images

জাতীয়

ইন্টারনেট বিড়ম্বনায় রাইড শেয়ারিংয়ের আয়ে বড় ধাক্কা

বোরহান উদ্দিন

৩০ জুলাই ২০২৪, ০৯:৩২ পিএম

  • খ্যাপওয়ালাদের পোয়াবোরো, অ্যাপওয়ালের মাথায় হাত
  • তিন দিনে হয়েছে এক দিনের আয়
  • সবাই চুক্তিতে চলায় নিরাপত্তা ঝুঁকি বেড়েছে চালক-যাত্রীর
  • খাবার পৌঁছে দিতে ডেলিভারিম্যানদের পড়তে হয়েছে সীমাহীন দুর্ভোগে

দেশে রাইড শেয়ারিং সেবা চালু হওয়ার শুরু থেকেই মোটরসাইকেলে যাত্রী বহন করে বাড়তি আয় করেন শরিফ কাজী। শুরু থেকেই অ্যাপে যাত্রী আনা-নেওয়া করেন তিনি। এতে যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দা এই যুবকের বেশ ভালোই চলছিল দিনকাল। কিন্তু সম্প্রতি কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে রাজধানীসহ সারাদেশে ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় তার আয় রোজগারে বড় ধাক্কা লেগেছে। পরে টিকে থাকতে বাধ্য হয়ে অন্যদের মতো খ্যাপে (চুক্তিতে যাত্রী নেওয়া) যাত্রী তুলতে শুরু করেন তিনি।

তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মোবাইল ইন্টারনেট চালু হলেও বিড়ম্বনা কাটেনি। কারণ একদিকে সড়কে মানুষ কম। অন্যদিকে ধীরগতির কারণে আগের মতো অ্যাপে যাত্রী মিলছে না। ইন্টারনেট সেবা পুরোপুরি চালু হলে অ্যাপেই ফিরবেন বলে আশা শরিফের।

রাজধানীর পল্টন মোড়ে যখন শরিফ কাজীর সঙ্গে প্রতিবেদকের কথা হয় তখন সেখানে যাত্রীর অপেক্ষায় কম হলেও ২০ জন মোটরসাইকেল চালক। যাদের মধ্যে হাতেগোনা কয়েকজন অ্যাপে যাত্রী টানেন বলে জানা গেছে। কেউ আবার অ্যাপের পাশাপাশি খ্যাপেও যাত্রী টানছেন। এজন্য তারা রাইড শেয়ারিং কোম্পানির বাড়তি কমিশন, নিত্যনতুন নিয়মনীতি চালুকে দুষছেন।

আরও পড়ুন

অনলাইন ব্যবসায় ধস, উদ্যোক্তাদের মাথায় হাত

তবে চলমান অস্থিরতা এবং ইন্টারনেটবিহীন অবস্থায়ও আয় বন্ধ হয়নি পুরোপুরি চুক্তিতে মোটরসাইকেলে যাত্রী টানা চালকদের। যদিও কারফিউর শুরুর দিকে যাত্রী একেবারেই কম থাকায় তাদের আয় কমেছে অর্ধেকেরও বেশি। এরপরও খুব বেশি আক্ষেপ নেই তাদের। কারণ অ্যাপ না থাকায় আয়ের পুরোটাই নিজের।

এমনই একজন জামালপুরের মিজানুর রহমান। ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, ‘কন্ট্রাক্টে গাড়ি চালাই। ঝামেলা নাই। মাঝেমধ্যে পুলিশের ঝামেলায় না পড়লে যা কামাই করি সবটাই নিজের থাকে। ইন্টারনেট না থাকলেও কোনো সমস্যা হয়নি।’

Riding

অবশ্য মাঠের রাইডাররা যখন আয়ের কষ্টের কথা বলছেন তখন রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে বলা হচ্ছে, ইন্টারনেট না থাকায় তাদের আয় তলানিতে নেমেছিল। ধীরে ধীরে এখন স্বাভাবিকের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করছেন।

মোবাইল ফোন অ্যাপসভিত্তিক গাড়ি শেয়ার নেটওয়ার্ক ‘উবার’ ও ‘পাঠাও’র কার্যক্রম দেশে শুরু হয় ২০১৬ সালে। এরপর থেকে সড়কে যানজট এড়িয়ে দ্রুত ও সহজে গন্তব্যে পৌঁছাতে জনপ্রিয় হয়ে উঠে এ রাইড শেয়ারিং। কেউ পুরোপুরি পেশা হিসেবে নিয়েছেন। কেউ আবার বাড়তি আয়ের মাধ্যম হিসেবে চাকরি কিংবা অন্য কাজের ফাঁকে রাইড শেয়ার করছেন।

যাত্রী কল্যাণ সমিতির দাবি অনুযায়ী, যানজটের নগরী ঢাকায় পাঁচ লাখের মতো এবং সারাদেশে আরও ৮-১০ লাখ মোটরযান শেয়ারে চলে। ঢাকায় ব্যক্তিগত অনেক গাড়িও শেয়ারে চলে। তবে নিবন্ধন করে উবার ও পাঠাও অ্যাপসে চলে ২৮ হাজারের মতো মোটরযান-গাড়ি।

শুরুর দিকে উবার, পাঠাও ছাড়াও দেশে স্যাম, আমার রাইড, মুভ, বাহন, চলো অ্যাপে, ট্যাক্সিওয়ালা, ওই খালি, ইজিয়ার, লেটস গো ইত্যাদি নামে বিভিন্ন কোম্পানি অ্যাপভিত্তিক পরিবহন সেবার কাজ শুরু করে। অবশ্য অধিকাংশই বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

তবে যেসব প্রতিষ্ঠানের এখন সার্ভিস চালু আছে তাদের প্রতি সেবা নিয়ে যাত্রীদের নানা অভিযোগ আছে। অন্যদিকে বাড়তি ভাড়া, অ্যাপসের প্রতি অনীহা, চুক্তিতে যাত্রী নেয়া ও যাত্রীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারসহ নানা রকম হয়রানির অভিযোগও রয়েছে চালকদের বিরুদ্ধে। চুক্তিতে চলা চালকরা বলছেন, অ্যাপে না গেলে চালক ও গ্রাহক উভয়ের তথ্য অ্যাপ কোম্পানিগুলোর ট্র্যাকে থাকে না।

আরও পড়ুন

ইন্টারনেট বন্ধে গ্রাহকদের দৈনিক ক্ষতি ১০ হাজার কোটি টাকা

এদিকে দিনে দিনে পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে, অ্যাপে চলা চালক খুঁজে পাওয়া কঠিন। যদিও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চুক্তিতে বা খ্যাপে গেলে বাড়ছে নিরাপত্তা ঝুঁকি থাকে যাত্রী-চালক উভয়ের।

এর মধ্যেও যারা অ্যাপে চালাতে অভ্যস্ত তাদের ইন্টারনেটবিহীন দশ দিন কঠিন অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।

মোটরসাইকেল চালক শরিফ কাজী ঢাকা মেইলকে বলেন, 'যারা অ্যাপে গাড়ি চালাই তারা এক সিস্টেমে চলি। যেখানেই থাকি কল আসবেই। ইন্টারনেট না থাকায় দশ দিন কোনো কল আসেনি। চালু হওয়ার পরও গতি কম হওয়ায় যাত্রীদের কল কম আসছে। কবে স্বাভাবিক হবে জানি না।'

Riding2

এই রাইডারের ভাষ্য, যারা চুক্তিতে গাড়ি চালায় তারা জনবহুল কিছু পয়েন্টে থাকেন। রোদের মধ্যে লম্বা সময় বসে থাকতে হয় তাদের। যাত্রীদের সঙ্গে দরদাম করে পরে ট্রিপ দিতে হয়। এসবের সঙ্গে অ্যাপে চালানো রাইডারদের মানিয়ে নিতে সমস্যা হয়। যে কারণে ইন্টারনেট ছাড়া সময়ে চুক্তিতে চলা রাইডারদের তুলনায় অ্যাপের লোকজন বেশি সমস্যায় পড়েছেন। চুক্তিতে অভ্যস্ত না হওয়ায় তাদের আয় তুলনামূলক কম হয়েছে।

অ্যাপে চলা চালকদের অভিযোগ, কোম্পানিগুলো তাদের থেকে ট্রিপ প্রতি যে পরিমাণ কমিশন নেয় তাতে তেল খরচ, রাস্তায় নিজের খরচ, ট্রাফিক পুলিশের মামলা হলে সব মিলিয়ে খুব বেশি টাকা রাখতে পারছেন না।

জানা গেছে, উবারে চালকদের জন্য নতুন একটি সার্ভিস চালু করেছে। যেখানে দিনে ৭৫ টাকা থেকে শুরু করে সপ্তাহে ৩৫০ টাকা পর্যন্ত রিচার্জের আদলে রাইডারের অ্যাকাউন্ট থেকে কেটে নেওয়া হবে। পরবর্তী সময়ে যত ট্রিপে যে আয় হবে সবই চালকের। এই সময়ের মধ্যে অ্যাপে কোনো ট্রিপ না দিলেও টাকা ফেরত পাওয়ার সুযোগ নেই।

আরও পড়ুন

ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের অর্ধেক বিল নিতে আইনি নোটিশ

অন্যদিকে পাঠাওয়ের ক্ষেত্রে দিনে ছয় ট্রিপে রাইডারদের কাছ থেকে ধাপে ধাপে কমিশন নেওয়া হয়। ট্রিপপ্রতি সর্বোচ্চ ১৫ থেকে সর্বনিম্ন ৫ টাকা কমিশন নেওয়া হয়। ছয়টির পরে ট্রিপে শতকরা ১ শতাংশ করে কমিশন নেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন চালকরা।

রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠান পাঠাওয়ের একজন প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাইড শেয়ারিংয়ের পাশাপাশি পাঠাও ই-বাণিজ্য, কুরিয়ার ও খাদ্য সরবরাহ সেবা দিচ্ছে।

দেশে এই মুহূর্তে তাদের অ্যাপস ব্যবহারকারী ৮০ লাখের বেশি। এরমধ্যে তিন লাখ চালক/ ডেলিভারি এজেন্ট। ফুড ডেলিভারি সেবার জন্য ৩০ হাজার মার্চেন্ট ও ১০ হাজারের বেশি রেস্টুরেন্ট পাঠাওয়ের সঙ্গে যুক্ত।

Riding3

ইন্টারনেট বিড়ম্বনায় অনলাইনভিত্তিক কার্যক্রম চালানো প্রতিষ্ঠান হিসেবে কেমন ভোগান্তি ও ক্ষতির মুখে পড়েছে পাঠাও? এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য না দেওয়া হলেও প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা গেছে, মোবাইল ইন্টারনেট চালুর পর সবধরনের সেবা কার্যক্রম ধীরে ধীরে শুরু করলেও এখন পর্যন্ত আগের মতো সাড়া মিলছে না। এখনো ইন্টারনেট পেতে সমস্যা হচ্ছে চালক কিংবা যাত্রীকে। ফলে অর্থনৈতিকভাবে অনেক ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে প্রতিষ্ঠানটিকে।

এমন পরিস্থিতিতে গ্রাহকদের সব ধরনের সেবা নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে ক্ষুদে বার্তা পাঠানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে বলেও জানা গেছে।

পাঠাওয়ের একজন চালক ইন্টারনেট বন্ধ থাকার সময়, কারফিউর শুরুর দিকের আয়ের চিত্র তুলে ধরে ঢাকা মেইলকে বলেন, 'ছাত্রদের সঙ্গে ঝামেলা শুরুর পর এক সপ্তাহ বের হতে পারিনি। ফাঁকা রাস্তায় যাত্রীও নেই। আবার অনলাইন বন্ধ থাকায় ক্ষ্যাপের চালক বেড়ে গেছে। কারফিউর শুরু থেকে তিন দিনে মাত্র ১৭০০ টাকার ট্রিপ দিয়েছি। অন্য সময় বেলা ১২টা থেকে সন্ধ্যার মধ্যে প্রতিদিন কম হলেও ১৫শ টাকা পকেটে ঢুকত।'

এদিকে মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ থাকার সময়ে অনলাইনে খাবার অর্ডার করা আসাদুজ্জামান ঢাকা মেইলকে বলেন, 'খাবার অর্ডার করার পর সাত থেকে আট কিলোমিটার দূরে এসে ডেলিভারিম্যান খাবার দিয়ে গেছেন। কিন্তু নেট না থাকায় ছেলেটি অ্যাপসে ডেলিভারি সম্পন্ন করতে পারছিলেন না। পরে নিজের বাসার ওয়াইফাইতে যুক্ত করে তাকে বিদায় দিতে হয়েছে।'

বিইউ/জেবি