শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪, ঢাকা

বিরিয়ানির দোকানের আড়ালে মাদক কারবার ও ছিনতাই

কাজী রফিক
প্রকাশিত: ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ০৩:৪৭ পিএম

শেয়ার করুন:

বিরিয়ানির দোকানের আড়ালে মাদক কারবার ও ছিনতাই

উর্দুভাষীদের বসবাসের স্থান হিসেবে পরিচিত রাজধানীর মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্প। তবে এই ক্যাম্পকে রাজধানীবাসীর কাছে ভিন্নভাবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে জেনেভা ক্যাম্পের কাচ্চির দোকান কামাল বিরিয়ানি ও বোবা বিরিয়ানি। শুধু কাচ্চি বিরিয়ানির জন্যই বিখ্যাত নয় দোকান দুটি। বিরিয়ানির দোকানের আড়ালে মাদক ও ছিনতাইয়ের বড় নেটওয়ার্ক করে তুলেছে প্রতিষ্ঠান দুটি।

কামাল বিরিয়ানির আড়ালে মাদক কারবার


বিজ্ঞাপন


ঢাকা মেইলের মাসব্যাপী অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কামাল বিরিয়ানি জেনেভা ক্যাম্পের অন্যতম জনপ্রিয় জায়গা। বিহারিদের মধ্যে তো বটেই, এর জনপ্রিয়তা আছে বাঙালিদের মধ্যেও। ১৪০ টাকায় ফুল প্লেট গরুর মাংসের কাচ্চির ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়েছে পুরো রাজধানীতে।

কামাল বিরিয়ানির মূল ব্যবসায়ী কামাল। তবে এখন সেই ব্যবসা পরিচালনা করেন কামালের ছেলে ইরফান৷ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিরিয়ানির দোকানের বিভিন্ন প্রচারণায়ও নিয়মিত দেখা যায় তাকে। তবে এই বিরিয়ানির পেশার আড়ালে তার রয়েছে ভিন্ন এক পেশা।

বিরিয়ানি বিক্রেতা ইরফান জেনেভা ক্যাম্পের শীর্ষ মাদক কারবারি ভুঁইয়া সোহেলের হয়ে কাজ করেন৷

ক্যাম্পের ব্লক ৮, ব্লক ৬ ও ৮ এর মাঝে গোবর গলিতে তার অবস্থান। মাদক বিক্রির পাশাপাশি তার নিজেরও রয়েছে কয়েকজন সেলসম্যান।


বিজ্ঞাপন


মাদকের আধিপত্যকে কেন্দ্র করে জেনেভা ক্যাম্পের সাম্প্রতিক সংঘর্ষের ঘটনায় মোহাম্মদপুর থানা পুলিশের করা মামলায় ১০নং আসামি ইরফান।

ইরফানের রয়েছে একটি গ্যাং। ওই গ্যাংয়ের সদস্য— মাসুয়া সাঈদের মেয়ে জামাই আমিন, ইরফানের মামা সাঈদ ওরফে ফর্মা সাঈদ, ভিকি, সামিরসহ বেশ কয়েকজন। গ্যাং সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে সাম্প্রতিক সংঘাতে সশরীরে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছেন তিনি।

 

নাপিতের দোকান পরিচালনাকারী জেনেভা ক্যাম্পের একজন বাসিন্দা ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘কামাল বিরিয়ানির ছেলে ইরফান তো নিজেই মাদক ব্যবসায়ী। সে এখন নিজে মারামারি করতেছে। বিশাল বিশাল চাপাতি নিয়ে তার লোকজন দৌড়াদৌড়ি করে। আমরা তো কিছু বলতে পারি না।’

সূত্র জানিয়েছে, কামাল বিরিয়ানির একাধিক কর্মচারী নিজেদের চাকরি টিকিয়ে রাখতে ইরফানের নেতৃত্বে মাদক কারবারে সম্পৃক্ত হতে হচ্ছে৷ এছাড়া ইরফান মাদক কারবারিদের ব্যবসার স্বার্থে অর্থ বিনিয়োগ করছেন বলেও জানিয়েছেন জেনেভা ক্যাম্পের বাসিন্দারা।

আরও পড়ুন

জেনেভা ক্যাম্পে মাদকের ‘ফেরিওয়ালা’ পাঁচ শতাধিক
প্রতিদিন অর্ধ কোটি টাকার ইয়াবা-হেরোইন বিক্রি

তবে এ বিষয়ে কিছু জানেন না বলে জানিয়েছেন ইরফানের বাবা  কামাল। ঢাকা মেইলের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ভুইয়া সোহেলের সঙ্গে আমার ছেলের কোনো সম্পর্ক নাই।

ইরফানের সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে যদি এটার ভেতরে থাকে, আমি আমার ছেলেকে প্রশাসনের হাতে দিয়ে দেব। আমার যে ব্যবসা, আল্লাহ দিলে আমার প্রতিদিন ১০ হাজার, ১৫ হাজার, ২০ হাজার টাকা আয় আছে। আমি যে টাকা কামাই করি, আল্লাহ দিলে আমি তো এই টাকাই রাখতে পারি না। আমি জানতে চাইতাছি, আমার ছেলে এই রকম কেমনে হইলো? আমি প্রশাসনকে বলতেছি, আমার ছেলে লইয়া যাক (নিয়ে যাক)। আমার ব্যবসার কোনো ক্ষতি যেন না হয়।’

বোবা বিরিয়ানির আড়ালে ছিনতাই-কিশোর গ্যাং

জেনেভা ক্যাম্পের আরেক নামকরা কাচ্চির দোকান ফাইজানে মদিনা, যা বোবা বিরিয়ানি নামে পরিচিত। প্রতিষ্ঠানটির মালিক আলতাফ। তার আপন ভাই মো. কামরান। তার বিরুদ্ধে আছে নানান অভিযোগ।

জেনেভা ক্যাম্পের আশপাশের এলাকায় ছিনতাইকারী চক্রের নিয়ন্ত্রক কামরান। ছিনতাইয়ের পাশাপাশি কিশোর গ্যাংয়ের নেতৃত্ব দেন তিনি। নিজে ব্যবসা না করলেও নিজ কর্মীবাহিনী দিয়ে জেনেভা ক্যাম্পে মাদক সরবরাহ করেন কামরান।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি ও তৎপরতার মুখে সম্প্রতি ক্যাম্প ছেড়েছেন তিনি। থাকেন মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যান এলাকায়। সেখান থেকেই কিশোর গ্যাং ও ছিনতাইকারী নিয়ন্ত্রণ করেন।

Geneva_Camp_Drug---03--Inner-01

কামরানের হয়ে কাজ করেন— শাকিল, বালাম, পারভেজ। তাদের নিয়ন্ত্রণে আছেন একাধিক সেলসম্যান।

সূত্র জানিয়েছে, কামরানের সরবরাহ করা মাদক কেউ বিক্রি করতে না চাইলে জোরপূর্বক বিক্রি করানোর ঘটনাও আছে। পারিবারিকভাবে জেনেভা ক্যাম্পে প্রভাবশালী একটি পরিবার বোবা বিরিয়ানি কর্তৃপক্ষ। ফলে তাদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহসও পায় না কেউ।

এ বিষয়ে জানতে কামরানের নাম্বারে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।

পাকিস্তানি পান দোকান

ক্যাম্পের ‘বি’ ব্লকে পাকিস্তানি পান দোকানের গোড়াপত্তন করেন মান্ডা। পান দোকানের আড়ালে মান্ডার ছেলে রাজু গড়ে তোলেন ইয়াবার সাম্রাজ্য। সম্প্রতি বহু মামলার আসামি রাজু গ্রেপ্তার হন। তবে মাদকের হাত বদল থেমে নেই। তার জায়গায় মাদকের পসরা সাজিয়ে বসেছেন রাজুর ভাই রাসেদ ও তার মা রেহানা।

Geneva_Camp_Drug---03--Inner-02

সিএনজিচালিত অটোরিকশার গ্যারেজ

সিএনজিচালিত অটোরিকশার গ্যারেজ মালিক হারুন ওরফে দুলারা। সিএনজির গ্যারেজের আড়ালে মাদক সরবরাহ করেন তিনি। ইয়াবা গডফাদার ‘চুয়া সেলিমে’র বেশ কয়েকটি সিএনজি দুলারার গ্যারেজে থাকে৷ এসব সিএনজির মাধ্যমে মাদক আনা-নেওয়া হয়।

ক্যাম্প সূত্র জানিয়েছে, দুলারা নিজেও একজন ইয়াবা কারবারি। তার নামে মাদক মামলা আছে৷ তবে দুলারার মূল কারবার সিএনজিচালিত অটোরিকশার মাধ্যমে মাদক বহন করা। দুলারার ইশারায় সিএনজিতে মাদক বহন করেন আফজাল, আজাদ ও মাকসুদসহ কয়েকজন।

জেনেভা ক্যাম্পের বাসিন্দাদের দ্বৈত পেশা ও চরিত্রের বিষয়ে অবগত সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরাও।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল‍্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘জেনেভা ক্যাম্পের সাথে লাগোয়া বিভিন্ন খাবারের দোকান, মুদি দোকানসহ অন্যান্য দোকানের কতিপয় মালিকের বিরুদ্ধে মাদক বিক্রি, সেবনের পরিবেশ তৈরি করে দেওয়া এবং মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। জেনেভা ক্যাম্প ঘিরে মাদক বাণিজ্য, ছিনতাই, চুরি, অবাধ যৌনাচারসহ আরও বেশকিছু অপরাধ প্রতিনিয়ত ঘটছে। অনেককে যে কাজে দেখা যায় প্রকৃতপক্ষে সেই কাজের আড়ালে অপরাধমূলক কাজ পূর্ণ উদ্যমে চালিয়ে যাচ্ছেন। রাতের আঁধারে বা গোপনে যে কাজ করছেন এটাই মূলত তাদের অর্থ উপার্জনের মূল কাজ।’

তিনি বলেন, ‘একটি এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে খাবার বিক্রির দোকানের মালিকদের কেউ কেউ, সিএনজিচালকদের কেউ কেউ মাদক বিক্রিসহ নানা ধরনের অপরাধ করে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য অনেকে থাকলেও কার্যত দেখার কেউ নেই। এছাড়া সংশ্লিষ্ট এলাকায় বসবাসকারী অন্যান্য মানুষদের সর্বদা তটস্থ থেকে অস্থিরতার মধ্যে জীবনযাপন করতে হয়। স্বাধীনভাবে চলাফেরা করা ও নিরাপত্তার সাথে জীবনযাপনের প্রয়োজনগুলো পূরণ করার ক্ষেত্রে সবসময় এক ধরনের অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা ও অনিরাপদ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়।’

কারই

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর