images

জাতীয়

সুলতানের সফর ঘিরে ব্রুনাই নিয়ে আগ্রহ, বাণিজ্যের নতুন সম্ভাবনা

নিজস্ব প্রতিবেদক

১৪ অক্টোবর ২০২২, ০৭:৪৩ পিএম

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ ব্রুনাইয়ের সুলতান হাজি হাসানাল বলকিয়াহ মুইজ্জাদ্দিন ওয়াদ্দৌলাহ আগামীকাল শনিবার (১৫ অক্টোবর) তিন দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে ঢাকায় আসছেন। সুলতানের সফর ঘিরে দেশটি সম্পর্কে নতুন করে আগ্রহ দেখা দিয়েছে জনসাধারণের মধ্যে। দেশটির জনসংখ্যা, আয়তন, মাথাপিছু আয় ও জীবনযাত্রা নিয়ে সবার মধ্যে ব্যাপক কৌতূহল লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তাঁর এই সফরে অন্তত তিনটি সমঝোতা স্মারক সই হওয়ার কথা রয়েছে। তেলসমৃদ্ধ দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যের নতুন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

ব্রুনাইয়ের রাষ্ট্রপ্রধান পর্যায়ে এটাই বাংলাদেশে প্রথম কোনো সফর। ব্রুনাই সুলতানের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দলে রাজপরিবারের একাধিক সদস্য, পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী এবং উচ্চপর্যায়ের সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তারা অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন। এই সফরটি গত ২০২০ সালের এপ্রিলে চূড়ান্ত করা হলেও করোনা মহামারির কারণে শেষ মুহূর্তে তা স্থগিত করা হয়।

ব্রুনাই সুলতানকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুতি নিয়েছে বাংলাদেশ। বিমানবন্দরে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ তাঁকে স্বাগত জানাবেন এবং সেখানে লালগালিচা সংবর্ধনা দেওয়া হবে। সফরের তিন দিন ব্রুনাই সুলতান ব্যস্ত সময় পার করবেন।

আয়তনে ছোট হলেও মাথাপিছু আয় ও জীবনমানে এগিয়ে ব্রুনাই

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ ব্রুনাই আয়তনে তেমন বড় নয। দক্ষিণ চীন সাগরের সাথে লাগোয়া মালয়েশিয়ার পূর্বে অবস্থিত এই দেশটির আয়তন পাঁচ হাজার ৬৭৫ বর্গকিলোমিটার আর জনসংখ্যা সাড়ে চার লাখেরও কম। জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৮৩ জন। তবে আয়তনে ছোট হলেও মাথাপিছু আয় ও জীবনযাত্রার মানের বিচারে তাদের অবস্থান বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে।

brunai2

জাতিসংঘের ২০২০ সালের হিসাব অনুযায়ী ব্রুনাইয়ের মাথাপিছু আয় ২৭ হাজার ৪৩৭ ডলার, যা এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ষষ্ঠ ও বিশ্বে ৩০তম।

ব্রুনাইয়ের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সিংহভাগ অবদান তাদের তেল ও গ্যাসসংশ্লিষ্ট শিল্পের। দেশটির মোট রফতানি আয়ের ৯৫ ভাগের বেশি অংশই আসে জ্বালানি তেল ও গ্যাস রফতানির মাধ্যমে।

ব্রুনাই ১৮৮৮ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে আসে। ১৮৯৯ সালে রাজধানী ব্রুনাই টাউনের কাছে প্রথম তেলক্ষেত্র আবিষ্কার হয় সেখানে। পরবর্তী সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে তেলের মজুদ আবিষ্কার হয় এবং ১৯৩২ সালে তেল রফতানি শুরু করে দেশটি।

আরও পড়ুন: কাল আসছেন ব্রুনাইয়ের সুলতান, বিমানবন্দরে লালগালিচা সংবর্ধনা

ব্রুনাই ২০১৬ সালে তেল উৎপাদনকারী দেশের জোট ওপেক প্লাসে যুক্ত হয়। ব্রুনাইয়ের শীর্ষ তেল উৎপাদক সংস্থা ব্রুনাই শেল পেট্রোলিয়াম দেশটির ৯০ শতাংশের বেশি তেল উৎপাদন করে থাকে। ব্রুনাই সরকার ও রয়্যাল ডাচ গ্রুপ অব কোম্পানিজের যৌথ উদ্যোগে এই সংস্থাটি পরিচালিত হয়।

দেশটির মজুদে তেল রয়েছে ১১০ কোটি ব্যারেল, যা বিশ্বের মোট জ্বালানি তেলের মজুদের প্রায় ০.৭%। দেশটি প্রতি বছরে যে পরিমাণ তেল ব্যবহার করে, তার ১৮৮ গুণ তেল তাদের মজুদে রয়েছে। অর্থাৎ তেল রফতানি বন্ধ করে দিলে মজুদে থাকা তেল দিয়ে (বর্তমান হিসাব অনুযায়ী) দেশটি ১৮৮ বছর চলতে পারবে।

ব্রুনাই সুলতান সম্পর্কে যা জানা যাচ্ছে

১৯৬৭ সালে তার বাবা স্যার হাজি ওমর আলী সাইফুদ্দিন সিংহাসন ত্যাগ করার পর ১৯৬৮ সালের আগস্টে হাসানাল বলকিয়াহ ব্রুনাইয়ের সুলতান হিসেবে রাজমুকুট পরিধান করেন। বিশ্বজুড়ে সর্বশেষ টিকে থাকা পূর্ণাঙ্গ রাজতন্ত্রগুলোর একটি এটি। ১৯৬৮ সাল থেকে তাঁর হাতেই সব নির্বাহী ক্ষমতা। তিনি একাধারে প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা এবং অর্থমন্ত্রী।

১৯৪৬ সালে জন্মগ্রহণ করা হাসানাল বলকিয়াহ মালয়েশিয়া এবং ইংল্যান্ডে পড়াশোনা করেছেন। তিনি ব্রিটিশ রয়্যাল এয়ারফোর্সে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একজন পাইলট। দীর্ঘদিন ধরে দেশ শাসন করলেও প্রজাদের কাছে তিনি বেশ জনপ্রিয়। তেল ও গ্যাসের বিপুল মজুদের কল্যাণে ছোট্ট একটি দেশ ব্রুনাইয়ের জনগণের জীবনযাত্রার মান বিশ্বের অন্যতম শীর্ষস্থানীয়।

brunai3

এ দেশের মানুষকে কোন আয়কর দিতে হয় না সরকারকে। বরং বিভিন্ন সরকারি স্কিম বা কর্মসূচির অধীনে সুলতান নিয়মিত জনগণের মধ্যে জমি এবং বাড়িঘর বিতরণ করে থাকেন। এসব কারণে ব্রুনাইয়ের জনগণের কাছে সুলতান বেশ জনপ্রিয়।

তবে সুলতান হাসানাল বলকিয়াহ তাঁর বিলাসবহুল জীবনযাত্রার জন্যও বেশ আলোচিত। এক সময় তিনি ছিলেন বিশ্বের শীর্ষ ধনী এবং এখন তার সম্পদের পরিমাণ প্রায় তিন হাজার কোটি মার্কিন ডলার। ৬০০ বছরের বেশি পুরনো রাজবংশের উত্তরাধিকারী সুলতান হাসানাল বলকিয়াহ উত্তরাধিকার সূত্রেই বিপুল সম্পত্তির মালিক হয়েছেন।

সুলতানের দুইজন স্ত্রী এবং ১১ জন সন্তান। বিশাল প্রাসাদ, বিভিন্ন দেশে পাঁচ-তারা হোটেল, সোনায় মোড়ানো রোলস্‌রয়েস, হাজারো গাড়ির বহর, সোনার প্রলেপ দেয়া বোয়িং, মহামূল্য চিত্রকর্মের বিশাল সংগ্রহ, পোলো খেলা- হাসানাল বলকিয়াহর পরিচয়ের সাথে এসব বিষয় যেন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।

ব্রুনাইয়ের দারুসসালামে অবস্থিত সুলতানের প্রাসাদ ইস্তানা নুরুল ইমান আকারে ভ্যাটিকান বা বাকিংহাম প্রাসাদের চাইতে অনেকগুণ বড়। গিনেস বুক অব রেকর্ডস অনুযায়ী এটি বিশ্বের সবচাইতে বড় প্রাসাদ। এই প্রাসাদে কক্ষের সংখ্যা ১৭০০।

আরও পড়ুন: ব্রুনাইসহ তিন দেশ থেকে জ্বালানি তেল আমদানির চিন্তা

হাসানাল বলকিয়াহর রয়েছে এক বিশাল গাড়ির বহর। বলা হয়ে থাকে তার বহরে সাত হাজারের মতো গাড়ি আছে, যার মোট মূল্য ৫০০ কোটি মার্কিন ডলার। তার গ্যারেজের সংখ্যা ১১০টি।

বহরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বাহন তার সোনায় মোড়ানো রাজকীয় রোলস্‌রয়েস। বিশেষ ডিজাইনের রোলস্‌রয়েসের ছাদ খোলা এবং পেছনে ছাতা সংযুক্ত করা। এতে চেপে তিনি নিজে যেমন শহর পরিভ্রমণ করেন, তেমনি রাজপরিবারের সদস্যদের বিয়েশাদীর অনুষ্ঠানের পর প্রথা অনুযায়ী প্রজাদের দর্শন দিতেও ব্যবহার হয় এই গাড়ি। এটি ছাড়াও মোট ৬০০টির মত রোলস্‌রয়েস গাড়ির মালিক সুলতান।

ব্রুনাইয়ের সঙ্গে বাণিজ্যের নতুন সম্ভাবনা

ব্রুনাই সুলতানের এই সফরে দেশটির সঙ্গে বাণিজ্যের নতুন সম্ভাবনা দেখছে বাংলাদেশ। আগামী রোববার (১৬ অক্টোবর) দুপুরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন সুলতান এবং দুইপক্ষের মধ্যে প্রতিনিধি পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। বৈঠকের পর দুইপক্ষের মধ্যে তিনটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকসমূহ স্বাক্ষর করার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এগুলো হচ্ছে— দ্বি-পাক্ষিক বিমান চলাচল চুক্তি, বাংলাদেশি জনশক্তি নিয়োগ সহযোগিতা বিষয়ক সমঝোতা স্মারক এবং দুই দেশ কর্তৃক নাবিকদের সার্টিফিকেটের স্বীকৃতি সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক সই। শেষ পর্যন্ত সুলতানের ইচ্ছায় দুইপক্ষের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সইয়ের সংখ্যা বাড়তে পারে বলে কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে।

brunai4

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বলেন, বিগত এক দশকে ব্রুনাইয়ের সাথে বাণিজ্য, বিনিয়োগ, জ্বালানি, কৃষি, মানবসম্পদ উন্নয়নসহ নানাবিধ ক্ষেত্রে সহযোগিতা সম্প্রসারিত হচ্ছে। ব্রুনাই তাদের ‘ভিশন ২০৩৫’-এর আওতায় নেওয়া উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে অর্থনীতির বহুমুখীকরণ, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, মানবসম্পদ উন্নয়ন, অবকাঠামো নির্মাণ, স্বাস্থ্যসেবা ও জ্বালানি ইত্যাদি খাতে পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়াতে আগ্রহী। জ্বালানি সম্পদে সমৃদ্ধ উচ্চ আয়ের দেশ ব্রুনাইয়ের সাথে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা স্থাপনের মধ্যে দিয়ে দেই দেশই লাভবান হতে পারে।

মন্ত্রী বলেন, সন্ত্রাসবাদ ও চরমপন্থা, মাদক ও মানব পাচার, পরিবেশ সংরক্ষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন, দারিদ্র্য দূরীকরণ, টেকসই উন্নয়নসহ বিভিন্ন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে বাংলাদেশ ও ব্রুনাই এক ও অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে থাকে এবং জাতিসংঘ, কমনওয়েলথসহ বিভিন্ন আঞ্চলিক ও বহুপাক্ষিক ফোরামে পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজ করে যাচ্ছে। রোহিঙ্গা সমস্যাসহ বিভিন্ন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রী এবং সুলতানের মধ্যে অধিকতর মতবিনিময়ের সুযোগ সৃষ্টি হবে।

ব্রুনাইয়ের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক আশির দশকে শুরু হলেও ২০১০ সালের আগ পর্যন্ত দুই দেশের মধ্যে পণ্য আমদানি-রফতানির হার ছিল খুবই সামান্য এবং অনিয়মিত।

রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮৪-৮৫ সালে বাংলাদেশ থেকে প্রথমবার ব্রুনাইয়ে বাংলাদেশের পণ্য রফতানি শুরু হয়। এরপর ২০১২-১৩ পর্যন্ত প্রায় প্রতিবছরই ব্রুনাইয়ে পণ্য রফতানি হলেও অর্থের পরিমাণের হিসাবে সেই সংখ্যাটা ছিল খুবই কম।

২০১৩ সাল থেকে ব্রুনেইয়ে নিয়মিত পণ্য রফতানি শুরু করে বাংলাদেশ, যার পরিমাণ দ্বিগুণের ও বেশি বৃদ্ধি পায় ২০১৮ সালে এসে। শুরুর দিকে ব্রুনাইয়ে সিরিয়াল, চাসহ আরও কিছু পণ্য রফতানি করতো বাংলাদেশ। তবে বর্তমানে এগুলো ছাড়াও কল-কারখানার যন্ত্রপাতি, খাদ্যপণ্য, লবণ, কাগজ, বৈদ্যুতিক পণ্যসহ নানা ধরনের পণ্য রফতানি করা হয়।

জেবি