বয়স যখন দশের গণ্ডিতে, স্কুল ছুটি মানে আরব্য রজনীর রূপকথার গল্প। পড়াশোনা আর কঠোর অনুশাসনের মধ্যে এক চিলতে রোদ বলতে ছিল শরতের সময়টা। তখন তো আর বুঝতাম না শরৎ কী জিনিস। সেটা ছিল বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ কোনো সময়।
আমি বুঝতাম শিউলি ফুল ফুটলেই আমার সুখের দিন আসবেই। শিউলি ফুলের সঙ্গে সেই ভালোলাগা এখনো রয়ে গেছে। চোখ বন্ধ করলেই এখনো নাকে ভাসে কুয়াশাভেজা শিউলি ফুলের গন্ধ। হিন্দু বাড়িতে সকালে উঠোনে গোবরের ছিটা আর শিউলি ফুলের সেই অপরূপ মৈথুন এখনো ভুলতে পারি না।
বিজ্ঞাপন
পূজার সময় সবারই মামাবাড়িতে যাবার ধুম লেগে যেতো। আমাদের ছেলেবেলার একটা খেলা ছিল কার কোন আত্মীয় কত দূরে থাকে এগুলো নিয়ে গল্প করা। যাদের আত্মীয়রা বিদেশে থাকত প্রতিযোগিতায় তাদের সঙ্গে টিকে থাকা অনেক কঠিন হয়ে যেত।
আমার দূরের আত্মীয় বলতে ছিল ছোট মামা আর একবার খুব ছোটবেলায় ইন্ডিয়া ভ্রমণের স্মৃতি। কোনো এক পূজায় মামা ঢাকা থেকে জামা-প্যান্ট পাঠিয়েছিলেন। এই এক জামা কাপড় নিয়ে কত খেলায় জিতেছি ইয়ত্তা নেই। জীবনে কত কিছু ভুলে গেছি কিন্তু প্যান্টে আঁকা ফুটবল এখনো ভুলতে পারিনি।
আমার শৈশব এর নায়কেরা এখন সবাই শেষ বয়সে। অনেকে চিরতরে হারিয়ে গেছে। দুর্গাপূজার সঙ্গে মামাবাড়ি শব্দটা জড়িয়ে আছে, মামাবাড়ি যাবার আগে কত সাজগোজ! এক সপ্তাহ আগে থেকে ঘুম হতো না। দিদিমনি, মামা-মামী, মাসীদের নিয়ে কী অপরূপ সময়! মামাবাড়ি যাবার পথে একটা বড় বটগাছ ছিল। ঐ বটগাছ দেখেই আমার পূজা শুরু হতো।
বিজ্ঞাপন
পথে যেতে যেতে দুদিকে পূজার মণ্ডপ, ঢাকের বাদ্য, ধূপের সুবাস। সেই মাতাল করা সন্ধ্যা এখনো ভুলতে পারি না। একটানা অনেকদিন বই পড়া থেকে মুক্তি পেতে এই পূজার কোনো বিকল্প ছিল না। মামাবাড়িতে অনেকগুলো একান্নবর্তী পরিবার ছিল, পূজায় সবাই আসতো। এক বছর পর এসব ছোট্টবেলার বন্ধুদের দেখে যে শান্তি পেতাম তা অসামান্য।
বাজি, মেলা আর বাদ্য-বাজনা নিয়ে কী অসাধারণ আয়োজন! প্রতিটি বাড়ি উৎসবমুখর হয়ে থাকতো। আমাদের কোনকিছুতে কোন বারণ ছিল না। সকাল থেকেই খেলাধুলা শুরু হতো, দুপুরে একসঙ্গে সবাই খালে ঝাঁপিয়ে গোসল করতাম। যতক্ষণ না বকা শুনতাম ততক্ষণ চলতো আমাদের জলকেলি। লাল চোখে, মুখে শ্যাওলা নিয়ে ভয়ে ভয়ে বাড়ি ঢুকতাম। মাঝে মাঝে মার জুটত কপালে। দুপুরের ঘুম ছিল আমাদের সবচেয়ে বড় শত্রু, আমাদের ঘুম আসতো না তবুও চোখ বুঝে পড়ে থাকতে হতো।
কোনরকম বিকেল হলেই আবার মাঠে, সন্ধ্যায় বের হতাম প্রতিমা দেখতে। নতুন জামা জুতার সেই দিনগুলো ভোলা যায়না। মেলা আর প্রতিমা দেখতে দেখতে অনেক রাত হয়ে যেতো। রাতে ফেরার সময় বাঁশ ঝাড়ে জোনাকি ধরতাম। রাতে প্যাকেটে করে রেখে দিতাম। আহা সেসব দিন, এখন স্বপ্নেও পাওয়া সম্ভব নয়।
পূজার সময় নৌকাবাইচে নিয়ে যেতেন মানিক দাদু তার ভ্যানে করে। পুরো দেখাশোনা তার দায়িত্বে পড়ত। জানি না কোথায় সব হারিয়ে গেছে। নৌকাবাইচ দেখতে দেখতে সন্ধ্যায় আবার পূজা দেখে একবারে ঘরে ফিরতাম। বাড়িতে ফিরেই দেখতাম দিদিমণি, মামী, মাসিরা মিলে পিঠার আসর বসিয়েছে। আমরা টুকটাক লুকিয়ে বানানোর আগেই কিছু পিঠা নিয়ে নিতাম। লুকিয়ে লুকিয়ে খেতাম।
রাতে দিদিমনি সাত সমুদ্র তেরো নদীর পাড়ের রাজপুত্রের গল্প শুনাতেন, কখন ঘুমিয়ে যেতাম টের পেতাম না। ছোটবেলায় মিষ্টি খুব পছন্দ ছিল। বড়মামা একবার নিয়ে গেলেন মিষ্টির দোকানে। যে যতো খেতে পারি এমন বলে গেলেন। ভাবলাম পুরো কড়াই শেষ করে দেবো। খাওয়ার সময় ৭টার বেশি খেতে পারলাম না। মামা হারিয়ে গেছেন পৃথিবীর নিয়মে, তার কবরের ঘাস জানান দিচ্ছে পৃথিবীর সময় কতো তুচ্ছতম।
বাড়ি ফেরার ২ দিন আগে থেকেই কষ্ট লাগা শুরু হতো। মায়ের বিসর্জনের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সুখেরও বিসর্জন হতো। ভাইবোনেরা গলা জড়াজড়ি করে কাঁদতাম। বাবা-মা কখনো ১/২ দিন থাকার মেয়াদ বাড়িয়ে দিতেন। কিন্তু ফিরে তো আসতেই হতো। বাড়িতে ফিরে এসে জীবনের নাড়িছেঁড়ার আসল কষ্টটা অনুভব করতাম। আবার সেই চেনা গণ্ডিতে ফিরে আসা। আবার ১ বছরের অপেক্ষা।
জীবনের সব ব্যস্ততা একদিন শেষ হয়, আকাশের তারাদেরও একদিন বিদায় নিতে হয়। শূন্য এ জীবনে ইট-কাঠ আর পাথরের দেয়ালে বসে ভাবি আমাদের শ্রেষ্ঠ সময় কোনটি! যেটি ফেলে এসেছি, নাকি অনাগত দিন।
আমাদের সেই আদরের দিন, সুখের মুহূর্তগুলো হয়তো আর ফিরে আসবে না। হয়তো আমাদের মতো করেই এখন ভাবে আমাদের শিশুরা। তারাও পূজা দেখে, মামাবাড়ি হয়তো তাদের কাছে এখনো রঙিন ফানুসের খেলা। মানুষের সুখের মোড়ক জীবনের বাঁকে বাঁকে বদলে যায়। তবুও মানুষ স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে থাকে।
আমাদের জীবনের বাতাবরণে ভালোবাসা যেন হারিয়ে না যায়। আর উৎসবের আনন্দ হোক সার্বজনীন জীবনের জয়গান।
লেখক: বিসিএস (পুলিশ) ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত, ৪০ তম বিসিএস
এনএম