মোস্তফা ইমরুল কায়েস
১৫ মে ২০২৫, ০৮:৫৫ এএম
দিনের আলো নিভে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জমে ওঠে আড্ডা। গাঁজা ও মাদকে বুদ হয়ে থাকেন কেউ কেউ। সেই মাদকের খেলা চলে রাতভর। যেন এসব দেখার কেউ নেই। নানা বয়সী মানুষের আড্ডা জমে। এর ফাঁকে মাঝে মাঝে ঘটে যায় অঘটন। তখন প্রশাসনের টনক নড়ে। দুই একদিন কড়া নজরদারি। তারপর আগের মতোই হয়ে ওঠে অপরাধীদের অভয়ারণ্য।
রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের চিত্র এটি। সন্ধ্যার পর থেকেই নগরীর বিভিন্ন প্রান্তে থাকা অপরাধীরা আসতে থাকেন এখানে। রাত যত গভীর হয় তত জমে তাদের আড্ডা।
অপরাধীদের অভয়ারণ্য
সোহরাওয়ার্দী উদ্যান গত দেড় যুগের বেশি সময় ধরেই ছিনতাইকারী, মাদককারবারি ও সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য হয়ে ওঠেছিল। মাদক বিক্রি হতো প্রকাশ্যে। বিষয়টি পুলিশও জানতো কিন্তু তারা কোনো ব্যবস্থা বা উদ্যোগ নিতো না। অথচ শাহবাগ থানার পাশেই এই উদ্যান। গেল বছরের ৫ আগস্টের পর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যৌথ বাহিনী অভিযান চালিয়ে কয়েক কয়েক শ অপরাধীকে গ্রেফতারও করেছিল। কিন্তু তারা সম্প্রতি জামিনে বের হয়ে আবারও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সক্রিয় ওঠে উঠেছে। অপরাধীরা সন্ধ্যা হলেই ভিড় জমাতেন। সম্প্রতি ছাত্রদল নেতা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শাহরিয়ার আলম সাম্য হত্যার আগের দিনও একই চিত্র ছিল। কিন্তু বুধবার দিন থেকে উচ্ছেদ অভিযোগ শুরু করেছে প্রশাসন। সন্ধ্যার পর দোকানপাট বসতে দেওয়া হচ্ছে না।
জানা গেছে, বিগত সময়ে ঢাবির বিভিন্ন হলে থাকা ছাত্রলীগের নেতারা ছিনতাই করতেন। তারা উদ্যানে বেড়াতে আসা নারী ও পুরুষদের জিম্মি করে টাকা পয়সা মোবাইল মানিব্যাগ ছিনিয়ে নিতেন। যা বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে এসেছে। এরপরও বন্ধ হয়নি। কিন্তু সরকার বদলের পর অনেকে ভেবেছিল চিত্র বদলাবে। আদতে তা হয়নি। আগে ছাত্রলীগ ছিল আর গত কয়েক মাস থেকে বহিরাগত ছিনতাই ও অপরাধীরা ভিড় জমাচ্ছেন।
রাত হলেই মাদক বিক্রি জমে উঠতো
সোহরাওয়ার্দী উদ্যান মাদক বিক্রির জন্য নিরাপদ স্থান ছিল মাদককারবারিদের কাছে। এজন্য উত্তরা, যাত্রাবাড়ী, মোহাম্মদপুর ও মিরপুর থেকে মাদককারবারি রাতে চলে আসতেন এখানে। উদ্যানের অন্ধকার জায়গাগুলো বেছে নেওয়া হতো এই মাদক বিক্রির জন্য। আর এই মাদক কেনার জন্য ছুটে আসতো বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উঠতি যুবক-যুবতীরা।
গত কয়েক বছরে এই উদ্যানে মাদক বিক্রিকে কেন্দ্র করে নানা অঘটন ঘটেছে। খুনও হয়েছে কয়েকটি। কিন্তু মাদক বিক্রি বন্ধ হয়নি। মাঝে থানার পাশে থাকা ছবির হাট বন্ধ করে দিয়েছিল প্রশাসন। কিন্তু সেটি আবারও খুলে দেওয়া হয়। আর তাতেই শুরু হয় আগের চিত্র। তবে ছবির হাট অংশের গেট বন্ধ থাকলেও অন্য পাশ দিয়ে অনায়াসে ঢুকে মাদককারবারিরা।
রমনা কালী মন্দিরের অংশে বসতো গাঁজার হাট
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত এক যুগের বেশি সময় ধরে উদ্যানের দক্ষিণ অংশে থাকা রমনা জয়কালী মন্দিরের সামনের অংশে গাঁজার হাট বসতো। যা ছিল প্রকাশ্য। প্রশাসন জানলেও ব্যবস্থা নিতো না।
এই অংশের ভাসমান ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, তারা সন্ধ্যার পর আতঙ্কে থাকতেন। কারণ কখন কী ঘটে যায়। সেখানে যারা রাতে আসতেন বেশিরভাগ মাদককারবারি। তবে এই তালিকায় ঢাবির ছাত্ররাও রয়েছেন। যারা বিগত সময়ে থেকে এই ব্যবসা করে আসছেন।
আরও পড়ুন-
নাম প্রকাশ না করা শর্তে একাধিক ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, সন্ধ্যার পরে সেখানে প্রকাশ্যে ‘এই কয়টা লাগবে’ বলে চলত মাদক বিক্রি। এই ডাকে যারা বুঝতেন তারা সাড়া দিয়ে কিনে নিতেন। শুধু কি তাই, তারা এও জানালেন, উদ্যানের বিভিন্ন পয়েন্টে প্রতি রাতে অন্তত ৫০ থেকে ৬০ কেজি গাঁজা বিক্রি হতো। তবে তারা কোনো প্রতিবাদ করতে পারতেন না। কারণ সবার হাতেই চাকু থাকতো। এই ভয়ে তারা কিছু বলতে পারতেন না।
প্রতি রাতে রমনা মন্দির, মুক্তমঞ্চ ও গ্লাস টাওয়ার ছাড়াও ছবির হাটের অংশে কয়েকটি গ্রুপ এই গাঁজা বিক্রি করেন। তারা সবাই আশপাশের এলাকা থেকে আসেন। প্রকাশ্যে বিক্রি করে আবারও রাতেই চলে যান। তবে বেশির ভাগই অশিক্ষিত বলে জানান তারা।
এই গাঁজা বিক্রির একটি গ্রুপের সন্ধান পায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। গত বছর ‘প্রলয় গ্যাং’ নামে এই গ্যাংয়ের সন্ধান মিললে নড়েচড়ে বসে ঢাবি প্রশাসন। এর সঙ্গে জড়িত সবাই ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২০-২১ সেশনের শিক্ষার্থী। তাদের সবাইকে বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার ও সতর্কবার্তা দিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
গেল আগস্ট থেকে এই উদ্যানে গাঁজা বিক্রি বেড়েছে। আগে মাদককারবারি কোনো গাঁজা বিক্রি করলে ছাত্রলীগের নেতারা এসে তার অর্ধেক ছিনিয়ে নিয়ে যেতো। কিন্তু সম্প্রতি তারা প্রকাশ্যে ব্যবসা করতে শুরু করেন। এসব মাদককারবারি সাধারণ মানুষের ভিড়ে এসে বিক্রি করে চলে যান।
সোহরাওয়ার্দীতে যতো খুন ও হত্যা
২০২১ সালের ১ জুন আবুল হাসান (৩২) নামে এক যুবককে কথা কাটাকাটির জেরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মারধর করেন তার সহপাঠীরা। পরে তাকে অচেতন অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হলে তার মৃত্যু হয়। ময়নাতদন্তের সূত্র ধরে পুলিশ জানতে পারে, আবুল হাসানকে হত্যা করা হয়েছে। এরপর পুলিশ প্রথমে ঢাকা মেডিকেলে আবুল হাসানকে ভর্তির কাগজ পরীক্ষা করে নিবন্ধন খাতায় একটি নাম ও একটি মোবাইল নম্বর পায়। সেই নম্বর ছিল তরিকুল ইসলামের ভাই জামাল উদ্দিনের নামে নিবন্ধিত। সেই সূত্র ধরে তরিকুলের কল হিস্ট্রি খুঁজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার দা সূর্যসেন হল তৎকালীন (বর্তমানে নিষিদ্ধ) ছাত্রলীগের সহসভাপতি মো. মারুফ হাসান সুজনের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়। তবে বাকি দুজন এখনও পলাতক রয়েছে।
সেই ঘটনায় দুই বছর পর মো. মারুফ হাসান সুজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এছাড়াও এ ঘটনায় আরও দুজন জড়িত। তারা হলেন- শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল শাখার সাবেক সহসম্পাদক মো. রাজিব হোসেন ও ২০১২-১৩ সেশনের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের তরিকুল ইসলাম তারেক।
এই ঘটনায় শাহবাগ থানায় আবুল হাসানের বাবা আব্দুল মতিনের মামলা করলে তাদের গ্রেফতার করে পুলিশ।
২০২২ সালের ১৮ জুলাই বিকেলে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দুইশ টাকার জন্য দুই যুবকের মধ্যে মারামারির ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় বিল্লাল হোসেন (৩০) নামের এক যুবক নিহত হন। নিহত বিল্লাল কুমিল্লার তিতাস উপজেলার বাসিন্দা।
সেই সময় পুলিশ জানায়, বাবু ও বিল্লাল উভয়ে ভাসমানভাবে থাকতেন। শাহবাগের আশপাশের পার্কে, রাস্তায় বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাঘুরি করে ফুটপাতে রাত যাপন করতেন। তারা দু’জন পরস্পরের পরিচিত। বিকেলে দুই শ টাকা লেনদেনকে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে মারামারি হয়। এতে বিল্লাল অসুস্থ হয়ে কিছুক্ষণ পরে মারা যান। মারা যাওয়া বিল্লাল কুয়েত প্রবাসী ছিলেন। সাত থেকে আট বছর আগে তিনি দেশে আসেন। এরপর মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন। পরিবার থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে যান বলে জানান বিল্লালের ছোট ভাই দেলোয়ার হোসেন।
২০২৩ সালের ২১ এপ্রিল রাজধানীর শাহবাগ এলাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে অজ্ঞাত পরিচয়ের এক তরুণীর (২০) ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। একই বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি রাজধানীতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভেতর থেকে হৃদয় খান (৩৯) নামে এক যুবকের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। পরে অবশ্য কে বা কারা তাকে খুন করেছিল তা জানা যায়নি। সেই সময় শাহবাগ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আবুল কালাম আজাদ জানিয়েছিলেন, হৃদয় খানের বাবার নাম টানু খান এবং বাড়ি কেরানীগঞ্জের জিনজিরা ইমামবাড়ি। ওই ব্যক্তি মাদকাসক্ত। গাঁজা সেবন করতেন। থাকতেন উদ্যানের ভেতরেই। রাতে কোনো এক সময়ে হয়তো অসুস্থ্যতাজনিত কারণে তার মৃত্যু হয়েছিল।
চলতি বছরের ৪ জানুয়ারি রাজধানীর শাহবাগ থানাধীন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে এক অজ্ঞাত যুবকের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ভেতরে ক্যান্টিনের পাশে ফাঁকা জায়গা থেকে অজ্ঞাতনামা ওই যুবককে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। পরে ঢামেকে নেয়া হলে বিকেলে তার মৃত্যু হয়।
এ কয়েকটি ঘটনা ছাড়াও গত এক যুগে এই উদ্যান থেকে নানা বয়সী ভবঘুরে ও অজ্ঞাত নারী পুরুষের ৩০টিরও বেশি মরদেহ উদ্ধার হয়েছে। তবে বেশির ভাগ মরদেহের কোনো পরিচয় বের করতে পারেনি পুলিশ। পরে সেগুলোর পরিচয় না পাওয়ায় দাফনের জন্য আঞ্জমানে মফিদুল ইসলামকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে।
সর্বশেষ খুনের শিকার হলেন ছাত্রদল নেতা সাম্য। তবে সাম্য কী কারণে রাত ১২টার দিকে সেখানে গিয়েছিলেন তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অনেকে মনে করছেন, যারা তাকে হত্যা করেছে তারা সকলে মাদককারবারি। হয়তো মাদক কারবারিদের সঙ্গে তার পূর্ব শত্রুতা ছিল অথবা মাদক কেনা বা বিক্রিতে বাধা দেওয়ার কারণেও তাকে তারা হত্যা করে থাকতে পারে। বিষয়টি এখনো পুলিশের তদন্তাধীন।
তবে সাম্য হত্যাকাণ্ডের পর সোহরাওয়ার্দী উদ্যান নিয়ে নানা ইঙ্গিত দিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) উত্তরাঞ্চলের সমন্বয়ক সারজিস আলম। তিনি তার ফেসবুকে লিখেছেন, মেট্রোরেল স্টেশন এবং শহীদ মিনারকে ব্যবহার করে যারা সেখানে শতাধিক ভাসমান দোকান বসিয়ে, চাঁদাবাজি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ নষ্ট করছে, তারা এমন হত্যাকাণ্ডের পরিবেশ সৃষ্টির পেছনে দায়ী। যারা উদ্যানের ভেতরে মাদকের সিন্ডিকেট চালায়, মাদক সাপ্লাই দেয়, মাদক সেবনের পরিবেশ তৈরি করে এবং সেখান থেকে চাঁদাবাজি করে তারা এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে পরোক্ষভাবে দায়ী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থী সাম্য হত্যাকাণ্ডের পর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের নিরাপত্তা ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে সাত দফা সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। বুধবার স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ তার ফেসবুকে জানান, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে ‘এক আতঙ্কের স্থান থেকে নিরাপদ ও স্বস্তিদায়ক স্থানে রূপান্তরের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে’।
দোকানপাট বসিয়ে চাঁদাবাজি!
গত ৫ আগস্টের পর থেকে এই উদ্যানে ভাসমান দোকানের সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে। এ সব দোকান বসিয়ে আগে ছাত্রলীগ নেতারা চাঁদাবাজি করতেন। তার ভাগ পেতো প্রশাসনের একটি গ্রুপও। কিন্তু তারা পলাতক থাকায় এখন অন্য গ্রুপ এসব করছে। যদিও কারা করছে কেউ স্বীকার করছে না।
শাহবাগ থানার ওসি খালিদ মনসুর ঢাকা মেইলকে বলেন, আসলে সাম্য হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যের কী কারণ এখনো আমরা জানতে পারিনি। তবে এই হত্যাকাণ্ডের পর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অভিযান চালানো হয়েছে। সেখানে গড়ে ওঠা ভাসমান দোকানপাট ভেঙে দেওয়া হয়েছে। আমরা উদ্যানকে সুরক্ষিত করার জন্য অ্যাকশন শুরু করব।
এমআইকে/ইএ