images

জাতীয়

মাদক নিয়ে সংঘর্ষে ‘বোবা বিরিয়ানি’ সংশ্লিষ্টরা, নেপথ্যে চুয়া সেলিম

কাজী রফিক

০৯ জুলাই ২০২৪, ০৯:১১ পিএম

জেনেভা ক্যাম্পের সুপরিচিত বিরিয়ানি বিক্রির প্রতিষ্ঠান ফাইজানে মদিনা, যা ‘বোবা বিরিয়ানি’ নামে পরিচিত। তবে এখন বিরিয়ানি বিক্রির চেয়ে প্রতিষ্ঠানটির বেশি নজর মাদকের দিকে৷ গত পাঁচদিন ধরে বিরিয়ানি বিক্রি বন্ধ রেখে মাদক নিয়ে সংঘাতে জড়িয়েছে ‘বোবা বিরিয়ানি’ সংশ্লিষ্ট প্রায় সবাই, যার নেপথ্যে রয়েছেন জেনেভা ক্যাম্পের শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী চুয়া সেলিম।

ক্যাম্প সূত্র জানিয়েছে, গত শবেবরাত থেকে থেমে থেমে সংঘর্ষ হচ্ছে জেনেভা ক্যাম্পে। একেকবার এই সংঘর্ষে জড়াচ্ছে একেক পক্ষ। তবে সব পক্ষই মাদক সংশ্লিষ্ট। এরইমধ্যে সংঘর্ষের জেরে ক্যাম্প ছাড়া হয়েছেন অনেকে। আবার অনেকে দীর্ঘদিন বাইরে থেকে এখন ক্যাম্পে এসেছেন সংঘর্ষের নেতৃত্ব দিতে।

জেনেভা ক্যাম্পের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় মাদক ব্যবসায়ীর তালিকার শীর্ষে ছিল পচিশ এবং ইশতিয়াক। এরমধ্যে পচিশ র‍্যাবের সঙ্গে বন্দুক যুদ্ধে মারা গেলে পালিয়ে যান ইশতিয়াক। পরে করোনাকালে ভারতে থাকা অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। পচিশ ও ইশতিয়াকের স্থলাভিষিক্ত হওয়ার দৌড়ে সবার আগে রয়েছেন চুয়া সেলিম। ৩০টির বেশি মামলার আসামি হলেও তিনি রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।

গত ঈদুল আজহার আগে জেনেভা ক্যাম্পে রক্তক্ষয়ী সংঘাতে জড়ায় বিভিন্ন পক্ষ। কিছুদিন বিরতির পর ক্যাম্পে সংঘাত আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। গত এক সপ্তাহ ধরে মাদকের আধিপত্য নিয়ে সংঘাতে জড়িয়েছে উর্দুভাষাভাষী ক্যাম্পের জনগোষ্ঠীর একাংশ।

সূত্র জানিয়েছে, এই সংঘর্ষের মূল হোতা চুয়া সেলিম। নিজের অবস্থান শক্ত করতে তিনি সঙ্গে রেখেছেন বিরিয়ানি বিক্রিকারী পরিবার হিসেবে পরিচিত ‘বোবা বিরিয়ানি’র পুরো পরিবারকেই। আর তাদের বিপরীতে রয়েছেন ভুইয়া সোহেল, বাবলু, ব্যাটারি।

জানা গেছে, দীর্ঘদিন পলাতক থাকা চুয়া সেলিম সম্প্রতি জেনেভা ক্যাম্পে এসেছেন। তার উপস্থিতি ও নেতৃত্বেই শুরু হয়েছে সংঘর্ষ।

মঙ্গলবার রাতে চুয়া সেলিম অস্ত্র হাতে জেনেভা ক্যাম্পে আসেন বলে জানিয়েছেন ক্যাম্পের একজন বাসিন্দা।

আর চুয়া সেলিমের পক্ষে সংঘর্ষে নেতৃত্ব দিচ্ছে জেনেভা ক্যাম্পে পুরনো ও পরিচিত ‘বিরিয়ানি বিক্রি’ সংশ্লিষ্টরা৷ প্রতিষ্ঠানটির মালিক মো. আলতাফ নিজেই নেমেছেন সংঘর্ষে। নিজেই ইট-পাটকেল নিক্ষেপও করছেন। এ সংক্রান্ত ভিডিও ঢাকা মেইলের কাছে সংরক্ষিত আছে।

মাদকের আধিপত্যের লড়াইয়ে সশস্ত্র অবস্থায় দেখা গেছে আলতাফের দুই ভাই ইমরান ও কামরানকে। যারা দুজনই মাদক কারবার, কিশোর গ্যাং ও ছিনতাইকারী চক্রের হোতা। সংঘর্ষে যোগ দিয়েছেন আলতাফের বোনের সাবেক স্বামী সাজিদ ওরফে নাজায়েজ সাজিদ ও তার ছেলে সামির।

সংঘর্ষের সময় এক নারীর শ্লীলতাহানি ও একজন গর্ভবতী নারীকে মারধরের অভিযোগে মোহাম্মদপুর থানায় একটি মামলা হয়েছে৷ ওই মামলায় প্রধান অভিযুক্ত সাজিদ।

Geneva_Camp_New--02

এছাড়া জেনেভা ক্যাম্পের মাদক হাত বদল ও কিশোর গ্যাংয়ের নেতৃত্ব দেওয়া আলতাফের ভাগনে সামিরও এই সংঘর্ষে সরাসরি অংশ নিয়েছেন।

‘বোবা বিরিয়ানি’ পরিবারের পাশাপাশি মাদকের আধিপত্যের লড়াইয়ে মাঠে দেখা গেছে মো. আতিক নামে একজন মাদক ডিলারকে। যার নেতৃত্বে জেনেভা ক্যাম্পে ২০-২৫ জন সেলসম্যান রয়েছে। গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে পাকিস্তান থেকে জেনেভা ক্যাম্পে আসা মাণ্ডা পরিবারও যোগ দিয়েছে এই সংঘর্ষে৷ জেনেভা ক্যাম্পের শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ী পাকিস্তানি রাজুর ভাই হামজাকেও দেখা গেছে এই সংঘর্ষে। চুয়া সেলিমের ভাজিতা সোহেলও জড়িয়েছেন এই রক্তক্ষয়ী সংঘাতে৷

জেনেভা ক্যাম্প সূত্র জানিয়েছে, গত সপ্তাহ সংঘর্ষে ক্যাম্পের অন্তত ৫-৬টি দোকানে ভাঙচুর চালানো হয়েছে। ভেঙেছে বোবা বিরিয়ানির দোকানও।

সম্প্রতি জেনেভা ক্যাম্পে চলমান মাদক কারবারে নিজের সম্পৃক্ততা নেই বলে দাবি করেছিলেন বোবা বিরিয়ানির মালিক মো. আলতাফ। তার ভাইয়েরা এর সঙ্গে জড়িত হলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ারও আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি।

তবে চলমান সংঘর্ষে তার নিজের উপস্থিতির বিষয়ে জানতে তাকে একাধিকবার ফোন করা হলেও মো. আলতাফের মোবাইল নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়।

আরও পড়ুন

জেনেভা ক্যাম্পে মাদকের ‘ফেরিওয়ালা’ পাঁচ শতাধিক
প্রতিদিন অর্ধ কোটি টাকার ইয়াবা-হেরোইন বিক্রি
বিরিয়ানির দোকানের আড়ালে মাদক কারবার ও ছিনতাই

চলমান সংঘর্ষের বিষয়ে জানতে চাইলে জেনেভা ক্যাম্পভিত্তিক সংগঠন মহাজির রিহেবিলিটেশন ডেভেলপমেন্ট মুভমেন্ট (এমআরডিএম) সভাপতি ওয়াসি আলম বশির ঢাকা মেইল বলেন, সেই শবেবরাত থেকে সংঘর্ষ হচ্ছে৷ কারণ তো একটাই, মাদক৷ এখনও চলছে৷ গতকাল সারারাত সংঘর্ষ হয়েছে। বাচ্চাদের পরীক্ষা, কেউ বের হতে পারছে না। সব সময় একটা আতঙ্ক বিরাজ করে। এ বিষয়ে আরও বেশি নজর দেওয়া দরকার। সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

এদিকে সংঘর্ষের খবরে জেনেভা ক্যাম্পে অভিযান চালানো হয়েছে বলে জানিয়েছে মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ। মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহফুজুল হক ভূঞা জানান, এ বিষয়ে মামলা হয়েছে। ১৫ জনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ কাজ করছে বলে জানান তিনি।

তবে জেনেভা ক্যাম্পের সামগ্রিক পরিস্থিতিকে বড় ধরনের সামাজিক অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করছেন সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল‍্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হকের ঢাকা মেইলকে বলেন, জেনেভা ক্যাম্প ঘিরে মাদক বাণিজ্য, ছিনতাই, চুরি, অবাধ যৌনাচারসহ জীবনযাত্রাকেন্দ্রিক আরও বেশকিছু অপরাধ প্রতিনিয়ত ঘটছে। অনেককে যে কাজ করতে দেখা যায়, প্রকৃতপক্ষে সেই কাজের আড়ালে তারা অপরাধমূলক কাজ পুরোদমে চালিয়ে যাচ্ছেন। রাতের আধারে বা গোপনে যে কাজ করছেন— সেটাই তাদের অর্থ উপার্জনের মূল কাজ।

তিনি বলেন, সংশ্লিষ্ট এলাকায় বসবাসকারী অন্যদের সর্বদা তটস্থ থেকে অস্থিরতার মধ্যে জীবনযাপন করতে হয়। স্বাধীনভাবে চলাফেরা করা ও নিরাপত্তার সাথে জীবনযাপনের প্রয়োজনগুলো পূরণ করার ক্ষেত্রে সব সময় এক ধরনের অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা ও অনিরাপদ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়।

কারই