তারপর দেখতে দেখতে মহালয়া পেরিয়ে সেই আনন্দের দিনটি এসে যেত। পূজোতে প্রায় ১০/১২ দিন স্কুল ছুটি থাকত। সেইজন্য পড়াশোনার তেমন কোনো চাপ থাকত না।

৮. বাড়ি থেকে পূজো মণ্ডপের ঢাকের বাদ্য শোনা যেত। পূজো মণ্ডপগুলোকে আলোকসজ্জা করা হতো। দাসপাড়ার পূজো মণ্ডপটা ঠিক রানীর দীঘির দক্ষিণ পাড়ে। দীঘির অন্য পাড় থেকে এই মণ্ডপটা রাতের বেলায় দেখতে অনেক সুন্দর লাগত। কারণ, রাতের বেলায় দীঘির জলের মধ্যে মণ্ডপ ও আলোকসজ্জার প্রতিচ্ছবি দেখা যেত।

৯. সন্ধ্যার পর সব ধর্মের মানুষ মণ্ডপে মণ্ডপে ভিড় করতেন। পূজোর দিনগুলোতে পূজো প্রাঙ্গণে মনোহারি, তেলেভাজা, মিষ্টি, বাজি, খেলনা এবং আরও বাহারি পসরা নিয়ে দোকান বসত। এককথায় বলা যায় যে, পূজো মানে গ্রামের মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির মেলা।

১০. আমি পাড়ার বন্ধুদের সাথে পূজো দেখতে যেতাম। সন্ধ্যায় ঢাক, কাঁসর, ঘণ্টা বাজত আর ধূপ-ধুনোতে সারা মণ্ডপ ভরে উঠত। ঢাকের তালে আমার কী যে নাচ...!!! কখনও ব্রাক ডান্স, কখনো গ্রোপ ডান্স, কখনও আরতি, কখনও কনটেম্পোরারি ডান্স মানে নাচতে পারলেই হলো। অর্থাৎ সবাই মিলে আনন্দ করাই ছিল মোটকথা।

১১. আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক- শংকর গোস্বামী স্যারের একটা কথা খুব মনে পড়ে-

স্যার আমাকে বলেছিলেন, ‘ওই মায়ের মূর্তির দিকে দেখ, ওই মূর্তির মধ্যে সত্যিকার মা-দূর্গা এসে বিরাজ করবে।’

আমি তখন অধীর আগ্রহে দুর্গামায়ের মূর্তির দিকে তাকিয়ে থাকতাম। স্যারের ওই কথা শোনার পর আমার মনে অনেক আনন্দ অনুভব হয়েছিল।

১২. এভাবে মহালয়া তারপর পূজোর চার দিন। মণ্ডপে মণ্ডপে দল বেঁধে ঘুরে বেড়ানো, এটা সেটা খাওয়া, বাজি ফাটানো এবং সন্ধ্যায় আরতি করার মাধ্যমে আমার মনের গহীনে অনেক আনন্দ অনুভব হতো।

১৩. এইভাবে আনন্দ এবং পূজোর আনুষ্ঠানিকতা পরিপালন করতে করতে পূজোর চারটি দিন পার হয়ে যেত। দশমীর দিনটি আমার কাছে অনেক কষ্টের এবং বিষাদের ছিল। রাত প্রায় ৯টার মধ্যে বিসর্জনের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়ে যেত। তিতাস নদীর শাখা নদীতে আমাদের প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হতো।

আরও পড়ুন: সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে

তখন হাতে হাতে ধরে প্রতিমাকে বিসর্জন ঘাটে নেয়া হতো। আমার মনে পড়ে- কোনো এক বিসর্জনের সময় বৃষ্টি হয়েছিল। সেই বৃষ্টিতে ভিজে কাদামাটি লেগে একেবারে নাস্তানাবুদ অবস্থা। মনে কষ্ট থাকলেও কিছু করার ছিল না, বিসর্জন ত দিতেই হবে। তারপরও মনে একটা আলাদা আনন্দ-সুখ-দুঃখ সবমিলিয়ে যে অনুভূতি পেয়েছিলাম তা আজও মনের মধ্যে দাগ কাটে।

১৪. ১৯৯৬ সাল থেকে পড়াশোনা এবং চাকরির সুবাদে কখনও রাজশাহী কখনও ঢাকায় থাকতে হয়েছে। সেই থেকে আমাদের গ্রামের পূজোর কাঁচা গন্ধ পাই না; ঢাকের বাদ্য, কাঁসর আওয়াজ এবং ধূপের পবিত্র ধোঁয়ার তালে আরতির সেই স্বাদ পাই না; এমনকি চেনা মানুষগুলোর স্নেহ এবং শাসন মিশ্রিত ডাকও শুনতে পাই না।

১৫. বর্তমানে আমি চাকরি সূত্রে ঢাকায় বসবাস করছি। এখানেও দুর্গাপূজা হয়। দেখছি, এখানে আলোর কারুকার্য, প্যান্ডেলের চাকচিক্য। কিন্তু প্রতিমা, সেই আগের মতো, এমনকি পূজোর আনুষ্ঠানিকতাও আদি। তারপরও আমার ছেলেবেলার গ্রামের দুর্গাপূজোর স্মৃতি আজও মনকে আনন্দে ভরিয়ে দেয়। মনের অজান্তেই মাঝেমধ্যে স্মৃতিকাতর হয়ে যাই; প্রায়শই জল জমে চোখের কোণে।

লেখক: ব্রাঞ্চ ম্যানেজার, বিডিবিএল, কারওয়ান বাজার ব্রাঞ্চ, ঢাকা