মুহা. তারিক আবেদীন ইমন
২৯ অক্টোবর ২০২২, ১০:৩৫ এএম
করোনা প্রাদুর্ভাবের পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বজুড়ে অস্থিরতা বিরাজ করছে। এর প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও। সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে দেশে। এমন পরিস্থিতিতে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের আয়ে ভাটা পড়ায় সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। পরিবার নিয়ে যেখানে স্বাচ্ছন্দে চলাফেরা যেখানে দায় সেখানে ভুতুড়ে বিদ্যুৎ বিল মানুষের কপালে নতুন করে দুশ্চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে। বিদ্যুৎ বিলের এই অনিয়ম নিয়ে ক্ষোভ ঝাড়ছেন বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ। তাদের সবার প্রশ্ন কবে নাগাদ মুক্তি মিল বিদ্যুতের এমন বিল থেকে।
ভুক্তভোগীরা জানান, লোডশেডিংয়ের কারণে প্রতিদিন চার-পাঁচ ঘণ্টা বিদ্যুৎ কম ব্যবহার হয়। কিন্তু বিদ্যুৎ বিল আসের মতোই আসছে। কারও কারও বিল দুইগুণ আবার কারও তিনগুণ বিল আসছে। এ নিয়ে গ্রাহকরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।
আরও পড়ুন: ৩০ বছর বন্ধ ছাত্রাবাস, বিদ্যুৎ বিল বকেয়া ৫ লাখ!
রাজধানীর মগবাজার এলাকার বাসিন্দা আকবর আলী ঢাকা মেইলকে বলেন ‘আমার নিয়মিত দুই-আড়াই হাজার টাকা বিদ্যুৎ বিল আসে। তিন হাজার টাকার বেশি বিল কখনোই আসেনি। গত সেপ্টেম্বর মাসে হঠাৎ বিদ্যুৎ বিল আসছে ছয় হাজার সাতশ টাকা। অথচ আমি অতিরিক্ত কোনো কিছু ব্যবহার করিনি। বরং লোডশেডিংয়ের কারণে কম বিদ্যুৎ বিল আসার কথা। কী কারণে এমনটা হচ্ছে বুঝতে পারছি না।’
একই ধরনের অভিযোগ করলেন মগবাজার এলাকার বাসিন্দা মইনুদ্দিন খান। তার দাবি দুই-আড়াই হাজার টাকার বিল পাঁচ হাজার তিনশত টাকা আসছে।
শুধু আকবর কিংবা মইনুদ্দিন খান নন, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার অনেকেই এই ধরনের অভিযোগ করেছেন। আবার অনেকে বলছেন, প্রতিদিন ৪-৫ ঘণ্টা বিদ্যুৎ কম ব্যবহার করেও আগের মতোই বিদ্যুৎ বিল কীভাবে আসছে।
রাজধানীর মুগদা এলাকার বাসিন্দা ডাবলু মিয়া বলেন, ‘আমার বাসায় তিন রুমে তিনটা ফ্যান ও তিনটা বাতি চালাই। গরম শুরুর পর থেকে প্রায় সারাক্ষণই ফ্যান চলে। কয়েক মাস আগে যখন লোডশেডিং ছিল না তখন আমার নিয়মিত বিদ্যুৎ বিল আসত ১৬০০-১৭০০ টাকার মতো। লোডশেডিং শুরু হওয়ার পর থেকে প্রতিদিনই প্রায় ৪-৫ ঘণ্টার বিদ্যুৎ থাকছে না। তারপরেও আমার বিদ্যুৎ বিল একই রকম আসছে। বরং দু-একশ টাকা বেশি আসে। আগে যেভাবে চালাইছি এখন তো সে হিসাবে প্রতিদিন ৪-৫ ঘণ্টা কম চলেছে। তারপরেও বিদ্যুৎ বিল বেশি আসবে কেন? তারা কীভাবে বিদ্যুৎ বিল করে কিছুতেই হিসাব মেলাতে পারছি না।’
আরও পড়ুন: মানবশূন্য বাড়িতে ১০ লাখ ৮২ হাজার টাকা বিদ্যুৎ বিল!
অন্যদিকে প্রি-পেইডে যারা বিদ্যুৎ বিল দেন তাদেরও অনেকে আগের চেয়ে বেশি টাকা লাগার অভিযোগ করেন। ডিজিটাল মিটারের ভৌতিক বিল নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন গ্রাহকরা।
রাজধানীর আদাবর এলাকায় বাসিন্দা মর্জিনা বেগম বলেন, বেশ কিছুদিন আগে তাদের বিদ্যুতের বিল আসে ৩২ হাজার ২৯৯ টাকা। ডিপিডিসি মোহাম্মদপুর অফিসে অভিযোগ করলে পরের মাসে খানিকটা কমে বিল এসেছিল ২৭ হাজার টাকা। পরে একটি বেসরকারি টেলিভিশনে এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ হলে ভুতুড়ে বিলের কবল থেকে মুক্তি পান মর্জিনা।
টেলিভিশনের কল্যাণে মর্জিনা বেগমের রেহাই মিললেও রেহাই পাচ্ছেন না অনেকে। প্রিপেইড মিটারের আজগুবি বিল ভাবিয়ে তুলেছে নগরবাসীকে। অনেকে অভিযোগ করছেন, বিলের অতিরিক্ত টাকা সরকারি কোষাগারে যাচ্ছে না। মাঝ থেকে পকেট ভরছে লাইনম্যানসহ অন্যদের।
বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বৃদ্ধির কারণে চলতি বছরের ১৮ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে শিডিউল অনুযায়ী এলাকাভিত্তিক লোডশেডিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। তারপর থেকে যতই দিন যাচ্ছে সারাদেশেই বাড়ছে লোডশেডিং। রাজধানীতে কিছুদিন আগেও দিনে দু-একবার রুটিন করে লোডশেডিং হলেও এখন তার নির্দিষ্ট কোনো টাইম-টেবিল নাই।
২৪ ঘণ্টার মধ্যে রাজধানীর অনেক এলাকায় চার-পাঁচ ঘণ্টা করে লোডশেডিং হচ্ছে। অনেক এলাকায় গভীর রাতেও লোডশেডিংয়ের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। রাতে বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার পরে তীব্র গরমে ঘুমে ব্যাঘাত ঘটছে মানুষের। এতে চরম অস্বস্তিতে দিন কাটছে রাজধানীবাসীর।
রাজধানী ছাড়াও বিভিন্ন জেলা শহরেও লোডশেডিং বাড়ার খবর পাওয়া গেছে। গ্রামাঞ্চলের অবস্থা আরও শোচনীয়।
সারাদেশেই লোডিশেডিংয়ের যন্ত্রণায় যখন ক্ষোভে ফুঁসছে মানুষ ঠিক তখনই ভুতুড়ে বিদ্যুৎ বিল মানুষের মনে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও অনেকে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।
শাওন আহমেদ আরাফাত নামে একজন ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আচ্ছা আপনারা যে এক ঘণ্টা বিদ্যুৎ দিলে ৪ ঘণ্টা দেন না তাহলে গত মাসের বিলের টাকা থেকে পরের মাসের বিল বেশি হয় কেমনে? আর কতো দেশের মানুষকে লুটে খাবেন’।
মোহাম্মদ আলী নামে একজন লিখেছেন, ‘বিদ্যুৎ আগের থেকে ৫০-৬০ শতাংশ কম থাকার পরেও বিদ্যুৎ বিল কীভাবে আগের থেকে বেশি আসছে?’
রাজধানী ছাড়াও দেশের বিভিন্ন এলাকাতেও প্রতিনিয়তই বিদ্যুৎ বিল বেশি আসা, অস্বাভাবিক বিল কিংবা ভুতুড়ে বিলের খবর পাওয়া যাচ্ছে। অনেকেই এর থেকে পরিত্রাণের জন্য বিদ্যুৎ অফিসে দৌড়ঝাঁপ করছেন। তবে রাজধানীতে এই ধরনের সমস্যা একটু বেশি বলে জানা গেছে।
জানতে চাইলে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (ডিপিডিসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী বিকাশ দেওয়ানের সঙ্গে ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
ডিপিডিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা ইসতিয়াক আহমেদ বলেন, ‘এই বিষয়ে আমার জানা নাই। তাই এই বিষয়ে কথা বলতে পারব না।’
এমন অভিযোগ সরাসরি বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডে (পিডিবি) আসে না জানিয়ে প্রতিষ্ঠানটির উপপরিচালক শামিম আহমেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘অস্বাভাবিক বা ভুতুড়ে বিলের বিষয়ে আমাদের হেড অফিসে সরাসরি কোনো অভিযোগ আসে না। তাই এ সম্পর্কে আমরা কিছু বলতে পারছি না।’
আরও পড়ুন: ক্যাম্পে বিদ্যুৎ অপচয়ের হিড়িক, বিল যাচ্ছে বিহারি নেতাদের পকেটে
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) চেয়ারম্যান আবদুল জলিল ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘এমন অভিযোগ প্রাথমিকভাবে নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানিগুলোতে করা হয়। আমরা তো রেগুলেটরি অথরিটি। বিল যদি রিডিং বহির্ভূত বিল হয়, তাহলে গ্রাহক যারা বিল দিয়েছে তারা অথরিটির কাছে প্রথমে অভিযোগ জানাবে। অথবা তাদের সিস্টেমে চেক করবে যে কীভাবে বিলটা হলো। যদি দেখা যায় যে রিডিংবহির্ভূত তাহলে তারা এটার ব্যাপারে আপত্তি জানিয়ে নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের এমডির কাছে বলবে এবং মন্ত্রণালয়ে কপি দেবে। আর আদালতেও এই ভুতুড়ে বিল নিয়ে মামলা আছে। বিষয়টি সেখানেও নিয়ে যাওয়া যেতে পারে।’
বিষয়টি নিয়ে অনেকবার রেগুলেটরি কমিশন ও বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলোকে বলা হলেও তার কোনো সুরাহা হয়নি বলে দাবি করছেন নাগরিক সমাজের নেতারা।
সাধারণ নাগরিক সমাজের আহ্বায়ক মহিউদ্দিন আহমেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘এই ধরনের ঘটনা আগেও অনেক ঘটেছে। এখনো ঘটতে। আমি মনে করি তারা ইচ্ছকৃতভাবে এই কাজটা করে। এটা মাঝখানে বন্ধ করার জন্য আমরা বিইআরসিকে বলেছিলাম। বিদ্যুৎ বিতরণ প্রতিষ্ঠানগুলোকেও বলা হয়েছে। তাদের যুক্তি ছিল মিটার রিডাররা অনেক সময় দূর থেকে দেখে বিল লিখে আসে। আমাদের কথা তারা দূর থেকে দেখে লিখবে কেন? এখন তো সবগুলো মিটার দেখে লিখা যায়। সবথেকে বড় কারণটা হলো এরা অনেক সময় বিল সমন্বয় করতে পারে না। যে বিদ্যুতটা তারা ক্রয় করছে এবং বিতরণ করছে এবং সিস্টেম লস, সব মিলিয়ে তাদের তো হিসাব দিতে হয়। তখন এরা কিছু কিছু যায়গায় এরকম ওভারড্রাফ ফিল করে। কিছু কিছু এমন গ্রাহকের ঘাড়ে পড়ে তারা বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলোর কাছে যেতেও পারে না। সমাধানও করতে পারে না। প্রতিবাদও করতে পারে না। তাই বাধ্য হয়ে বিল দেয়। এতে সবদিক থেকেই মাইর খায় ভোক্তা।’
টিএই/এমআর