আব্দুল কাইয়ুম
১৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৫:২৪ পিএম
ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরীফ ওসমান হাদিকে গুলি করে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেল নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। হাদিকে গুলি করা মোটরসাইকেলের মালিক আসলে কে, কোনো যাচাই-বাছাই ছাড়াই কেন গ্রেফতার করা হয়েছে কথিত এই মোটরসাইকেল মালিক হান্নানকে—এমন নানা প্রশ্ন নতুন করে দেখা দিয়েছে। কারণ, অনুসন্ধান বলছে, হাদিকে গুলি করার সময় যে মোটরসাইকেলটি ব্যবহার করা হয়েছে, সেই মোটরসাইকেল আর গ্রেফতার হওয়া মোটরসাইকেলের মালিক ভিন্ন ব্যক্তি। গুলির ঘটনায় পরিস্থিতি সামলাতে তাড়াহুড়া করে এমন কাণ্ড ঘটানো হয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে কথা বলে নানা উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে ঢাকা মেইল।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দাবি, হাদিকে গুলি করে হত্যাচেষ্টায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটি সিসিটিভি ফুটেজ দেখে শনাক্ত করা হয়। শনাক্তের পর মোটরসাইকেলের মালিক আব্দুল হান্নানকে গ্রেফতার করে র্যাব। গ্রেফতারের পর তাকে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। থানা পুলিশ তাকে গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে প্রেরণ করে এবং তথ্য উদ্ধারের জন্য রিমান্ডের আবেদন করলে আদালত তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। তবে, পুলিশ আব্দুল হান্নানকে রিমান্ডে নিয়ে এলে বেরিয়ে আসে ভিন্ন তথ্য।
দেখা যায়, হামলায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেলের নম্বর শনাক্তে ভুল করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। শুধু নম্বর শনাক্তেই নয়, হামলায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেল এবং গ্রেফতার হওয়া হান্নানের মোটরসাইকেলের মডেলও একেবারে ভিন্ন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১২ ডিসেম্বর রাজধানীর বিজয়নগর কালভার্ট রোডে হাদির ওপর হামলার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সেই সিসিটিভি ফুটেজের সূত্র ধরে মোটরসাইকেল শনাক্ত শুরু করেন। যে মোটরসাইকেলটির নম্বরপ্লেটে ইংরেজি অক্ষরে লেখা ছিল—ঢাকা মেট্রো-ল ৫৪-৬৩৭৬। এ নম্বরের সূত্র ধরে মালিককে খোঁজা শুরু হয়। একপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দাবি করে, ওসমান হাদিকে গুলি করার সময় ঘাতক ফয়সালকে বহন করা মোটরসাইকেলটি শনাক্ত করে এর মালিক আব্দুল হান্নানকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ ঘটনায় আব্দুল হান্নানকে ১২ ডিসেম্বর রাতে গ্রেফতার করে পরদিন আদালতে পাঠায় পল্টন থানা পুলিশ। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা রিমান্ডের আবেদন করলে আদালত তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
এদিকে, যাচাই-বাছাই শেষে দেখা যায়, গ্রেফতার হওয়া মোটরসাইকেল মালিক হান্নানের মোটরসাইকেলের নম্বর ঢাকা মেট্রো-ল ৫৪-৬৩৭৫, যা একটি সুজুকি ব্র্যান্ডের জিক্সার মোটরসাইকেল। অপরাধে ব্যবহৃত মোটরসাইকেলের নম্বরের সঙ্গে একটি সংখ্যার ভুল রয়েছে। যে নম্বরের শেষে ৬ থাকার কথা, সেখানে ৫ শনাক্ত করা হয়েছে।
এ ছাড়া, ১২ ডিসেম্বর ওসমান হাদিকে গুলি করার ঘটনায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেলের ডিজিটাল নম্বরপ্লেটে ইংরেজি অক্ষর দেখা যায়। তবে বিদেশি অক্ষরে নম্বরপ্লেট ব্যবহার নিয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) বলছে, কোনো গাড়িতে বিদেশি অক্ষরে ডিজিটাল নম্বরপ্লেট দেওয়া হয় না। তাই কোনো গাড়িতে বিদেশি অক্ষরের ডিজিটাল নম্বরপ্লেট ব্যবহারের সুযোগ নেই।
এ বিষয়ে বিআরটিএর ইঞ্জিনিয়ারিং উইংয়ের পরিচালক মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ ঢাকা মেইলকে বলেন, আমরা গাড়ির রেজিস্ট্রেশন শেষে যে ডিজিটাল নম্বরপ্লেট দিয়ে থাকি, তা পুরোপুরি বাংলায়। বাংলা অক্ষরের বাইরে ডিজিটাল নম্বরপ্লেট দেওয়ার সুযোগ নেই। কেউ ব্যবহার করলে তা বেআইনি।
গ্রেফতার আব্দুল হান্নানের গাড়ির নম্বর কত:
ঢাকা মেইলের হাতে আসা ঢাকা মেট্রো-ল ৫৪-৬৩৭৫ নম্বরের রেজিস্ট্রেশন কাগজে দেখা যায়, এটি একটি মোটরসাইকেল। বিআরটিএর তথ্য অনুযায়ী, গাড়িটি সিলভার ও অরেঞ্জ রঙের সুজুকি ব্র্যান্ডের জিক্সার মডেলের। গাড়িটির মালিক আব্দুল হান্নান। তবে আদালতে দেওয়া হান্নানের জবানবন্দিতে তিনি বলেন, তিনি একটি শোরুমে মোটরসাইকেল বিক্রি করেছিলেন। সে সূত্র ধরে হান্নানের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়।
হান্নানের পরিবারের এক সদস্য ঢাকা মেইলকে জানান, হান্নান মিরপুরের রেসার নামের একটি শোরুমে এ বছরের শুরুতে একটি মোটরসাইকেল বিক্রি করেছিলেন। তবে সেটি ছিল ইয়ামাহা ব্র্যান্ডের এফজেডএস মডেলের, যার নম্বর ঢাকা মেট্রো-ল ৬৫-৩৫৮৪।
বিষয়টি নিশ্চিত করে রেসার শোরুমের মালিক আতাউল্লাহ সোহাগ বলেন, এ বছরের শুরুতে আব্দুল হান্নান একটি মোটরসাইকেল আমার কাছে বিক্রি করেন। সেটি ইয়ামাহা ব্র্যান্ডের এফজেডএস মডেলের। গাড়িটির নম্বর ঢাকা মেট্রো-ল ৬৫-৩৫৮৪। গাড়ি কেনার সময় সব ডকুমেন্ট রেখে আমি গাড়িটি কিনেছি।
এদিকে, ঢাকা মেট্রো-ল ৫৪-৬৩৭৬ নম্বরের সূত্র ধরে ওই গাড়ির মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। বিআরটিএর রেজিস্ট্রেশন তথ্য অনুযায়ী, গাড়িটি নীল-সিলভার রঙের ইয়ামাহা ব্র্যান্ডের জিক্সার মডেলের। গাড়িটির মালিক একজন ব্যবসায়ী। তিনি জানান, তিনি গাড়িটি দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার করছেন এবং এটি দিয়ে গ্রামে যাতায়াত করেন। তবে অনেকদিন ধরে গাড়িটি গ্রামেই রয়েছে।
তিনি আরও জানান, কয়েক দিন আগে গোয়েন্দা বিভাগের একজন তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। তখন বলা হয়, তাঁর গাড়ির নম্বরটি একটি চোরচক্রের গাড়ির নম্বরের সঙ্গে কিছুটা মিল রয়েছে এবং বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে।
তবে ঢাকা মেট্রো-ল ৫৪-৬৩৭৫ কিংবা ঢাকা মেট্রো-ল ৫৪-৬৩৭৬ নম্বরের কোনো গাড়ির সঙ্গেই ১২ ডিসেম্বর ওসমান হাদিকে গুলি করে হত্যাচেষ্টায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেলের মডেল বা রঙের মিল নেই। গুলির সময় ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটি ছিল হোন্ডা ব্র্যান্ডের হর্নেট মডেলের, অরেঞ্জ ও কালো রঙের। এ ছাড়া গাড়িটির পেছনে ইংরেজি অক্ষরে নম্বরপ্লেট লেখা ছিল, যা গ্রেফতার হওয়া মালিকের গাড়ির সঙ্গে মেলে না।
আরও পড়ুন: হাদির সবশেষ অবস্থা জানাল ইনকিলাব মঞ্চ
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, মূলত মোটরসাইকেলের মালিকানা খুঁজে পাওয়ার পর মোহাম্মদপুর চন্দ্রিমা হাউজিং থেকে শনিবার (১৩ ডিসেম্বর) রাতে আব্দুল হান্নানকে আটক করা হয়। পরে র্যাব তাকে পল্টন থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে। আদালতে হাজির করে পুলিশের আবেদনের প্রেক্ষিতে তাকে তিন দিনের রিমান্ডে পাঠানো হয়।
রিমান্ডে আনার পর পরিবার তার সঙ্গে কথা বলে জানতে পারে, হাদিকে গুলি করে হত্যাচেষ্টায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটি হান্নানের শোরুমে বিক্রি করা মোটরসাইকেল নয়। বিষয়টি নিয়ে তদন্তকারী কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বললে ধোঁয়াশা তৈরি হয়।
এমন বিভ্রান্তির পর তদন্তকারী কর্মকর্তা শোরুম মালিক আতাউল্লাহ সোহাগকে হান্নানের সঙ্গে সরাসরি কথা বলার সুযোগ দিলে জানা যায়, ঢাকা মেট্রো-ল ৫৪-৬৩৭৫ নম্বরের সুজুকি জিক্সার মোটরসাইকেলটি হান্নান ২০২৪ সালের জুনে মোহাম্মদপুরের আরেক ব্যক্তির কাছে বিক্রি করেছিলেন।
ওই ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করলে তথ্যের সত্যতা পাওয়া যায়। দুটি মোটরসাইকেল ব্যবহারের পর বিক্রি করা হলেও মালিকানা পরিবর্তন না করায় জিক্সার ও এফজেডএস—দুটি মোটরসাইকেলই হান্নানের নামেই থেকে যায়।
এসব বিষয়ে পল্টন থানার তদন্ত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক সামিম হাসান আদালতকে লিখিতভাবে জানান, গুলির ঘটনায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটি গ্রেফতার হওয়া হান্নানের মোটরসাইকেল নয়। তিনি বলেন, ওসমান হাদির ওপর গুলি করার সময় ব্যবহৃত মোটরসাইকেল এবং মোহাম্মদপুর থেকে উদ্ধার করা মোটরসাইকেলের মধ্যে কোনো মিল নেই। দুটি ভিন্ন ব্র্যান্ডের ভিন্ন মডেলের মোটরসাইকেল। বিষয়টি আদালতকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে।
এ বিষয়ে র্যাব-২–এর সহকারী পরিচালক (মিডিয়া) শামসুল ইসলাম ঢাকা মেইলকে বলেন, বিষয়টি আমাদের হেডকোয়ার্টার থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। তবে এ বিষয়ে র্যাব হেডকোয়ার্টারের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
একেএস/এআর