ঢাকা মেইল ডেস্ক
০১ অক্টোবর ২০২৩, ০৭:৩৯ পিএম
এলাকায় এক সাধারণ গৃহস্থের দীর্ঘদিনের পৈত্রিক সম্পত্তিতে ‘দখল সূত্রে মালিক’ সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিয়েছেন স্থানীয় প্রভাবশালী এক নেতা। বসতবাড়ি হারিয়ে তিনি ছুটে গেলেন থানায়, উপজেলা ভূমি অফিস, কাউন্সিলরের কার্যালয়ে। কোথাও কোনো প্রতিকার পেলেন না। থানায় মামলা নেয় না, ভূমি অফিসের লোকজন রেকর্ড দেখাতে চায় না। নিরুপায় হয়ে লোকটা ছুটে আসে সাংবাদিকের কাছে। এ নিয়ে একটা ‘নিউজ’ হলে যদি কিছু হয়! এভাবেই সারাদেশের মানুষের কাছে আস্থা আর শেষ ভরসার প্রতীক সাংবাদিকরা।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে সবজির চওড়া দাম, ডিম-আলুর বাজারে সিন্ডিকেট, এলপি গ্যাসের সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে বেশি দামে, টিসিবির গম চুরি, বাস ভাড়ায় নৈরাজ্য, ওয়াসার এমডির দুর্নীতি, খাবার স্যালাইনের সংকট, গভীর রাতে মার্কেটে আগুন, শত কোটি টাকা লোপাট সব কিছুতেই গণমাধ্যমের সরব উপস্থিতি।
ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের রাঘব বোয়ালদের সব অপকর্মের ফিরিস্তিও দেশের মানুষের সামনে উঠে এসেছে সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে। যথাযথ তদারকির অভাবে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো যেখানে মুমূর্ষু ব্যক্তির মতো শেষ দিন গুণছে, সেখানে ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে আমাদের মিডিয়াগুলো। রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ তার দায়িত্ব পালন করছে সুনিপুণভাবে।
রাজধানীতে বসে সাংবাদিকতা করা বা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে প্রশ্ন করা যতটা সহজ, স্থানীয় পর্যায়ে সাংবাদিকতা করা ততটাই বিপদের। একজন ওয়ার্ড নেতারও সেখানে দোর্দণ্ড প্রতাপের রাজত্ব। তার হুংকারে স্থানীয় পর্যায়ের পত্রিকায় নিউজ ছাপতে পারে না। জামালপুরে সাংবাদিক নাদিম তো এমনই এক ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতার জিঘাংসার শিকার। পত্রিকার অফিসে প্রভাবশালীদের হামলা-ভাঙচুর সেখানকার নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এমন প্রতিকূল পরিবেশ স্থানীয় পর্যায়ে তৈরি করেছে একটি সুবিধাভোগী সাংবাদিক শ্রেণির। এজন্যে স্থানীয় সংবাদ সংগ্রহ করতে মাঝে মাঝে ঢাকা থেকে ‘নিজস্ব প্রতিবেদক’কে ছুটে যেতে হয়।
সাংবাদিকতা করতে গিয়ে সাধারণ মানুষের রোষানলে পড়ার ঘটনাও নিতান্ত কম নয়। যেখানে নিয়ম ভাঙাই আইন, সেখানে নিয়মের বালাই থাকবে না এটাই স্বাভাবিক। সাংবাদিকের তাই উভয় সংকট। ভুক্তভোগীর পক্ষে কথা বলতে গেলেও তাকে শুনতে হয় গঞ্জনা। মেট্রোরেলে লাইনছুট যাত্রী, স্টেডিয়ামের ব্ল্যাকে টিকিট কাটা দর্শক বা হাসপাতালের নিয়ম ভাঙা কর্মচারীকে প্রশ্ন করা সহজ ব্যাপার নয়। তাদের নীতির বাইরে গেলে দলবেঁধে হামলার ঘটনাও ঘটে। সাংবাদিকের তখন প্রাণ নিয়ে পালানো ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।
এতকিছুর পরও সাংবাদিকরা দমে যাওয়ার পাত্র নন। পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যখন অনেক স্পর্শকাতর ঘটনা সযত্নে এড়িয়ে যায়। সেখানে সাংবাকিরা বুম আর ক্যামেরার জোরে মাঠে নামেন। অস্ত্র আর প্রভাবের বিরুদ্ধে অসম লড়াইয়ে নেমে পড়েন। কিছু দুঃসাহসী সাংবাদিকের এ লড়াই জন্ম দিয়েছে ইনভেস্টিগেশন ৩৬০ ডিগ্রি, তালাশ আর সার্চলাইটের মতো জনপ্রিয় কিছু অনুষ্ঠানের। তাদের তদন্ত আর সত্য উদঘাটনের নিরলস শ্রম মাঝে মাঝে রাষ্ট্রীয় বেতনভোগী সংস্থাকেও হার মানায়।
অর্থকষ্ট সাংবাদিকদের নিত্যসঙ্গী। গুরুত্বপূর্ণ কিছু বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা গুটিকয়েক গণমাধ্যম বাদে বেশিরভাগ অফিসেই সাংবাদিকরা দিনের পর দিন বেতন পান না। তাদের নিরন্তর ছুটে বেড়ানো আর নির্ঘুম রাতের রিপোর্টিংয়ের বদৌলতে টিকে থাকে প্রতিষ্ঠানগুলো। আর বাহবা কুড়ান স্যুটটাই পরা নিপাট ভদ্রলোক সম্পাদক। সংবাদপাড়ার উঁচুতলা আর নিচুতলার মানুষদের বেতনের ফারাকটাও আকাশ-পাতাল। কথায় কথায় চাকরি হারানোর ভয়ে থাকা সাংবাদিকের বেতনের অংক নিয়ে সন্তুষ্ট না থেকে উপায় কি?
>> আরও পড়ুন:
দিশেহারা মানুষ, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব কার?
নতুন করে সাংবাদিকের উপর চেপেছে মামলার ভয়। প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান বা ক্ষমতাসীনের ‘অনুভূতি’ আর ‘ভাবমূর্তি’র বিরুদ্ধে গেলে সাংবাদিককে নামতে হয় আইনি লড়াইয়ে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আর সাইবার সিকিউরিটি যাই হোক না কেন, সাংবাদিকের লেখার কলমকে চেপে ধরার চেষ্টার কোনো শেষ নেই।
সাংবাদিকের অফিস বছরে প্রতিদিন। সূর্যকে যেমন প্রতিদিন নিয়ম করে উঠতে হয়, সাংবাদিককে প্রতিনিয়ত ছুটতে হয় খবরের পেছনে। সারাদিনের ছোটাছুটি শেষে বিকেলে সময়মতো নিউজ পাঠাতে হয়। পরদিন সকালে ঝকঝকে ছাপার অক্ষরে নিজের সংবাদ দেখতে পেলে ক্লান্তি যেন নিমিষেই হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। রোদ-বৃষ্টি-বন্যা-জলোচ্ছ্বাসে সবখানে সাংবাদিকের সরব উপস্থিতি। পরিবার-পরিজনদের সময় দেওয়া তার হয়ে উঠে না। সৃষ্টিশীলতা আর নতুনত্বের আনন্দের কাছে তার বাকি সব তুচ্ছ।
পত্রিকা বা টেলিভিশন সংবাদেরও নির্ধারিত ব্যাকরণ আছে। পত্রিকায় যেমন ‘ষড় ক’ বা ‘ফাইভ ডব্লিউ ওয়ান এইচ’ এর সূত্র মেনে লিখলেই একটি সংবাদ দাঁড়িয়ে যায়, সেখানে টিভির সংবাদে সবসময় ‘ষড় ক’ আবশ্যক নয়। পত্রিকার সংবাদ লেখা হয় পাঠকের পড়ার জন্য সেখানে পাঠক মাত্রেই শিক্ষিত শ্রেণি। অপরদিকে টিভি বা পর্দায় খবর তৈরি করা হয় শিক্ষিত-অশিক্ষিত সব শ্রেণির জন্য। সেখানে শব্দ হতে হয় সহজ ও সাবলীল। দীর্ঘদিন কাজ করে সাংবাদিকের প্রতিটি লেখা ও কথায় তাই হাত পাকা করতে হয়। এ সাধনা নিরবিচ্ছিন্ন ও ঐকান্তিক।
সাংবাদিকের প্রতিকূলতার কোনো শেষ নেই। সমাজ-সংসার সর্বত্রই তাকে সমান লড়াই চালিয়ে যেতে হয়। প্রচলিত সংস্কার আর নিয়মকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে টিকে থাকা সহজ কথা নয়। দেশের প্রতি অপরিসীম মমত্ববোধ আর ভালোবাসা না থাকলে এটা সম্ভব নয়। অর্থকষ্ট, চাকরি হারানোর ভয়, মামলার বেড়াজাল সব পেরিয়ে সাংবাদিকরা প্রতিদিন ছেপে চলেন ১৬ কোটি মানুষের হৃদয়ের কথা। একবার এ সৃষ্টিশীলতার আনন্দ যাকে পেয়ে বসে তাকে দমিয়ে রাখে এমন সাধ্য কার আছে?