images

জাতীয়

সাবেক প্রতিমন্ত্রীর মদদে দখল হয় জুট মিলটি, চলে নজিরবিহীন লুটপাট

মোস্তফা ইমরুল কায়েস

২৬ এপ্রিল ২০২৫, ১২:৪০ পিএম

    • প্রতিমন্ত্রীর ভাই ও পোষ্যপুত্র সরাসরি জড়িত
    • বেকার হয়ে পড়েছেন ৮ হাজার শ্রমিক
    • বিএনপির প্রার্থী হওয়াই কাল হয় বাবলার
    • আবারও মিলটি চালু করতে চান মালিক
    • শ্রমিকরা চান পাওনা ও দখলকারীদের শাস্তি

খুলনা নগরীর অদূরে প্রায় ৮১ একর জায়গাজুড়ে ‍এজাক্স জুট মিলটির অবস্থান। প্রতি মাসে শ্রমিকদের বেতন ও যাবতীয় ব্যয় মিটিয়ে লাভেই চলছিল মিলটি। কিন্তু ২০১৫ সালের শুরুর দিকে মিলটিতে ঢুকে জোর করে দখলে নেন সাবেক শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুন্নুজান সুফিয়ানের ভাই শাহাবুদ্দিন ও পোষ্যপুত্র লিংকনসহ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। পরে সেটিকে বানানো হয় সার মজুদ রাখার গুদাম। পর্যায়ক্রমে উৎপাদন বন্ধ করে মিলটিতে চালানো হয় নজিরবিহীন লুটপাট। এই লুটপাটে বাদ যায়নি কারখানাটির কলকব্জা থেকে শুরু করে নাটবল্টুও।

দখলকারীরা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী হওয়ায় মামলা তো দূরের কথা সাধারণ ডায়েরিও করতে থানা গেট পর্যন্ত যেতে পারেননি জুট মিলটির মালিক। দীর্ঘ ১৪ বছর মামলা ও হামলার শিকার হয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছেন তিনি। এখন মিলটি বুঝে পেলেও সেটি অকেজো। পুরো কারখানাজুড়ে মাকড়সার জাল বুনেছে। লুটপাটে তার ক্ষতি হয়েছে প্রায় ২০০ কোটি টাকা। আর বেকার হয়ে পড়েছেন আট হাজার শ্রমিক।

সম্প্রতি খুলনা সদরের মিলটি সরেজমিনে ঘুরে শ্রমিক, এলাকাবাসী ও মালিকের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

শ্রমিকদের অভিযোগ, ২০১৫ সালের কোনো এক রাতে মিলটির ভেতরে পাহারা ও দেখভালের দায়িত্বে থাকা শ্রমিকদের ডেকে তোলা হয়। পরে অনুমতি ছাড়াই জোর করে ভেতরে ঢুকে পড়েন প্রতিমন্ত্রীর ভাই শাহাবুদ্দিন ও পোষ্যপুত্র লিংকন। সেই সময় তাদের সাথে ছিল আরও ২০০ লোকজন। রাতের আঁধারে মিলের দায়িত্বে থাকা সবাইকে বের করে দিয়ে দখলে নেন তারা। এরপর থেকে তাদের দখলেই ছিল।

Jute2

কারখানাটির শ্রমিকদের অভিযোগ, সাবেক শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুন্নুজান সুফিয়ানের মদদেই তারা এমন করেছিলেন। যার ফলে স্থানীয় লোকজন ও শ্রমিকরাও কোনো প্রতিবাদ করতে পারেননি। ২০১৫ সালে দখলের পর মিলটির যাবতীয় জিনিসপত্র ও মালামাল লুটপাট হতে শুরু হয়। সেই থেকে ২০২৪ এর আগস্ট পর্যন্ত মিলের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি, মটার এবং মটারের ভেতরে থাকা তামার তার লুট ও রাতের আঁধারে চুরি করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এই সময়ে পুরো মিল এলাকাটিকে সার মজুদের আস্তানায় রূপান্তর করা হয়েছিল। ইউরিয়া সার রাখায় যন্ত্রপাতিগুলো অধিকাংশ নষ্ট হয়ে যায়।

আরও পড়ুন

তদন্তে প্রমাণ মেলেনি, তবু টিপকাণ্ডে চাকরি হারান নাজমুল

জানা গেছে, মিলটি ২০০৩ সালে বাদল ঘোষ নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে কিনে নেন বর্তমান মালিক কাওসার জামান বাবলা। তখন থেকে তিনি টানা ১২ বছর পরিচালনা করেন। কিন্তু ২০১৪ সালের এপ্রিলে শ্রমিকদের অসহযোগিতা ও নানা ষড়যন্ত্র বুঝে মিলটিতে উৎপাদন চালাতে না পেরে বন্ধ করে দেন মালিক। কিন্তু সেই ধ্বংস হতে বসা মিলটি এখন চালু করা বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ মিলটির অধিকাংশ মেশিনারিজ যন্ত্রপাতি খুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মিলটিতে প্রায় আড়াইশ মেশিন রয়েছে। যেগুলোর বেশির ভাগই পাকিস্তান আমলে জাপান থেকে আনা হয়েছিল।

এ্যাজাক্স মিলে ১২ বছর কাজ করেছেন শ্রমিক হারুন। তিনি জানান, তিনি একসময় এই কারখানাটিতে কাজ করতেন। কিন্তু ২০১৪ সালের পর থেকে তিনি বেকার। তারা শ্রমিকরা যেখানে থাকেন সেখানে আগে বিদ্যুৎ সংযোগ ছিল কিন্তু কারখানা বন্ধের পর থেকে সেই সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। 

jute5

শ্রমিকরা বলছেন, খুলনার মীরেরডাঙ্গায় গড়ে ওঠা এজাক্স জুট মিলটি চিহ্নিত সন্ত্রাসী সাজ্জাদুর রহমান লিংকন ও তার দলবলসহ ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে দখল করে নেয়। এতে ইন্দন দেন সাবেক শ্রম প্রতিমন্ত্রী বেগম মুন্নুজান সুফিয়ান ও তার ভাই শাহাবুদ্দিন। তাদের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় বিদেশে পণ্য রফতানি বাধাগ্রস্ত করে মিলটি বন্ধ করতে বাধ্য করেন তারা।

বেকার ৮ হাজার শ্রমিকের মানবেতর জীবন

শ্রমিকরা জানান, মিলটিতে তিন শিফটে প্রায় আট হাজার শ্রমিক কাজ করতেন। রাত-দিন সারাক্ষণ মিলটি চালু থাকত। এক শিফটের লোকজনের ডিউটি শেষ হলেই আরেক টিম এসে যোগ দিতো। মিলের কারণে সেই এলাকার লোকজনের ভাগ্য বদলাতে শুরু করেছিল। কিন্তু এক রাতেই সেই স্বপ্নের মৃত্যু ঘটিয়ে দেয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।

আব্দুস সোবহান নামে একজন শ্রমিক বলেন, ‘২০১৬ সালের পর থেকে বিভিন্ন সময় মিলের গুরুত্বপূর্ণ মালামাল চুরি ও লুটপাট হয়। মন্নুজান সুফিয়ানের ছেলে হিসেবে সবাই চিনতো লিংকনকে। সেই সঙ্গে প্রতিমন্ত্রীর ভাইও এসব চুরির সঙ্গে জড়িত। কিছুদিন পর পর মিলের মধ্যে বড় বড় ট্রাক নিয়ে প্রবেশ করতো, মিলের ভেতরে থাকা বিভিন্ন মোটর, অন্যান্য ইলেকট্রিক যন্ত্রাংশ চুরি করে নিয়ে যেত। এখন তো মিল এক প্রকার ধ্বংস হয়ে আছে।’

আরও পড়ুন

মাদক অধিদফতরে বহাল ‘আওয়ামী চক্র’, পদোন্নতি পেতে মরিয়া

এদিকে ৫ আগস্টের পর মিলটি পুনরুদ্ধার করেছেন কাউসার জামান বাবলা। তার বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসনের মিলে প্রবেশের নিষেধাজ্ঞাও প্রত্যাহার হয়েছে। এতে আবারও মিলটি চালুর ব্যাপারে আশাবাদী হয়ে উঠছেন শ্রমিকরা।

মিলের শ্রমিক নিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘গত ১০ বছর ধরেই আমরা অসহায় হয়ে আছি। তেমন কোনো কাজ আমরা শিখিনি। জুট মিলে কাজ করেছি ৩০/৩৫ বছর। এটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমরা অন্য কাজও করতে পারছিলাম না। মালিক মিল বুঝে পাওয়ায় আমরাও আশা করছি মিলটি তিনি চালু করবেন। আমরা আবারও এই মিলে উৎপাদন শুরু করবো।’ 

Jute3

শ্রমিক ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সালে মালিক কাওসার জামান বাবলা মিলটি যখন কোনোভাবে দখলে নিতে পারছিলেন না তখন সেই এলাকার মান্নান নামে এক ব্যক্তিকে বুঝিয়ে দেন এই শর্তে যে, তিনি শ্রমিকদের বকেয়া বেতন পরিশোধ করবেন, পাশাপাশি মিলটি চালু করবেন। কিন্তু সেই মান্নান তা করতে ব্যর্থ হন। পরে শ্রমিকরা মালিকের বিরুদ্ধে আদালতে একটি মামলা করলে মালিককে কিছুদিন কারাগারে থাকতে হয়। এরপর তখন জেলা প্রশাসন ও শ্রম অধিদফতর থেকে জানানো হয়, শ্রমিকদের বকেয়া বেতন পাওনা বুঝে না দেওয়া পর্যন্ত মিলটি চালু করতে পারবেন না মালিক। এরপর মালিক বাবলা ২০১৫ উচ্চ আদালতে রিট করেন। সেই রিটের রায় তার পক্ষে আসে। কিন্তু সেই সময় তৎকালীন জেলা প্রশাসন তাকে মিলটি চালু করতে না দিয়ে দখলকারীদের সুবিধা করে দেন। এই সুযোগে দখলকারীরা সেখানে সারের ব্যবসা খুলে বসে। ফলে পুরো মিলটি ইউরিয়া সারের বিক্রিয়ায় মেশিনারিজ যন্ত্রপাতিগুলো নষ্ট হতে শুরু করে। এছাড়া মিলটি তাদের দখলে থাকায় প্রতি রাতে চলে লুটপাটের মহোৎসব।

আরও পড়ুন

ভারতীয় নাগরিক হয়েও কলেজ অধ্যক্ষ পদে বহাল!

জানা গেছে, মিলটি পুনরুদ্ধার ও পরিবেশ রক্ষায় মজুদকৃত রাসায়নিক সার অপসারণের ব্যাপারে ২০১৯ সালের ১২ মার্চ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জন নিরাপত্তা সচিব, ২৩ মে খুলনা জেলা প্রশাসক ও ১ জুন পুলিশ কমিশনার বরাবর লিখিত আবেদন করেন মিলটির মালিক। কিন্তু লিংকন ও তার সন্ত্রাসী বাহিনী এতই শক্তিশালী ছিল যে, মালিকের আবেদনে প্রশাসন কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি।

এ বিষয়ে খুলনা জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলামকে প্রায় মাসখানেক ধরে একাধিকবার ফোন করে এবং খুদে বার্তা পাঠিয়েও তার বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি। 

রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার মালিক

মিলের মালিক কাওসার জামান বাবলা বলেন, ২০১৪ সালে যখন ফ্যাসিস্ট সরকার বিনা ভোটে ক্ষমতায় আসে, তখন থেকেই আমার মিল পরিচালনায় নানামুখী বাধার সম্মুখীন হতে হয়। আমার মিলের সিবিএ (শ্রমিক সংগঠন) ঘরে অধিকাংশ শ্রমিক ছিল শ্রমিক লীগের অন্তর্ভুক্ত। ফলে এই সংগঠনের নেতাকর্মীরা বিভিন্নভাবে উৎপাদন ব্যাহত করত। তারা উদ্দেশ্যমূলকভাবে গতি কমিয়ে কাজ করত, কাজের মান খারাপ রাখত, কাজে ফাঁকি দিত, এমনকি কাজ না করেই টাকা দাবি করত। এই সব কর্মকাণ্ডের কারণে বিদেশে পণ্য রফতানিতে দেরি হতো। সরকারি পাটকলগুলোতে তখন ১৫-১৬ সপ্তাহ পর্যন্ত বেতন বকেয়া থাকলেও, আমার মিলে মাত্র এক সপ্তাহ বেতন বকেয়া থাকলেই শ্রমিকরা ভাঙচুর ও ধ্বংসযজ্ঞ চালাতো।

Jute4

মালিক বলেন, এসব কারণে আমি বাধ্য হয়ে ২০১৪ সালের এপ্রিল মাসে মিলটি বন্ধ করে দিই। এরপর মিলটি বিক্রির উদ্যোগ নেই। জনঐক্যের আব্দুল মান্নান তালুকদারের সঙ্গে একটি চুক্তি করি, যাতে সে সব দায়-দেনাসহ মিলটি কিনে নেবে। কিন্তু সে কোনো দেনা শোধ করেনি। সেই সময় ব্যাংকের দেনা ছিল প্রায় ৭০ কোটি টাকা, যা বর্তমানে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০০ কোটি টাকায়। বিদ্যুতের বকেয়া প্রায় ২০ কোটি টাকা।

আরও পড়ুন

এত অভিযোগ সত্ত্বেও বহাল ‘রেহানা-ঘনিষ্ঠ’ পাইলট ইশতিয়াক!

মালিক বাবলা বলেন, আমি যখন মান্নান তালুকদারকে মিলটি বুঝিয়ে দিই, তখন মিলটি সম্পূর্ণ চালু অবস্থায় ছিল — শুধু সুইচ দিলেই চালু হতো। কিন্তু ৫ আগস্ট মিল এলাকায় গিয়ে দেখি মিলের সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেছে। দামি যন্ত্রপাতি, বাউন্ডারির ইট, ভবন, বাংলো— কিছুই অবশিষ্ট নেই। এমনকি দরজার চৌকাট পর্যন্ত খুলে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। আমার সঙ্গে মান্নান তালুকদারের একটি রেজিস্ট্রেশনবিহীন চুক্তি ছিল, যার কোনো আইনগত বৈধতা নেই। তার বিরুদ্ধে আমি ২০১০ সালে খুলনার যুগ্ম জেলা জজ আদালতে ৯৬ কোটি টাকার একটি ক্ষতিপূরণ মামলা করেছি, যা বর্তমানে বিচারাধীন। আমি যেহেতু এই মিলের মালিক, তাই ব্যাংক, শ্রম আদালত, বিদ্যুৎ অফিস — সব জায়গায় আমাকে আসামি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।

কাওসার জামান বাবলা রংপুর সিটি করপোরেশনে ২০১২ ও ২০১৭ সালে দুইবার বিএনপির ধানের শীষ প্রতীকে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তিনি মনে করেন, এটাই তার জন্য কাল হয়েছে। তিনি রাজনৈতিক এই প্রতিহিংসার বিচার দাবি করেছেন।

এমআইকে/জেবি