মো. মেহেদী হাসান হাসিব
০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৯:৪২ পিএম
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ইতোমধ্যে ঘোষণা হয়েছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে দেশে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন আয়োজনে তোড়জোড় শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ডিসেম্বরের শুরুতেই তফসিল ঘোষণা হতে পারে। তবে এবারের নির্বাচনটি অন্যবারের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন। গণঅভ্যুত্থানপরবর্তী এই নির্বাচনে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার বিষয়টিকে।
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দলটি কার্যত ছন্নছাড়া অবস্থায় রয়েছে। দলীয় নেতাদের একটি বড় অংশ দেশের বাইরে কিংবা কারাগারে রয়েছেন। ইতোমধ্যে দলটির কার্যক্রমের ওপর সরকার নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। নির্বাচন কমিশনও তাদের নিবন্ধন স্থগিত করেছে। তবে আওয়ামী লীগ নানাভাবে ফিরে আসার চেষ্টা করছে। আগামী নির্বাচনে তাদের অংশ নেওয়ার সুযোগ না থাকায় তারা নানাভাবে নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই অবস্থায় নির্বাচন আয়োজনে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার বিষয়টি অধিক গুরুত্ব পাচ্ছে।
নির্বাচন কমিশন বলছে, আইনশৃঙ্খলা নিয়ে তাদের মধ্যে কিছুটা উদ্বেগ থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। রোডম্যাপ অনুযায়ী ইসি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নির্বাচনের উপযোগী করার কাজ শুরু করেছে। সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা পেলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার চ্যালেঞ্জ উৎরাতে পারবে বলে আশা করছে ইসি।
আরও পড়ুন
জানা গেল নির্বাচনের সম্ভাব্য তারিখ!
নির্বাচন কমিশনের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে ঢাকা মেইলকে জানান, এবারের নির্বাচনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা। এজন্য আগে থেকেই সবকিছু গুছিয়ে আনা হচ্ছে।
তিনি জানান, নির্বাচন ঘিরে তিন ধাপে নিরাপত্তা পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। তফসিল ঘোষণার আগে সন্ত্রাস দমন, অস্ত্র উদ্ধার ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নেবে। তফসিল থেকে ভোটের দিন পর্যন্ত মাঠে থাকবে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, সেনাবাহিনী, কোস্টগার্ড, মোবাইল টিম ও স্ট্রাইকিং ফোর্স। পাশাপাশি নির্বাহী ও জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট দায়িত্ব পালন করবেন। ভোটের পরবর্তী ৯৬ ঘণ্টাও সহিংসতা ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সক্রিয় থাকবে।
ওই কর্মকর্তা আরও জানান, প্রথমবারের মতো জাতীয় নির্বাচনে ডিজিটাল সার্ভেল্যান্স ব্যবহারের পরিকল্পনা রয়েছে। সিসিটিভি, ড্রোন, ফেস রিকগনিশন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম মনিটরিংয়ের মাধ্যমে ভোটের পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ করা হবে। এছাড়া নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে ভিজিল্যান্স কমিটি, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের অন্তর্ভুক্ত করে তদারকি কমিটি, প্রতিটি এলাকায় আইনশৃঙ্খলা সেল এবং কেন্দ্রীয়ভাবে মনিটরিং সেল গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
ভোটে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে থাকবে, আশা সিইসির
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন মনে করেন, নির্বাচনের আগে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। এমন আশাবাদ প্রকাশ করে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে সিইসি বলেন, নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব যেহেতু আমাদের হাতে, সেহেতু ল অ্যান্ড অর্ডার সিচুয়েশন আমাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেজন্য আমরা আমাদের দিক থেকে পুলিশ প্রশাসন, সেনাবাহিনী যাদের যা করার আছে—সব জায়গায় আমরা সাপোর্ট দিই এবং তাদের সাথে আমাদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ থাকে এবং তারাও খুব কো-অপারেটিভ থাকে সব সময়ই। তারা আমাদের দিক থেকে সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে এবং নির্বাচনকালীন তারা সবসময় আমাদের সাহায্য সহযোগিতা করে থাকে। অতীতে যেমন করেছে, ভবিষ্যতেও করবে। এই আস্থার জায়গা থেকে আমি বলেছি, ল অ্যান্ড অর্ডার সিচুয়েশন নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে জানি, এই অভিজ্ঞতা থেকে বলেছি। আমরা বিভিন্ন সময়ে এই ধরনের আশঙ্কার কথা শুনেছি, কিন্তু যখন নির্বাচন এসেছে তখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে এসেছে। কারণ নির্বাচনের সময় সবাই চায় অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হোক এবং একটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশে নির্বাচন সম্পন্ন হোক।
সিইসি বলেন, সরকারকে বাদ দিয়ে ভোট সম্ভব নয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী লাগবে, বাজেট লাগবে, উনাদের সহযোগিতা ছাড়া ভোট সম্ভব নয়। ৯৫ শতাংশ সরকারের লোকবল রেজাল্ট নিজেদের পক্ষে নিতে চাইবেন না। কেননা, সরকারপ্রধান কোনো দলের না। স্বাধীনভাবে ইসি যেন কাজ করতে পারে, সে সহযোগিতা করছেন তিনি।
নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটা সমঝোতা আসবে-এমন আশাবাদ ব্যক্ত করে সিইসি বলেন, আমার ধারণা হলো, রাজনৈতিক দলগুলো দেশের স্বার্থ সবার উপরে বিবেচনায় রাখবে। দলগুলো দেশের স্বার্থে কাজ করে, দেশের কথা চিন্তা করে এবং শেষ পর্যন্ত গিয়ে দেখবেন যে, একটা পজিশনে এসে যায়।
এদিকে নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকারও মনে করেন, আইনশৃঙ্খলা নিয়ে কোনো অনিশ্চয়তা নেই। নির্বাচন কমিশনের কাছে প্রতিকূল পরিস্থিতির তথ্য আসেনি।
পরিস্থিতি অবনতির আশঙ্কা দেখছে না বিএনপিও
আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি হওয়ার কোনো আশঙ্কা দেখছে না রাজনীতির মাঠে সক্রিয় প্রধান দল বিএনপি। তবে পুলিশের ভূমিকা অপেক্ষাকৃত দুর্বল বলে উল্লেখ করেছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান।
বিএনপির এই নেতা বলেন, 'নির্বাচনি প্রস্তুতি যেটা নেওয়া দরকার তারা (ইসি) যথাযথভাবে নিচ্ছে। এখনো কিছুটা কনসার্ন আইনশৃঙ্খলা বিষয়ে। পুলিশের ভূমিকা অপেক্ষাকৃত দুর্বল... কমিশন থেকে যেটা বলা হলো- নির্বাচনের সময়ে যদি প্রয়োজন হয় আরও বেশিসংখ্যক সেনা সদস্য মোতায়েনের ব্যাপারে অনুরোধ করবেন। কাজেই ওই বিষয়েও আর খুব বেশি দুশ্চিন্তার কোনো কারণ দেখছি না।'
নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা যারা রাজনীতি করি, রাজনৈতিক দলগুলো যারা নির্বাচন করে, তাদেরও দায়িত্ব আছে। আমাদেরও চেষ্টা থাকতে হবে যাতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কোনো অবনতি না হয়। যাতে আমাদের দলের নেতাকর্মী, সদস্য এবং সমর্থকরা যেন শান্তিপূর্ণভাবে উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে ভোটে অংশগ্রহণ করে। এটা আমরা এবং অন্যান্য যত রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে, সবারই একই মনোভাব থাকবে। ফলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির কোনো আশঙ্কা আমরা দেখি না।'
নির্বাচনি নিরাপত্তায় ‘সমন্বিত ব্যবস্থা’র পরামর্শ বিশেষজ্ঞের
ভোটের আগে ঝুঁকিগুলো পর্যালোচনা করে আগে থেকে নির্বাচন নিরাপত্তায় ‘সমন্বিত ব্যবস্থা’ গড়ে তোলার পরামর্শ দিয়েছেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ও নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সাবেক সদস্য আব্দুল আলীম।
বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন বাস্তবায়ন সম্ভব কি না জানতে চাইলে আব্দুল আলীম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমরা তো সবাই জানি, সরকারের পক্ষ থেকেও এটা নিয়ে কনসার্ন প্রকাশ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে সরকার বিভিন্ন বাহিনীর প্রধানের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেছে, আলাপ-আলোচনা করেছে। ইলেকশন কমিশন সম্ভবত কিছু আলাপ-আলোচনা করেছে। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়, একটা সমন্বিত নির্বাচন নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার।’
আরও পড়ুন
ভোটে অযোগ্য হচ্ছে ফেরারি আসামি
আব্দুল আলীম বলেন, ‘সমন্বিত নির্বাচন নিরাপত্তাব্যবস্থার একটা প্ল্যান করা দরকার এবং তার মধ্যে যে আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কী কী ঝুঁকি আসতে পারে, যারা আইনশৃঙ্খলার সঙ্গে জড়িত তাদের নিয়ে বসে ঝুঁকির একটা তালিকা তৈরি করা। সেই অনুযায়ী অ্যাকশন হবে অর্থাৎ ঝুঁকি মোকাবেলার জন্য কী কাজ দরকার সেই কাজগুলো এখন থেকে শুরু করে দেওয়া।’
জানা গেছে, কমিশনে এ বিষয়ে আলোচনার পর সভা আয়োজনের সিদ্ধান্ত হবে। সভায় প্রণীত নিরাপত্তা পরিকল্পনা মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়নে নির্দেশনা দেওয়া হবে। বিগত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সাধারণ ভোটকেন্দ্রে ১৬ জন এবং গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে ১৭ জন করে নিরাপত্তাকর্মী মোতায়েন ছিল। এবার কেন্দ্রভিত্তিক নিরাপত্তা আরও জোরদার করতে সংখ্যাটি বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে।
এমএইচএইচ/জেবি