কাজী রফিক
০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৯:০৫ এএম
🔹 সাড়ে ছয় মাসে প্রাণ গেছে তিনজনের
🔹 হাসপাতালে চারজন
🔹 সক্রিয় বড় চারটি মাদক সিন্ডিকেট
🔹 সংঘর্ষে ব্যবহার হচ্ছে পুলিশের অস্ত্র
🔹 ক্যাম্পে সেনা অভিযান চায় সাধারণ মানুষ
রাজধানীর জেনেভা ক্যাম্পে বসবাসকারী উর্দুভাষীদের সংঘর্ষ-সহিংসতায় জড়ানোর ঘটনা মাঝেমধ্যেই আসে গণমাধ্যমে। কখনো বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে স্থানীয় লোকজন এবং পুলিশের সংঘর্ষের খবর আসে। আবার কখনো নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রাণঘাতী হয়ে ওঠে। এর মধ্যে মাদক কারবারিদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে বেশি। ফলে প্রায়ই উত্তেজনা ও থমথমে অবস্থা বিরাজ করে উর্দুভাষী ক্যাম্পটিতে।
গত শবে বরাত থেকে বেশ কয়েকবার সংঘর্ষ হয়েছে রাজধানীর জেনেভা ক্যাম্পে। উর্দুভাষীদের এই আবাসস্থলে কেবল মাদক বিক্রিকে কেন্দ্র করে চলা সংঘর্ষে এরইমধ্যে তিনজনের প্রাণহানি ঘটেছে৷ যার দুইজনই গুলিতে মারা গেছেন। অন্যজন প্রাণ হারান মাদক কারবারিদের ছোড়া পেট্রোল বোমায়।
এ নিয়ে প্রায়ই উত্তেজনা দেখা দেয়। জেনেভা ক্যাম্পের সাধারণ মানুষ এই মাদক বিক্রেতাদের হাত থেকে এখন রেহাই চান। তবে মাদক সিন্ডিকেট শক্তিশালী হওয়ার সরাসরি মুখ খুলতে পারছেন না কেউ।
নামপরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে জেনেভা ক্যাম্পের একজন বাসিন্দা ঢাকা মেইলকে বলেন, 'মাদক যারা বিক্রি করেন, তাদের হাতে আসলে আমরা জিম্মি। তাদের লোকবল আছে, টাকা আছে, ক্ষমতাও আছে। তাই তাদের সঙ্গে আমরা পারি না।’
মাদক কারবারিদের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ায় এরইমধ্যে অনেকে বিপদে পড়েছেন বলেও জানিয়েছেন ক্যাম্পের বাসিন্দারা। জেনেভা ক্যাম্পের একজন বাসিন্দা বলেন, ‘ভুঁইয়া সোহেল গ্রুপের বিপক্ষে কথা বললে তারা লোকজনকে উল্টো মাদক দিয়ে ধরিয়ে দেয়। এমন ঘটনা অনেক আছে৷ তাই কেউ কিছু বলে না।’
ক্যাম্পের বেশ কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগে ৩২ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর সৈয়দ নূর ইসলাম রাষ্ট্রনের শেল্টারে ছিলেন জেনেভা ক্যাম্পের মাদক গডফাদার ভুইয়া সোহেল। ক্যাম্প বাসিন্দাদের একাংশের দাবি, প্রতিদিন দুই লাখ টাকা হারে চাঁদা নিতেন কাউন্সিলর রাষ্ট্রন। নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা পায় পুলিশের অনেক সদস্যও।
সরকার পতনের পর পালিয়ে যান কাউন্সিলর। যাদের ছায়াতলে জেনেভা ক্যাম্পে রমরমা বাণিজ্য, তারা না থাকায়, এবার আওয়াজ তুলতে চান ক্যাম্পের ভেতরে ও আশপাশে বসবাসকারীরা।
হুমায়ুন রোড এলাকার বাসিন্দা ইরফান আহমেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘হয়, জেনেভা ক্যাম্প এখান থেকে সরিয়ে দেয়া হোক। অথবা এখানকার মাদক কারবারিদের নির্মূল করা হোক। জেনেভা ক্যাম্পে একটা সেনা অভিযান এখন খুবই প্রয়োজন।’
ইরফান আহমেদের মতোই সেনাবাহিনীর ওপর আস্থা রাখছেন প্রসাধনী ব্যবসায়ী জুয়েল রানা। বাবর রোড এলাকার এই বাসিন্দা বলেন, ‘ক্যাম্পটা এই এলাকার জন্য একটা অভিশাপ। আমাদের ছেলেরা ছোট থেকে মাদক দেখে বড় হচ্ছে। চোখের সামনে মাদক বিক্রি হয়। সেনাবাহিনীর মাধ্যমে ক্যাম্পে একটা চিরুনী অভিযান খুবই দরকার।’
জেনেভা ক্যাম্পে সংঘাত কেন?
জেনেভা ক্যাম্প এলাকা ঘুরে জানা যায়, বাংলাদেশে ১১৫টি উর্দুভাষী ক্যাম্পের মধ্যে সবচেয়ে বড় ক্যাম্প হিসেবে পরিচিত জেনেভা ক্যাম্প। বলা হয়, এই ক্যাম্পটিতে যাদের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে, উর্দুভাষীদের মধ্যেই তাদের নিয়ন্ত্রণ চলে। ফলে জেনেভা ক্যাম্পকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে মরিয়া বিহারি নেতাদের একাংশ।
জেনেভা ক্যাম্পের সকল দিক দেখাশোনার জন্য রয়েছে কমিটি। তবে সেই কমিটির অনেকে মাদক কারবারে জড়িত। জেনেভা ক্যাম্পের বর্তমান চেয়ারম্যান এস কে গোলাম জিলানী। তার ছেলে এস কে রাব্বানী নিজেই মাদক কারবারি বলে ক্যাম্পের অনেকে অভিযোগ করেছেন। যার বিরুদ্ধে রয়েছে একাধিক মাদক মামলা।
ক্যাম্পের কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, ক্যাম্পের বর্তমানে সবচেয়ে বড় মাদক কারবারি ভুইয়া সোহেল। তার সঙ্গে রয়েছেন তার ভাই রানা ও টুনটুন। এই পারিবারিক সিন্ডিকেট মূলত হেরোইন কারবারি। ইয়াবার জায়গা দখল করে সেখানে হেরোইনের রাজত্ব গড়েছেন ভুইয়া সোহেলরা। তাদের সেই রাজত্ব ভাঙতে চান চুয়া সেলিম। আগের মতোই জেনেভা ক্যাম্পে নিয়ে আসতে চান ইয়াবার সাম্রাজ্য। ইয়াবা ও হেরোইন কারবারিদের এই দ্বন্দ্বেই মূলত ক্যাম্পে সংঘাত অব্যাহত রাখছে।
জানা যায়, ভুইয়া সোহেল পরিবারের সঙ্গে মাদক কারবার ও সংঘর্ষে জড়ান আরও কয়েকজন। যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সৈয়দপুরীয়া পরিবার। সৈয়দপুর থেকে এসে জেনেভা ক্যাম্পে ঘাঁটি তৈরিকারীরাই সৈয়দপুরীয়া নামে পরিচিত। এ গোষ্ঠিত অন্তত ৩০টি পরিবার ক্যাম্পের পার্সোনাল হাট এলাকায় বসবাস করে৷ তাদের মধ্যে বম, বাবু ও নওশাদ ভুইয়া সোহেলের হয়ে কাজ করছে এবং সরাসরি সংঘর্ষে অংশ নিয়েছে।
জেনেভা ক্যাম্পে একক আধিপত্য গড়ে তোলা ভুইয়া সোহেল সংঘর্ষের জন্য লোক নিয়ে আসছেন মিরপুর ক্যাম্প থেকেও। আগস্টের সংঘর্ষের ভিডিও চিত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মোহাম্মদ আলী নামে একজন ব্যক্তি ভুইয়া সোহেল গোষ্ঠির হয়ে সশস্ত্র সংঘাতে জড়িয়েছেন।
বিহারী ক্যাম্পের সাধারণ মানুষের ভাষ্য, মোহাম্মদ আলী জেনেভা ক্যাম্পের বাসিন্দা নন। তিনি মিরপুর ১২ নং ক্যাম্পে বসবাস করেন।
এছাড়া সাম্প্রতিক সংঘর্ষের ভিডিওতে পুলিশের শর্টগান দিয়ে গুলি ছুড়তে দেখা গেছে একজনকে। তার পরিচয়ও নিশ্চিত হয়েছে ঢাকা মেইল। ওই ব্যক্তির নাম কলিম জাম্বু। তিনি নিজেও একজন মাদক কারবারি।
এই হেরোইন সিন্ডিকেটের বিপরীতে রয়েছেন অন্তত ৬০টি মামলার আসামি ইয়াবা কারবারি চুয়া সেলিম। তার সঙ্গে যোগ দিয়েছেন আরেক ইয়াবা কারবারি পারমনু, শাহ আলম। এরমধ্যে শাহ আলম বুধবার ভোরে ভুইয়া সোহেলদের ছোড়া গুলিতে আহত হন। তিনি বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।
বিরিয়ানি ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত বোবা বিরিয়ানির মালিক পক্ষ সরাসরি যোগ দিয়েছেন সংঘর্ষে। বোবা বিরিয়ানির মালিক আলতাফ এবং তার ছেলে ইরফান এই সংঘর্ষে সরাসরি জড়িয়েছেন দুই মাস আগেই।
এ বিষয়ে মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলী ইফতেখার বলেন, বুধবার জেনেভা ক্যাম্পে সংঘর্ষের ঘটনায় যারা গুলিবিদ্ধ হয়েছে, আমরা হাসপাতালে পুলিশ মোতায়েন করে তাদের নিরাপত্তা দিয়েছি। এখন পর্যন্ত কেউ থানায় অভিযোগ করেনি। অভিযোগ পেলে আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা নেব।
ওসি আরও জানান, জেনেভা ক্যাম্পে অভিযান করতে মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ যথেষ্ট নয়। ফলে এই ক্যাম্পটিতে যৌথ বাহিনীর অভিযান প্রয়োজন। যা দ্রুতই করা হবে।
কারই/এমআর