images

জাতীয়

অতীতের ভোটারবিহীন নির্বাচন থেকে আস্থা ফেরানোই বড় চ্যালেঞ্জ ইসির

নিজস্ব প্রতিবেদক

০৬ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:৩৩ পিএম

বিগত তিনটি ভোটে ভোটারবিহীন নির্বাচনের অভিজ্ঞতায় মানুষের মধ্যে যে আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে, তা কাটানোই এখন নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন গণমাধ্যম প্রতিনিধিরা। তারা বলছেন, ইসিকে আইন প্রয়োগে আরও কঠোর হতে হবে, প্রশাসনের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং গণমাধ্যমকে সহযোগী হিসেবে নিয়ে কাজ করতে হবে। তা না হলে ভোটের মাঠে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা কঠিন হবে।

সোমবার (৬ অক্টোবর) নির্বাচন ভবনের সম্মেলনে কক্ষে আয়োজিত এক সংলাপে প্রিন্ট ও অনলাইন মিডিয়ার প্রতিনিধিরা এমন মন্তব্য করেন। 

কালের কণ্ঠের সম্পাদক ও জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি কবি হাসান হাফিজ বলেন, আমি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব করতে চাই যে, প্রত্যেকটা নির্বাচনী এলাকায় আমরা যদি একটা কমিটি করি একদম ফলাফল ঘোষণা পর্যন্ত। রাজনৈতিক নেতাকর্মী বাদ দিয়ে সামাজিক শক্তি যারা আছে পেশাজীবি, ধরেন, একটা এলাকার গণ্যমান্য শিক্ষক যারা সবাই মুরুব্বি। যারা রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত নয়। পেশাজীবি, ব্যবসায়ী ও তরুণদের নিয়ে একটা যদি আমরা কমিটি করি। সেই কমিটি নজরদারি করবে এবং সবকিছুর নজরদারি করবে। সবাইকে যদি এটার সঙ্গে যুক্ত করতে পারেন তাহলে এটা একটা বড় জিনিস হতে পারে।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম-এর সম্পাদক তৌহিদুল ইসলাম মিন্টু এসব কথা বলেন, রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে নির্বাচনটা কিভাবে হবে। রাজনৈতিক ক্ষমতা-ই ইসির ক্ষমতাকে নির্ধারণ করে। গত তিন টার্মে সেটাই হয়েছে। যে কারণে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি বা করতে পারেনি।

তিনি আরো বলেন, এই সরকারের বা নির্বাচন কমিশনের সুযোগটা রয়েছে, যে তার ওপর কোনো অর্পিত দায়িত্ব নেই। যে সরকার ক্ষমতায় রয়েছে, তাদের আগামী নির্বাচন করার ইচ্ছা নেই বা ক্ষমতায় আসার ইচ্ছা নেই। তাই অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন করার ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের কোনো বাধা নেই। এখন যারা নির্বাচনে অংশীজন, তারা কিভাবে অংশ নেবে তার ওপর আগামী নির্বাচন নির্ভর করবে।

দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকার সম্পাদক আবু তাহের বলেন, নির্বাচনের মৌসুমে কিছু কিছু গল্পকার দেখা যায় বিভিন্ন জেলায়। এই গল্পকাররা আমাদের শোনান আড়াই হাজার ভোট ৩৫ মিনিটে কাস্ট হয়ে গেছে। অথবা সারাদিন শুনলাম ৭ ভোটের আবু তাহের পিছিয়ে আছেন। অথচ সন্ধ্যায় ঘোষণা করা তিন হাজার ভোটে আবু তাহের জয়লাভ করেছেন। এই রুপকথাগুলো কারা শোনান। দুই ধরণের ভদ্র সন্তান এই গল্প শোনান একজন হলে ওসি, আরেকজন হলে ডিসি। এই দুই ধরণের ভদ্র সন্তান নিয়ে যেন ইসি সজাগ থাকেন।

তিনি বলেন, সিইসির পক্ষ আল্লাহ কাছে অনুরোধ করবো, হে আল্লাহ সিইসি হাতকে তুমি এমন শক্মিশালী করে দাও যেন ওই দুই ভদ্র সন্তানের টুটি চেপে ধরতে পারেন।

প্রতিদিনের বাংলাদেশ পত্রিকার সম্পাদক মারুফ কামাল খান সোহেল বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য কাঠিন্য অবলম্বন করতে হবে। সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ আছে। আশাকরি ভালো ভোট হবে।

সারাবাংলা.ডটনেট-এর হেড অফ নিউজ গোলাম সামদানী বালেন, অনেক সময় নির্বাচন কমিশন চাইলে ইসি সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারে নাই। পুলিশ সহায়তা করে নাই। এজন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইসির অধীনে রেখে নির্বাচন করতে হবে। এছাড়া একাধিক দিনে নির্বাচন করা যায় কিনা তা ভাবতে হবে।

দৈনিক খবর সংযোগ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক শেখ নজরুল ইসলাম বলেন, আগাম প্রচার প্রতিরোধ করতে হবে। অনেকেই এখনই বিলবোর্ডে প্রচার চালাচ্ছে।

দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার রাজনৈতিক ও নির্বাচন বিষয়ক সম্পাদক সাইদুর রহমান বলেন, বিগত তিন নির্বাচনের মূল কারিগরি ছিলেন জেলা প্রশাসকরা। আগামীতে নির্বাচনে ইসির নিজস্ব যে কর্মকর্তারা আছেন তাদের মধ্যে থেকে যদি রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া তাহলে নির্বাচন আরও স্বচ্ছ থাকবে এবং আপনাদের নিয়ন্ত্রণও থাকবে।

তিনি বলেন, বিগত সরকার মাদ্রাসা বা ইসলামি প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে প্রিজাইডিং অফিসার বা সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার নিয়োগ দিত না। বর্তমান কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেখান থেকেও নিয়োগ দেওয়া হবে সেটা আমি সাধুবাদ জানায় তবে নিয়োগ দেওয়ার অবশ্যই রাজনৈতিক পরিচয় নিশ্চিত হতে হবে।

দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমেদ বলেন, ১২টি সংসদ নির্বাচনের মধ্যে গুটি কয়েক ছাড়া বাকি সব নির্বাচন বিতর্কিত ছিল। নির্বাচন কমিশনকে সুষ্ঠু নির্বাচনের মেরুদণ্ড শক্ত করে ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হবে।

 নির্বাচন কমিশন বিটের সাংবাদিকদের সংগঠন রিপোর্টার্স ফোরাম ফর ইলেকশন অ্যান্ড ডেমোক্রেসি (আরএফইডি)-এর সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী বলেন, ইসি গণমাধ্যমকে বললেও অনেক সময় বৈষ্যমমূলক আচরণ করেন। প্রশ্ন করলে ক্ষেপে যান, অনেক সময় ফ্যাসিস্টও আখ্যা দেন।

পোস্টাল ব্যালট নিয়ে তিনি গণমাধ্যমকর্মী ও তার পরিবারকেও এর আওতায় আনার অনুরোধ জানান। একই সঙ্গে নিবন্ধিত অনেকগুলোকে দলকে সংলাপে বাইরের রাখার প্রশ্ন তোলে ভবিষ্যতে তাদের সভায় ডাকা হবে কিনা জানতে চান।

আরএফইডি’র সভাপতি কাজী এমাদ উদ্দীন (জেবেল) বলেন, যে মন্ত্রণালয়গুলো নির্বাচনের সঙ্গে বেশি সম্পৃক্ত সেগুলো যদি ভোটের সময় ইসির অধীনে রাখা যেতো তাহলে নির্বাচন কমিশনের ভোট কনডাক্ট করা সহজ হতো। যে সব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অতীতে দুর্নীতি বা অন্য কোনো অভিযোগ নেই তাদের রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব বা ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়া যেতে পারে।

সাংবাদিক নীতিমালা নিয়ে তিনি বলেন, আরএফইডি’র পক্ষ থেকে একটা প্রস্তাবনা কমিশনকে দেওয়া হয়েছিল। কমিশন সেটি কী করেছে সেটা নিয়ে কোনো ফিডব্যাক এখনো দেয়নি। এ নিয়ে সভা হতে পারে। যে নীতিমালা করা হয়েছে সেটা বহাল থাকলে ভোটের খবর সংগ্রহ করা কঠিন হবে।

নয়া দিগন্ত পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক মাসুমুর রহমান খলিলী, ইসির প্রতি আস্থার জন্য সিইসি যে আশা ব্যক্ত করেছেন, এর জন্য সবচেয়ে বড় বিষয় যেটা প্রশাসনের মধ্যে নিরপেক্ষ আচরণের আবহ তৈরি করা দরকার। টাকার ছাড়াছাড়ি বিষয়ে যদি ইসি যদি নমুনা ব্যবস্থা নিতে পারে ইসি তাহলে মেসেজটা চলে যাবে। যদি কিছু নমুনামূলক, শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিলেই মেসেজটা চলে যাবে। ঋণ খেলাপি বা কর খেলাপি যাতে প্রার্থী না হতে এ বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নিলে ভালো ফলাফল আসবে।

খবরের কাগজের সম্পাদক মোস্তফা কামাল বলেন, মবের রাজনীতি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। সেই জায়গাটায় কোথায় বাধা। যারা বিগত তিনটা নির্বাচন করেছে, তারাই এবারও করবে। সেই আর্মি, সেই বিজিবি, সেই পুলিশ, সেই সাধারণ প্রশাসন। কাজেই সেই জায়গাটায় ইসির পক্ষ থেকে কঠিন বার্তা যেতে হবে।

 প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ বলেন, এবারের নির্বাচনে বোঝা যাচ্ছে, অর্থ ও বলপ্রয়োগ অনেক হবে। আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, প্রতিষ্ঠানগুলো খুব দুর্বল, প্রশাসনের অবস্থা দুর্বল। এই অবস্থায় কতটুকু কী পরিমাণে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে এ নিয়ে আশংকা রয়ে গেছে।

Media-EC_20251006_152225849

দ্য ডেইলি স্টার পত্রিকার হেড অব নিউজ জিয়াউল হক বলেন, ভোটকেন্দ্র ঢুকে সাংবাদিকরা প্রবেশ করে যেন করে কোনো বাধা ও হয়রানির শিকার যেন না হন এবং তাদের নিরাপত্তা যেন নিশ্চিত করা হয়।

আজকের পত্রিকার সম্পাদক কামরুল হাসান বলেন, প্রার্থীর হলফনামা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন এটা ওয়েবসাইট আপলোড করা হয়। এতে তার ভোটার এবং পুরো দেশের মানুষ ওই প্রার্থী সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য যেন জানতে পারে সেই ব্যবস্থাটা উন্মুক্ত করা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব। 

জাগো নিউজের সম্পাদক কেএম জিয়াউল হক বলেন, আচরণবিধিটা আরও একটু ক্লিয়ার করা দরকার। আচরণবিধি লঙ্ঘনে শাস্তি বা জরিমানা হয় এটা দৃশ্যমান পর‌্যায়ে আসলে আচরণবিধি লঙ্ঘন কম হবে।

ঢাকামেইলের নির্বাহী সম্পাদক হারুন জামিল বলেন,বিগত তিনটা নির্বাচন ভোটার ছাড়া নির্বাচন হওয়ার কারণে নির্বাচনের উপরে মানুষের আস্থা নষ্ট হয়ে গেছে। আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারলে নির্বাচন কমিশন সফল হবে।

দৈনিক যুগান্তরের সম্পাদক কবি আবদুল হাই শিকদার বলেন, আগামী নির্বাচন যাতে কেউ বানচাল করতে না পারে, সেজন্য দৃঢ়তা দেখাতে হবে। সাংবাদিক নীতিমালা নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। এটা দয়া করে সংশোধন করেন। গণমাধ্যমকে শত্রু হিসেবে না নিয়ে সহযোগী হিসেবে দেখেন। 

প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিনের সভাপতিত্বে ও ইসির ভারপ্রাপ্ত সচিব কেএম আলী নেওয়াজের সঞ্চালনায় সভায় চার নির্বাচন কমিশনার, ইসির কর্মকর্তা ও গণমাধ্যম প্রতিনিধিরা অংশ নেন।

এমএইচএইচ/