images

জাতীয়

বিদেশিদের উদ্বেগে ‘বাড়াবাড়ি’ দেখছে সরকার

বোরহান উদ্দিন

০৯ ডিসেম্বর ২০২২, ১০:০৩ এএম

ঢাকায় বিএনপির সমাবেশ ঘিরে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি হঠাৎ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। সহিংসতার আশঙ্কায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের মতো দেশ ঢাকায় তাদের নাগরিকদের চলাচলে সতর্কতা জারি করেছে। অন্যদিকে সভা-সমাবেশ শান্তিপূর্ণভাবে করা এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে তাগিদ দিয়েছে জাতিসংঘ।

তবে কূটনৈতিকদের এমন উদ্বেগকে বাড়াবাড়ি হিসেবে দেখছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। কূটনৈতিক সীমা অতিক্রম করার অভিযোগও তুলেছে দলটি। সীমা লঙ্ঘন করলে কূটনীতিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথাও বলছে সরকার।

অন্যদিকে আগামী নির্বাচন সামনে রেখে বিদেশিদের এমন উদ্বেগ ও বক্তব্যে কিছুটা স্বস্তি খোঁজার চেষ্টা করছে বিএনপি। কূটনীতিকদের এই ধরনের উদ্বেগ প্রকাশ পেলে তা নিয়ে উৎফুল্ল দেখা যায় বিএনপির নেতাকর্মীদের।

আর আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা এটিকে দেখছেন, স্বাধীন দেশের নির্বাচনসহ অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে বিদেশিদের উদ্বেগ ও বক্তব্যের পেছনে সরকারকে চাপে রাখার কৌশল হিসেবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, নির্বাচন ও রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা নিয়ে বিভিন্ন দেশ যে উদ্বেগ দেখায় বা বক্তব্য দেয় তা আসলে সরকারকে চাপে রাখার কৌশল। অনেক সময় কূটনৈতিক সীমানাও ছাড়িয়ে যায় তাদের বক্তব্য। অথচ অনেক দেশেই গণতন্ত্র নেই, সহিংসতা হচ্ছে-- তা নিয়ে কিন্তু এরা কথা বলে না।

কেন কূটনীতিকদের উদ্বেগ

দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন, বিরোধী রাজনৈতিক দলকে সভা-সমাবেশ করার অবাধ সুযোগ দেয়া, গ্রেপ্তার বন্ধসহ নানা ইস্যুতে প্রায়ই কথা বলেন বাংলাদেশে অবস্থিত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপানসহ কয়েকটি দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের এসব ইস্যুতে কথা বলতে দেখা যায়। তবে সবসময়ই সরকারের পক্ষ থেকে এসব বক্তব্যের কড়া সমালোচনা করা হয়। এমন কি প্রতিবাদও জানানো হয়। এরপরও থামছে না কূটনৈতিকদের বক্তব্য।

> আরও পড়ুন: এবার যুক্তরাষ্ট্রও নাগরিকদের ঢাকায় চলতে সতর্ক করল

সবশেষ বিএনপির ১০ ডিসেম্বরের যুক্তরাজ্য বাংলাদেশে থাকা তাদের নাগরিকদের জন্য ভ্রমণ সতর্কতা জারি করে। গত মঙ্গলবার (৬ ডিসেম্বর) ব্রিটিশ সরকারের ফরেন ট্রাভেল অ্যালার্টে ঢাকায় চলাচলে নিজ দেশের নাগরিকদের সতর্ক করা হয়। একইসঙ্গে ১০ ডিসেম্বর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘাত এবং যানবাহন সংকটের আশঙ্কার কথাও বার্তায় বলা হয়।

এর একদিন পর বুধবার (৭ ডিসেম্বর) একই সতর্কতা জারি করে যুক্তরাষ্ট্র। দূতাবাসের ফেসবুকে পোস্টে বলা হয়, বাংলাদেশের প্রধান দুটি বড় রাজনৈতিক দল ১০ ডিসেম্বর ঢাকার র‌্যালির ঘোষণা দিয়েছে। শান্তিপূর্ণভাবে হওয়ার কথা থাকলেও এই বিক্ষোভ সংঘাতময় হয়ে উঠতে পারে। বাড়তে পারে সহিংসতা। 

দূতাবাসের নিজস্ব ওয়েবসাইটেও এ বিষয়ে একটি বিবৃতি দেওয়া হয়। এতে সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক সংঘাত বাড়তে পারে-- এমন আশঙ্কার কথাও বলা হয়।

এদিকে দুই দেশের ভ্রমণ সতর্কতার মধ্যেই বুধবার নয়াপল্টনে বিএনপির নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে একজন নিহত হয়। অনেকে আহত হয়। গ্রেপ্তার করা হয় ৩ শতাধিক নেতাকর্মীকে।

dm
ড. দেলোয়ার হোসেন ও আমেনা মহসিন

এমন ঘটনার মধ্যেই মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি গোয়েন লুইস একটি বিবৃতি দেন। এতে তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ মুক্তভাবে মতপ্রকাশ, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশ আয়োজন করতে দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর থেকেও বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার নিশ্চিতের আহ্বান জানানো হয়েছে। বুধবার নিয়মিত ব্রিফিংয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র নেড প্রাইস বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান তুলে ধরতে গিয়ে এই আহ্বান জানান।

> আরও পড়ুন: ১০ ডিসেম্বর ঘিরে ঢাকায় চলাচলে নাগরিকদের সতর্ক করল যুক্তরাজ্য

অবশ্য এমন উদ্বেগকে খুব বেশি গুরুত্ব দিতে চান না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের আরেক শিক্ষক অধ্যাপক আমেনা মহসিন। ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, কূটনীতিকদের এমন উদ্বেগ তো নতুন নয়। কিছুদিন পরপরই তারা বিবৃতি দেন। আর একটু পরিস্থিতি উত্তপ্ত হলে নিয়মের মধ্য থেকে বিভিন্ন দেশ এসব দিয়ে থাকে। এটা তেমন কিছু বলে মনে হয় না।

উদ্বেগের সমালোচনায় সরকার

এদিকে বাংলাদেশের সবশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে একাধিক দেশের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কড়া সমালোচনা করেছে আওয়ামী লীগ।

বৃহস্পতিবার দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, তাদের উদ্বেগকে এক তরফা। এটা উচিত নয়। কূটনৈতিক সৌন্দর্য্য নষ্টের অভিযোগ তুলে তিনি বলেন, বিদেশিরা আমাদের বন্ধু। আমরা আপনাদের বন্ধু থাকতে চাই। আমাদের সঙ্গে শত্রুতা করবেন না। একতরফাভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করা উচিত নয়। এটা কূটনীতিক সৌজন্যতা নয়।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনও সম্প্রতি কূটনীতিকদের আচরণবিধি মেনে চলার পরামর্শ দিয়েছেন। আর পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বাংলাদেশে নিযুক্ত বিদেশি কূটনীতিকরা সীমা অতিক্রম করলে সরকার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলেও হুঁশিয়ারি দেন।

> আরও পড়ুন: রাজনৈতিক সহিংসতায় উদ্বেগ জানিয়ে মার্কিন দূতাবাসের বিবৃতি

কূটনীতিকদের এমন উদ্বেগ ও বক্তব্য নিয়ে আওয়ামী লীগের শীর্ষ একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলেও তারা রাজি হননি। দলের সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্যের পর এ নিয়ে কথা বলতে তারা অপরাগতা প্রকাশ করেন।

বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ড. দেলোয়ার হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, কূটনীতিকদের এমন উদ্বেগকে আসলে বড় করে দেখি না। কারণ যে কোনো দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা, সহিংসতা থাকতে পারে। কিন্তু এ নিয়ে আগ বাড়িয়ে তারা কথা বলেন। অবশ্য জাতিসংঘ বা পশ্চিমা দেশগুলো সব দেশের ব্যাপারে কথা বলে না। কখনো কখনো সীমার বাইরেও চলে যায়। এগুলো খেয়াল রাখা উচিত।

রাজনৈতিক দলগুলোর কারণই এমন সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে বলেও মনে করেন তিনি।

ঢাবির এই অধ্যাপক বলেন, ভারতে বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিরূপ সম্পর্ক আছে। কিন্তু তারা কূটনৈতিকদের দারস্থ হয় না। আমাদেরও উচিত সহনশীল হওয়া এবং রাজনৈতিক আস্থাশীলতা তৈরি করা। না হলে এটি দেশের জন্য সুখবর বয়ে আনবে না।

বিইউ/জেএম/এএস