মোস্তফা ইমরুল কায়েস
৩০ এপ্রিল ২০২৫, ০৯:৩১ পিএম
রাজধানীর দয়াগঞ্জ এলাকায় গত সোমবার (২৮ এপ্রিল) একটি ভাড়া বাসায় হুমায়ুন কবির (৪৫) নামে এক পুলিশ কনস্টেবলকে হত্যার ঘটনায় চাঞ্চল্যকর তথ্য মিলতে শুরু করেছে। ডিএমপিতে কর্মরত হুমায়ুন কবিরকে হত্যা করতে দুই লাখ টাকার মিশন ছিল। সেজন্য বরিশাল থেকে খুনিদের আনা হয়। সবকিছু হয়েছে তার স্ত্রী সালমা আক্তারের পরিকল্পনাতেই। এমনকি খুনিদের সঙ্গে তিনি নিজেও হত্যায় অংশ নেন।
এ ঘটনায় ছয়জনের সম্পৃক্ততার প্রমাণ মিললেও পুলিশ এখন পর্যন্ত গ্রেফতার করেছে দুজনকে। তারা হলেন হুমায়ুন কবিরের স্ত্রী সালমা আক্তার এবং তার (সালমা) ভাবী মরিয়ম ওরফে পলি। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা এই হত্যাকাণ্ড কীভাবে ঘটিয়েছেন পুরো বিবরণ দিয়েছেন।
তদন্ত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে বুধবার (৩০ এপ্রিল) এসব তথ্য জানা গেছে।
গ্রেফতার দুই নারী পুলিশকে এই হত্যাকাণ্ডে কারা কারা জড়িত, কত টাকায় হত্যা মিশন সফল করা হয় এবং তাদের বাইরে এই কাজে সাহায্য করার জন্য কাদের আনা হয়েছিল, এসব ব্যাপারে বিস্তারিত জানিয়েছেন।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পুলিশ কনস্টেবল হুমায়ুনের দুই ছেলে-মেয়ে। ভালোই চলছিল তাদের সংসার। কিন্তু বছর দেড়েক ধরে স্ত্রী নিকটাত্মীয় এক যুবকের সঙ্গে ফোনে কথা বলা শুরু করেন। প্রথম দিকে বিষয়টি আমলে নেননি হুমায়ুন। কিন্তু তার স্ত্রী সারাক্ষণ সেই যুবকের সাথে কথা বলতেন। বিষয়টি নিয়ে তাদের মধ্যে ঝগড়া ও তর্কবিতর্ক লেগেই থাকত। তার স্ত্রীর পরকীয়া নিয়ে দীর্ঘদিন থেকেই ঝামেলা চলছিল। এসব নিয়ে দুই পরিবারের লোকজনও বিচার সালিশে বসেছিলেন। কিন্তু পরকীয়া প্রেমিক ও সালমা আক্তারকে সেই পথ থেকে ফেরানো যায়নি।
তারা আরও জানিয়েছেন, হুমায়ুনের স্ত্রী সালমার ভাই ও ভাবী ওই ভবনেই থাকেন। তার বাবার বাড়িও বরিশালে। ফলে ভাবীর সাথে তার বেশ সখ্য। এই সুযোগে তার সংসারে যত কিছু ঘটত সবকিছু শেয়ার করতেন ভাবী মরিয়মের সাথে। সেই যুবকের সঙ্গে পরকীয়ার বিষয়টিও তার ভাবী মরিয়ম ভালোভাবে জানতেন এবং তাকে নানাভাবে সহযোগিতাও করতেন।
ভাড়াটে খুনিদের আনা হয় বরিশাল থেকে
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সালমা তার স্বামীর প্রতি বিরক্ত ছিলেন। কারণ তিনি ছিলেন পরকীয়া প্রেমে প্রধান বাধা। পাশাপাশি সম্প্রতি তার সেই প্রেম নিয়ে দুই পরিবারকে বসিয়ে বিচার সালিশের ব্যবস্থাও করেন হুমায়ুন। এতে চরম ক্ষুব্ধ হন সালমা। প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ খুঁজতে থাকেন। তার ভাবী মরিয়মকে সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন, হয় তার স্বামী থাকবে- না হয় তার দুই সন্তানকে নিয়ে তিনি আত্মহত্যা করবেন। হত্যার এমন হুমকি পেয়ে তার ভাবী বিষয়টি গুরুত্বের সাথে নেন। পাশাপাশি তার ভাবীও আবেগপ্রবণ হয়ে যান। স্ত্রী সালমা ও তার ভাবী মরিয়ম মিলে হত্যার মিশন সাজাতে থাকেন। তারা পরিকল্পনা করেন এবং সেই মোতাবেক মিশন সফল করতে দুই খুনিকে বরিশাল থেকে ভাড়ায় আনেন। এরপর তাদের রাখা হয় মরিয়মের বাসায়। হত্যার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তিন ভাড়াটে খুনি সাত দিন মরিয়মের বাসাতেই ছিলেন। মরিয়মের স্বামী প্রবাসী। ফলে তার বাসায় কেউ থাকতে না। এই সুযোগকে কাজে লাগান মরিয়ম। তার বাসাতেই দুই যুবক ও একজন নারীকে হত্যাকাণ্ডের কাজে সহায়তার জন্য রাখা হয়েছিল।
হত্যা মিশন সফল করতে দুই লাখ টাকায় চুক্তি
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা আরও জানিয়েছেন, পুলিশ কনস্টেবল হুমায়ুন করিব হত্যায় দুই লাখ টাকার চুক্তি হয়েছিল। খুনিদের সেই টাকা পরে দেওয়া হয়েছে কি না এবং পুলিশ সদস্যের স্ত্রী সালমা নাকি তার পরকীয়া প্রেমিকের দেওয়ার কথা ছিল তা জানা যায়নি। সেগুলোও পুলিশ গ্রেফতার সালমা ও মরিয়মের কাছ থেকে জানার চেষ্টা করছে। সালমার পরকীয়া প্রেমিক একটি নামকরা কোম্পানিতে চাকরি করেন। ফলে ধারণা করা হচ্ছে, এই টাকা তার প্রেমিকও দিয়ে থাকতে পারেন।
হত্যায় সরাসরি অংশ নেয় ছয়জন
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দীর্ঘদিন থেকেই হুমায়ুন কবির ও সালমার সংসারে পরকীয়া নিয়ে ঝামেলা চলছিল। ফলে সালমার একটাই কথা ছিল- হুমায়ুনকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে হবে। হুমায়ুনকে হত্যার বিষয়টি প্রথমে তার প্রেমিক ও ভাবী মরিয়মের সাথে শেয়ার করেন সালমা। এরপর আর কাদের রাখা যায় তাও তারা পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বরিশাল থেকে দুই যুবক, এক নারী ও ঢাকায় থাকা সালমা, মরিয়ম এবং সালমার প্রেমিক এই হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেন।
এ বিষয়ে ডিএমপির ডেমরা জোনের এডিসি আকরামুল হাসান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘নিশ্চিতভাবে ছয়জন এই হত্যাকাণ্ডে অংশ নেন। তাদের কেউ তাকে রশি দিয়ে চেপে ধরেছে, কেউ ঘুমের ওষুধ কিনে এনেছে, কেউ ঘরে তালা লাগিয়েছে এবং সব শেষে তারা হত্যার পর হুমায়ুন কবিরের মরদেহ তৃতীয় তলা থেকে নিচতলায় নামিয়েছে।’
পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘এই ঘটনায় এখন পর্যন্ত আমরা দুজনকে গ্রেফতার করেছি। বাকিদের খোঁজা হচ্ছে। তাদের গ্রেফতার করা হবে বলে আমরা আশাবাদী। তাদের গ্রেফতার করা গেলে জিজ্ঞাসাবাদে খুনিদের কত টাকা দেওয়া হয়েছিল এবং আর কারা কারা জড়িত ছিল তা বের হয়ে আসবে।’
ভাত খাওয়ানোর পর দেওয়া হয় লেবুর শরবত
গ্রেফতার সালমা ও তার ভাবী মরিয়ম পুলিশকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, ঘটনার রাতে বাইরে থেকে আসেন হুমায়ুন করিব। আগেই ভাতের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ গুঁড়ো করে মিশিয়ে দিয়েছিলেন স্ত্রী সালমা। এরপর সেই ভাত খেতে দেওয়া হয় হুমায়ুনকে। এই ভাত খাওয়ানোর পর তিনি আবোল-তাবোল বকতে শুরু করেন। ওই অবস্থায় সালমা তাকে লেবুর শরবত দেন। এর ফাঁকে ঘরের দরজায় তালা দিয়ে চলে যান তার ভাবীর কাছে। সেখানে আগে থেকে থাকা দুই যুবক, তার প্রেমিক, ভাবী ও ভাবীর ভাবী চলে আসেন তার বাসায়। তারা হুমায়ুনকে সবাই মিলে চেপে ধরেন। তাদের একজন রশি দিয়ে গলায় প্যাচ দেন। এতে হুমায়ুনের মৃত্যু নিশ্চিত হলে পরে তৃতীয় তলা থেকে মরদেহটি নিচতলায় নামান তারা। এরপর লাশটি সিঁড়ির সামনে ফাঁকা জায়গায় রেখে যে যার মতো করে চলে যান।
এমআইকে/জেবি