images

জাতীয়

পরীক্ষা-আবহাওয়া-নিরাপত্তা সবদিক সামলে ভোটের সর্বোচ্চ প্রস্তুতি ইসির

মো. মেহেদী হাসান হাসিব

১৬ নভেম্বর ২০২৫, ১২:৪৯ পিএম

ডিসেম্বরের শুরুতেই তফসিল ঘোষণা করে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন আয়োজনের পরিকল্পনা নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এবার জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে আয়োজন হওয়ার কারণে প্রস্তুতি ও সমন্বয় আগের সব নির্বাচনের তুলনায় জটিল হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট মহল।

ইসির দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, কুয়াশা, তাপমাত্রা কমে যাওয়া বা শৈত্যপ্রবাহ ভোটগ্রহণ ধীর করতে পারে। দিন ছোট হয়ে যাওয়ায় গণনা শেষ করতেও বেশি সময় লাগতে পারে। এর পাশাপাশি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের বার্ষিক পরীক্ষা, বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষার সময়সূচি এবং সম্ভাব্য আবহাওয়া মাথায় রেখে ভোটের দিন নির্ধারণ করা হবে।

ভোট স্বচ্ছ, সুষ্ঠু ও নিরাপদ করতে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার, কেন্দ্রের আশপাশের সিসিটিভি ব্যবহার, বিতর্কিত কর্মকর্তাদের দায়িত্ব থেকে মুক্তি এবং মাঠে মেডিকেল ও ফায়ার সার্ভিস রাখার মতো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে ইসি সূত্রে জানা গেছে।

সম্প্রতি নির্বাচন ভবনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দীনের সভাপতিত্বে সরকারের ৩১টি মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন বিভাগের প্রধানদের নিয়ে অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় সভার কার্যবিবরণী থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।

সভায় জানানো হয়-পরীক্ষার সূচি, শিক্ষার্থীদের যাতায়াত, সম্ভাব্য আবহাওয়া পরিস্থিতি এবং প্রশাসনিক কার্যক্রম যাতে পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষে না আসে, সেজন্য বিস্তারিত পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকায় বিশেষ নজর

সভায় সংখ্যালঘু ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। সম্ভাব্য নাশকতা ঠেকাতে এসব এলাকায় বাড়তি টহল, সিসিটিভি নজরদারি ও গোয়েন্দা কার্যক্রম বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের যেকোনো চেষ্টা কঠোরভাবে দমন করা হবে বলেও সভায় জানায় নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে থাকা সংস্থাটি।

কেন্দ্রের আশপাশের সিসিটিভিও ব্যবহৃত হবে

ইসি জানিয়েছে, এবার ভোট পর্যবেক্ষণে কেন্দ্রের অভ্যন্তরে স্থাপন করা সিসিটিভি ক্যামেরার পাশাপাশি ভোটকেন্দ্রের আশপাশে থাকা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা ভবনের বিদ্যমান ক্যামেরাও ব্যবহার করা হবে। এতে করে কেন্দ্রের বাইরে ঘটে যাওয়া সম্ভাব্য কোনো অনিয়ম বা অপ্রীতিকর ঘটনার ফুটেজও সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে।

ecএ ছাড়া নির্বাচনি প্রচারের কিছু অংশ সংসদ টিভির মাধ্যমে প্রচারের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হবে, তাদের আশপাশের সড়ক উন্নয়ন বা সংস্কারের জন্য সংশ্লিষ্ট দফতরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

দায়িত্বে থাকবেন না বিতর্কিত কর্মকর্তারা

গত তিন জাতীয় নির্বাচনে যেসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পক্ষপাত বা বিতর্কিত ভূমিকার অভিযোগ ছিল তাদের এবার দায়িত্ব দেওয়া হবে না বলে সভায় সিদ্ধান্ত হয়। তবে ঢালাওভাবে সবাইকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। যাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা বা নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার মতো অভিযোগ আছে, কেবল তাদেরই দায়িত্বের বাইরে রাখা হবে। এ ছাড়া দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং বিশেষ করে বিদেশি পর্যবেক্ষকদের ভিসা, বিমানবন্দরে সহায়তা দেওয়াসহ সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি সহজ করতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

ঋণখেলাপি শনাক্তে এনআইডি অ্যাক্সেস চায় বাংলাদেশ ব্যাংক

ঋণখেলাপি শনাক্ত করতে ইসির এনআইডি সার্ভারে অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের অ্যাক্সেস প্রয়োজন বলে সভায় জানায় বাংলাদেশ ব্যাংক। তথ্য যাচাই নিশ্চিত করতে মনোনয়নপত্র দাখিল ও বাছাইয়ের মাঝে পাঁচ দিনের ব্যবধান রাখার প্রস্তাবও এসেছে।

সভায় জানানো হয়, যার নাম সিআইবি তালিকায় থাকবে, তিনি ঋণখেলাপি হিসেবে গণ্য হবেন। বাছাইপর্ব ও আপিল শুনানিতে সিআইবির প্রতিনিধিকে উপস্থিত রাখার সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছে।

থাকবে মেডিকেল টিম, ফায়ার সার্ভিস

ভোটের দিন প্রতিটি কেন্দ্রের কাছে জরুরি মেডিকেল টিম প্রস্তুত রাখা হবে। বিশেষ করে বৃদ্ধ ভোটার, অসুস্থ ব্যক্তি বা ভিড়ের কারণে দুর্ঘটনা-সংক্রান্ত পরিস্থিতিতে দ্রুত সেবা দিতে অ্যাম্বুলেন্সসহ চিকিৎসা সরঞ্জাম প্রস্তুত থাকবে। এছাড়া অগ্নিকাণ্ড, বজ্রপাত, ভূমিকম্পসহ যেকোনো ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলায় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের আলাদা দলও সার্বক্ষণিক প্রস্তুত থাকবে।

ভোটের দিনসহ পাঁচ দিন মোটরসাইকেল চলাচল বন্ধ

সহিংসতা বা উসকানির ঝুঁকি এড়াতে নির্বাচনের দিনসহ মোট পাঁচ দিন মোটরসাইকেল চলাচল নিষিদ্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। প্রয়োজন হলে কিছু যানবাহন ও নৌ-চলাচলও নিয়ন্ত্রণ করা হবে।

তফসিলের আগে সব প্রচারসামগ্রী অপসারণের নির্দেশ

সম্ভাব্য প্রার্থীদের ব্যবহৃত পোস্টার, ব্যানার, গেট, তোরণ, বিলবোর্ড, প্যান্ডেলসহ সব প্রচারসামগ্রী তফসিল ঘোষণার আগেই অপসারণ করতে স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছে সংস্থাটি।

সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে স্থিতি ভালো থাকবে না: সিইসি

আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দীন বলেন, ‘সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন না হলে দেশের সামগ্রিক স্থিতি ভালো থাকবে না। অতীতের বিতর্কিত নির্বাচনের কালিমা মুছে ফেলার এটিই গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ, যা হাতছাড়া করা যাবে না।’

তিনি আরও বলেন, জাতীয় নির্বাচন আয়োজন একটি বিশাল কর্মযজ্ঞ। এটি নির্বাচন কমিশনের একার পক্ষে সম্ভব নয়, সব মন্ত্রণালয় ও সংস্থার সমন্বয় জরুরি।’

cec
প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ কে এম নাসির উদ্দীন।

নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলেন, নির্বাচনসংশ্লিষ্ট আইন-বিধি সম্পর্কে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সম্যক ধারণা থাকতে হবে। সমন্বয়ের জন্য তার নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে, এবং প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে ফোকাল পয়েন্ট কর্মকর্তা রাখার প্রয়োজনীয়তার কথাও তিনি তুলে ধরেন।

মাঠ প্রশাসনকে কঠোর নির্দেশ

প্রাক-নির্বাচনি ও ভোট-পরবর্তী কার্যক্রম নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করতে মাঠ প্রশাসনকে নির্বাচনি মালামাল পরিবহন, সংরক্ষণ, টানা-ছেঁড়া ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। রিটার্নিং অফিস, নির্বাচন অফিস, সরঞ্জাম, বিদ্যুৎ যোগাযোগ ব্যাংকিং সেবা নির্বিঘ্ন রাখা এবং অভিযোগ এলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ারও সিদ্ধান্ত হয়। মনোনয়ন দাখিল, বাছাই, প্রার্থিতা প্রত্যাহারসহ নির্বাচনি সব ধাপ যথাযথভাবে সম্পন্ন করারও নির্দেশ দেওয়া হয়।

মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নির্বাচনি দায়িত্বে কোনো অভিযোগ এলে তদন্ত করে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ারও সিদ্ধান্ত হয়। ভোট শেষে দ্রুত গণনা করে ফলাফল বিবরণী ও ব্যবহৃত দ্রব্যাদি সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে পৌঁছে দিতে হবে।

সব মিলিয়ে পরীক্ষা, আবহাওয়া, নিরাপত্তা, প্রযুক্তি ও প্রশাসনিক সমন্বয় সবকিছু বিবেচনায় রেখে স্বচ্ছ, গ্রহণযোগ্য ও আন্তর্জাতিকভাবে মানসম্মত নির্বাচন আয়োজনের সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন।

এমএইচএইচ/এমআর