মো. মেহেদী হাসান হাসিব
২২ জুন ২০২৫, ০৯:৪৯ পিএম
টানা প্রায় ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকাকালে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী হয়ে ওঠার পেছনে বাহাত্তরের সংবিধানকে দায়ী করছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানের ওপর ভিত্তি করে একাধিকবার ফ্যাসিবাদী শাসন প্রতিষ্ঠা পেয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
ঢাকা মেইলেকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও লেখক চলমান সংস্কার প্রক্রিয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেন।
‘জুলাই সনদে’ এমন কোনো সুপারিশ আছে কি না যা বাহাত্তরের সংবিধানকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে- এমন প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘২০২৫ সালে যে সংবিধান বাংলাদেশে আছে, সেটি বাহাত্তরের সংবিধান নয়। বাহাত্তরের সংবিধান সবচেয়ে ভয়াবহভাবে লাঞ্ছিত হয়েছে, পুনরায় রচিত হয়েছে ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন একটি সরকারের দ্বারা। বাহাত্তরের সংবিধানের কোনো অস্তিত্ব নেই এখন।’
সেই সংবিধান প্রসঙ্গে আলী রীয়াজ বলেন, ‘দ্বিতীয়বার সেটি পরিবর্তিত হয়েছে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে। সংবিধানের এক-তৃতীয়াংশকে পরিবর্তনের অযোগ্য বিবেচনা করা হয়েছে—যা বাহাত্তরের সংবিধানে ছিল না। তাহলে বাহাত্তরের সংবিধানের প্রশ্নটি উঠছে কেন?’
বাহাত্তরের সংবিধানের সমালোচনা করে এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেন, ‘যে সাংবিধানিক ব্যবস্থা ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েম করেছে, তা একাধিকবার ১৯৭২ সালের সংবিধানের ওপর ভিত্তি করেই হয়েছে। আবার ১৯৭৫ সালের একদলীয় ব্যবস্থাও হয়েছিল সেই বাহাত্তরের সংবিধান অনুযায়ী। ইতোমধ্যে সেটি বহুভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। ফলে আজ যদি আমাকে কেউ বলে বাহাত্তরের সংবিধান স্পর্শ করা যাবে না, তাহলে তো সংস্কারই করা যাবে না।’
ইলিনয় স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আলী রীয়াজ অন্তর্বর্তী সরকারের চলমান সংস্কার প্রক্রিয়ার সঙ্গে ওৎপ্রোতভাবে জড়িত। তিনি প্রথমে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে ছয়টি সংস্কার কমিশন নিয়ে গঠিত ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতির দায়িত্ব পান। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের যে আলোচনা চলছে গত কয়েক দিন ধরে এর নেতৃত্ব দিচ্ছেন আলী রীয়াজ।
ঐকমত্য কমিশনের চলমান আলোচনা শেষে জুলাই সনদ ঘোষণার কথা রয়েছে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘কোনো বিষয়ে আধা বেলার আলোচনায় আমরা একমত হতে পারব, আবার কোনো বিষয়ে একদিনও লাগতে পারে। সুনির্দিষ্ট করে আমরা এখনো কোনো তারিখ নির্ধারণ করিনি। তবে আমরা প্রতিশ্রুতি দিতে পারি যে, জুলাই মাসে ‘জুলাই সনদ’ সেটা যে আকারেই হোক, রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মতিসাপেক্ষে- আমরা প্রকাশ করতে পারব। এটি আমরা কমিশনের পক্ষ থেকে অঙ্গীকার করছি।’
আরও পড়ুন
ন্যূনতম ছাড় দেওয়ার জায়গায় আসুন, রাজনৈতিক দলগুলোকে আলী রীয়াজ
বাহাত্তরের সংবিধানে মানুষের মুক্তি না আসায় সংস্কার জরুরি: আলী রীয়াজ
অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি যেকোনো রকম সনদ বাধ্যতামূলক হতে হবে। এটা রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য প্রয়োজন, নাগরিকদের জন্য প্রয়োজন, ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের স্বার্থে প্রয়োজন। যে কারণে এটিকে কোনো না কোনোভাবে বাধ্যতামূলক করতে হবে।’
ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর আমার আস্থা থাকার সত্ত্বেও নাগরিকদের সঙ্গে যে একটা চুক্তি হচ্ছে, সেই চুক্তিটার নিশ্চয়তা দেওয়ার কোনো না কোনো ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে। আমরা জাতীয় সনদ যদি তৈরি করতে পারি এবং আমরা এটা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। রাজনৈতিক দলগুলো আশা করছে আমরা পারব। আমরা মনে করি, এটি হবে একটি সামাজিক চুক্তি, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নাগরিকদের একটি চুক্তি যে, ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ কেমন হবে। যেকোনো চুক্তিতে যেমন কিছু বাধ্যবাধকতা থাকে, এক্ষেত্রেও রাজনৈতিক দলগুলো সেটি করবে।’
আসন্ন নির্বাচন বিগত বিতর্কিত নির্বাচনের মতো প্রশ্নবিদ্ধ হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি এখন পর্যন্ত দেখছি না যে, আগামী নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবে। নির্বাচন প্রক্রিয়াটা সুষ্ঠু, অবাধ এবং সহজে হবে- সেই জায়গায় পৌঁছানোর জন্য প্রয়োজন হচ্ছে এখন থেকেই প্রস্তুতি। সরকারের পক্ষ থেকে বা নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে প্রস্তুতি যথেষ্ট নয়। রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকেও প্রস্তুতি এবং অঙ্গীকার থাকা দরকার। কারণ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিতে হলে আমি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে অনুরোধ করব যে, এখন থেকেই আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করুন।’
এই বিশ্লেষক বলেন, ‘অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থাকে নির্বাচনের ৩৫-৪৫ দিন আগে যুক্ত না করে এখনই তাদের যুক্ত করা উচিত, যাতে করে আন্তর্জাতিকভাবে নির্বাচন প্রক্রিয়াটা গ্রহণযোগ্যতা পায়।’
ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় ধাপের আলোচনা গত ২ জুন শুরু হলেও তা কোরবানি ছুটির পর গত ১৭ জুন মূল আলোচনা শুরু হয়ে এখনো চলছে।
এ প্রসঙ্গে আলী রীয়াজ বলেন, ‘যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হবে না, সেগুলো আমরা জাতীয় সনদে স্বচ্ছতার সঙ্গে উল্লেখ করব। আমরা জানি, সব বিষয়ে ঐকমত্য হবে না। হলে ভালো হতো। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে ঐকমত্য গঠনে সর্বাত্মক সহযোগিতা রয়েছে।’
এমএইচএইচ/জেবি