images

জাতীয়

হাসিনার সেই গণভবন এখন যেমন

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক

১৪ জুলাই ২০২৫, ০৯:৪১ পিএম

টানা প্রায় সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল গণভবন। সরকারপ্রধানের এই বাসভবনটি থেকে নির্ধারণ হতো জাতির ভাগ্য। শেখ হাসিনা তার প্রধানমন্ত্রিত্বের সময়কালে গণভবনকে শুধু নিজের বাসস্থানই নয়, এটাকে ব্যক্তিগত সম্পত্তির মতো বানিয়ে নিয়েছিলেন। সেখানে কৃষি-মৎস্য চাষ থেকে শুরু করে সবই করেছিলেন নিজের মতো করে। পাশাপাশি এটাকে দলীয় কার্যালয়ের মতোও ব্যবহার করতেন। আওয়ামী লীগের নানা কর্মসূচি পালিত হতো সেখানে। স্বৈরশাসনের পুরোটা সময় সেখান থেকেই নিয়ন্ত্রিত হতো নানা অন্যায়-অপকর্ম।

ঠিক এক বছর আগের এই দিনে (১৪ জুলাই) গণভবনেই সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন শেখ হাসিনা। সেখানেই এক প্রশ্নের জবাবে বেফাঁস কিছু মন্তব্য করেন। সেই মন্তব্যই কাল হয়ে দাঁড়ায় তার জন্য। ‘রাজাকারের বাচ্চা’ গালি কোটাবিরোধী আন্দোলনের আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করে। স্মরণকালের বৃহৎ এই আন্দোলন দমাতে প্রাণঘাতী যত সিদ্ধান্ত সেটাও এই গণভবনে বসেই দেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। তবে কোনো চেষ্টাই আর কাজে আসেনি। শেষ পর্যন্ত অত্যন্ত অপমানজনকভাবে তাকে অল্প সময়ের নোটিশে গণভবন ছেড়ে পালিয়ে যেতে হয়।

গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে চূড়ান্ত বিজয়ের দিনে গণভবনে ঢুকে পড়ে হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ জনতা। তারা তাদের দীর্ঘদিনের রাগ-ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটান। শেখ হাসিনার শাসনকালে নানা কর্মকাণ্ডে সাধারণ মানুষের যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল সে কথা ওই সময় অনেকে লিখে রেখে আসেন গণভবনের দেয়ালে। প্রায় বছর হতে চলছে সেই লেখাগুলো এখনো রয়ে গেছে দেয়ালে দেয়ালে।

আরও পড়ুন

গণভবনে জুলাই স্মৃতি জাদুঘর উদ্বোধন ৫ আগস্ট

গণভবনের দেয়ালজুড়ে প্রতিবাদী গ্রাফিতি, ঘুরে ঘুরে দেখলেন প্রধান উপদেষ্টা

গণভবনে ভাঙচুরের সেই সময়ে কয়েক দিন সাধারণ মানুষের যাওয়া-আসার সুযোগ ছিল রাষ্ট্রীয় এই ভবনে। আশপাশের দেয়ালও ভেঙে ফেলা হয়েছিল। ছিল না কোনো নিরাপত্তাব্যবস্থা। তবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ধীরে ধীরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন করা হয় গণভবনে। এরপর থেকে আর সাধারণের প্রবেশের সুযোগ নেই। এরমধ্যে সরকার সিদ্ধান্ত নেয় এই গণভবন ঘিরে তৈরি হবে জুলাই স্মৃতি জাদুঘর।

Gonovobon2

সরকারের পক্ষ থেকে সোমবার (১৪ জুলাই) জানানো হয়েছে, গণভবনে জুলাই স্মৃতি জাদুঘরে রূপান্তরের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। আগামী ৫ আগস্ট জাদুঘরের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হবে। যা সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে।

গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সারওয়ার ফারুকী বলেন, গণভবন ছিল একটা ক্রাইম জোন। এখান থেকেই হত্যা গুম খুনের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। ভবনটিকে এমনভাবে জাদুঘরে রূপান্তরিত করা হবে, যাতে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদের বাস্তব চিত্র ফুটে ওঠে।

এক টাকায় গণভবন ইজারা পেয়েছিলেন শেখ হাসিনা

২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকার টোকেন এক টাকার বিনিময়ে এই বাড়িটি ইজারা দিয়েছিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে। ওই মেয়াদে ক্ষমতা শেষ হওয়ার কয়েক দিন আগে ‘জাতির পিতার পরিবার-সদস্যগণের নিরাপত্তা আইন, ২০০৯' এর আওতায় গণভবন ইজারা দেওয়া হয়।

আরও পড়ুন

শহীদ নাফিজের দেহ বহনকারী সেই রিকশাটি গণভবনের জাদুঘরে

গণভবন নিয়ে আন্দালিব রহমান পার্থের নতুন প্রস্তাব

২০০১ সালের ১৫ জুলাই সাবেক প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমানের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্বে আসার পরও শেখ হাসিনা এই বাড়িতেই ছিলেন। ওই বছরের ১৬ আগস্ট বিরোধী দলের তীব্র চাপের মুখে তিনি গণভবন ত্যাগ করেন। বাতিল করা হয় ইজারা। সেই সময় গণভবনের বিদ্যুৎ-পানি-গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ করেছিলেন শেখ হাসিনা।

এদিকে বিশাল এলাকাজুড়ে নির্মিত গণভবন ১৯৭৩ সালে শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক নির্মাণের পর থেকে শেখ হাসিনা ছাড়া দেশের আর কোনো প্রধানমন্ত্রী সেখানে বসবাস করেননি। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া, সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও এখানে থাকেননি। ক্ষমতায় থাকাকালীন তারা সেনানিবাসের বাসভবন ব্যবহার করেছেন।

Gonovobon3

শেখ হাসিনা গণভবনের যে অংশ বসবাস বা অফিসের জন্য ব্যবহার করতেন, সেগুলোর দেয়াল ছিল বুলেটপ্রুফ। স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স, পিজিআর সদস্যরা নিরাপত্তার মূল দায়িত্ব পালন করলেও গণভবনের বাইরে এপিবিএন সদস্যরা সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা দেখভাল করতেন।

শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন গণভবনের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালনকারীদের পাশের চন্দ্রিমা উদ্যানেও (এখন জিয়া উদ্যান) মোতায়েন করা হতো। কিন্তু ৫ আগস্ট বিক্ষোভকারীদের প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করার পর শেখ হাসিনা ও তার ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে দেশ ছেড়ে যাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে মিছিল নিয়ে সর্বস্তরের জনগণ গণভবনে ঢুকে পড়ে। পরে যে যা পেরেছে গণভবনে ব্যবহৃত জিনিসপত্র নিয়ে বেরিয়ে গেছেন।

এখন যেমন আছে গণভবন

সোমবার জুলাই পুনর্জাগরণের কর্মসূচি নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করা হয় গণভবনে। যেখানে সরকারের সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টা, কর্মকর্তার পাশাপাশি গণমাধ্যম কর্মীরাও গিয়েছেন। অনেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভেতরের ছবিও পোস্ট করেছেন।

আরও পড়ুন

গণভবনে তিন ঘণ্টা

গণভবনের মিষ্টি খেয়ে বিজয় উল্লাস

এসব ছবিতে দেখা গেছে, গত বছরের ৫ আগস্ট দেয়ালে যেসব লেখা, গ্রাফিতি এঁকে রেখেছেন সেগুলো তেমনই আছে। কোথাও ‘শেখ হাসিনা স্বৈরাচার’, ‘হাসু আপা পলাইছে’ লেখা রয়েছে। কোথাও জুলাই অভ্যুত্থানের সময় পুলিশের গুলিতে নিহত আবু সাঈদসহ আরও অনেক শহীদের নাম লেখা রয়েছে গণভবনের দেয়ালে।

Gonovobon4

গণভবন ঘুরে আসা সাংবাদিক বোরহানুল আশেকীন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘একটা সময় গণভবন ছিল ক্ষমতা আর দম্ভের প্রতীক। কিন্তু এখন সেটি শুধুই স্মৃতি। পতনের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে গণভবনের দেয়ালগুলো। বিভিন্ন লিখনি আর গ্রাফিতি হয়ে আছে ৫ আগস্টের প্রতীক।’

গণভবন ঘুরে আসা আরেক সাংবাদিক সাজেদা সুইটি ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘শেখ হাসিনা বাসিন্দা ছিলেন, কিন্তু গণভবনটা বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষের সম্পদ। সেটির বিধ্বস্ত রূপ দেখতে ভালো লাগার কোনো কারণ নাই। শেখ হাসিনার প্রতি প্রচণ্ড জনরোষে সেটি ভাঙচুর হয়েছে, নানা ক্ষোভের কথা তোলা আছে দেয়ালে। আশা করি- এটা অন্য সব শাসকরা দেখবেন এবং শিক্ষা নেবেন।’

এই সাংবাদিক বলেন, তারা (শাসকরা) যেন জনমানুষের 'প্রভু' মনে না করেন নিজেদের, বরং দেশটা যে সাধারণের, সেটা মনে রেখে জনমুখী-জনসেবী ভূমিকা পালন করবেন। যদিও শুধু তারা নন, জনগণও কি দায় এড়াতে পারেন? শাসক যখন ভুল করতে শুরু করবে, শুরুতেই প্রতিবাদটা করতে হবে, যাতে পরে গিয়ে এতো তাজা প্রাণ, তাজা রক্ত ঝরাতে না হয়।’

বিইউ/জেবি