কাজী রফিক
২৭ জুন ২০২৪, ০৬:১৮ পিএম
প্রতি বছরই বড় গরু বিক্রি করে আলোচনায় থাকে সাদিক অ্যাগ্রো। এবার কোটি টাকায় গরু আর ১৫ লাখ টাকার ছাগল দিয়ে আলোচনা নয়, বরং সমালোচিত হয় খামারটি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ওঠে সাদিক অ্যাগ্রো বয়কটের ডাক। সবশেষ সাদিক অ্যাগ্রোর খামারে হানা দিলো সিটি করপোরেশন। বৃহস্পতিবার (২৭ জুন) দিনভর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসি) অভিযান চালিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছে আলোচিত এই খামারটির গড়ে তোলা অবৈধ স্থাপনা।
তবে মোহাম্মদপুরে দুটি হাউজিংয়ে থাকা সাদিক অ্যাগ্রোর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করলেও নবীনগর হাউজিংয়ে আরও একটি স্থাপনা নজর এড়িয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে এলাকাবাসী। এছাড়া ২০১৯ সালেও একবার সাদিক অ্যাগ্রোর স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছিল। তবে তারা আবারও খাল দখল করে স্থাপনা গড়ে তোলে। এবারও নজরদারি অব্যাহত না রাখলে প্রভাবশালী সাদিক অ্যাগ্রো আবার অবৈধ স্থাপনা গড়ে তুলতে পারে বলে আশঙ্কা করছে সংশ্লিষ্টরা।
দিনভর অভিযানে যা হলো
সকাল ১০টায় সিটি করপোরেশনের অভিযান শুরুর কথা থাকলেও তা শুরু হয় ১১টার পর। মোহাম্মদপুরের সাত মসজিদ হাউজিং এলাকার ১নং সড়কের পশ্চিম মাথায় প্রতিষ্ঠানটির খামারে পরিচালিত অভিযানের নেতৃত্ব দেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অঞ্চল-৫ এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মোতাকাব্বীর আহমেদ এবং নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. মাহবুব হাসান।
অভিযান শুরুর আগেই সাদিক অ্যাগ্রো কর্তৃপক্ষ তাদের কার্যালয়, খামার থেকে সকল মালামাল বের করে নেন। এছাড়া সাদিক অ্যাগ্রোর উত্তর দিকে থাকা চায়ের দোকান সরিয়ে নেন দোকান মালিক। সিটি করপোরেশনের অভিযানের আগেই সটকে পড়েন খালের জায়গায় গড়া রিকশার গ্যারেজ।
অভিযানের শুরুতেই ভেঙে দেওয়া হয় সাদিক অ্যাগ্রোর কার্যালয়, লাখ টাকার ছাগল রাখার ঘর। একই সময়ে ওই আধাপাকা ভবনের দ্বিতীয় তলায় থাকা ঘর ভাঙতে গেলে বাঁধে বিপত্তি। ওই ঘরে থাকা এক ব্যক্তি চড়াও হন অভিযানকারী দলের ওপর।
ওই ব্যক্তি চিৎকার করে বলতে থাকেন, 'আমার ঘরের মালামাল সব ভাইঙা দিছে। আমারে কিছু বাইর করতে দেয় নাই। গরিবের উপর অত্যাচার চলতেছে।' পরে ওই ব্যক্তি, তার স্ত্রী ও কন্যাকে ঘর থেকে নামিয়ে এনে উচ্ছেদ অভিযান পুনরায় শুরু করা হয়৷
একই সময়ে উচ্ছেদ করা হয় সাদিক অ্যাগ্রোর খামারের উত্তর দিকে গড়ে তোলা পাকা, আধাপাকা ও কাঁচা স্থাপনা। অভিযানের আগে রিকশার গ্যারেজের সব টিন খুলে নেওয়া হয়। রয়ে যায় শুধু বাঁশের কাঠামো। সিটি করপোরেশনের বুলডোজার চালানো হয় ওই বাঁশের উপরেই। এ সময় কাঁচা ঘরও ভেঙে দেওয়া হয়৷ তবে সেখানেও বাঁশ ছাড়া কিছুই ছিল না।
খালের জায়গায় রিকশার গ্যারেজ নির্মাণকারীকেও পাওয়া যায় ঘটনাস্থলে। তার নাম মো. ওলি। অবৈধ দখলের বিষয়ে জানতে চাইলে তা অস্বীকার করেন তিনি। বলেন, 'আমার কোনো গ্যারেজ আছিলো না। ঘর আছিলো একটা। ভাইঙা দিছে।'
গণমাধ্যমকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা
খালের জায়গায় অবৈধভাবে স্থাপনা গড়ে তোলা ব্যক্তিরা মানবিক নানা দিক তুলে ধরেন। এ সময় গণমাধ্যম কর্মীদের কাছে নিজেদের অসহায় প্রমাণের চেষ্টা করেন তারা৷ পাশাপাশি সংবাদ কর্মীদের বিভ্রান্ত করে দেওয়া হয় বিভিন্ন ভুল তথ্য।
উচ্ছেদস্থলে গণমাধ্যম কর্মীরা পৌঁছানোর পরেই শুরু হয় ভুল তথ্যের ছড়াছড়ি৷ স্থানীয়দের একাংশ দাবি করে, তারা প্রায় দেড় যুগ ধরে একই জায়গায় বসবাস করছে। তাদের অন্যত্র থাকার কোনো জায়গা নেই। তারা খুবই অসহায়।
তবে সূত্র জানিয়েছে, রামচন্দ্রপুর খালের এ অংশ ভরাট করা হয়েছে আট বছর আগে৷ খাল ভরাট করে সেখানে গড়া হয়েছিল ট্রাকস্ট্যান্ড। সে সময়ও খালের ওপর দখলদারিত্ব চালিয়েছিল সাদিক অ্যাগ্রো।
গণমাধ্যমের তথ্য বলছে, ২০১৯ সালের ২৩ ডিসেম্বর ওই জায়গায় উচ্ছেদ অভিযান হয়েছিল। অভিযানটি পরিচালনা করে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড। অভিযানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিব কবির বিন আনোয়ার।
সে সময় ট্রাক স্ট্যান্ডটি পুরোপুরি উচ্ছেদ করা হয়৷ খালের ওপর মাচা করে গড়ে তোলা দুটি স্থাপনাও গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল সাদিক অ্যাগ্রোর। প্রায় এক বছর জায়গাটি দখলমুক্ত ছিল। পরে সেখানে পুনরায় ঘর তোলেন স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা। কোরবানির আগে নিজের গবাদি পশু বিক্রির জন্য খালের জায়গায় স্থাপনা নির্মাণ করতেন সাদিক অ্যাগ্রোর মালিক মো. ইমরান হোসেন।
জানা গেছে, নিজেদের অসহায় দাবি করা ব্যক্তিদের অনেকেই অবৈধ সুদ ব্যবসায়ী। কারও রয়েছে পাকা খাবার হোটেল। লাখ টাকার ইজিবাইক।
উচ্ছেদ হলো আরও এক অবৈধ দখল
সাত মসজিদ হাউজিং এলাকার খামারটির পাশাপাশি সাদিক অ্যাগ্রোর আরও একটি খামার রয়েছে পাশের নবীনগর হাউজিং এলাকায়। নবীনগর ৭নং সড়কের মুখেই বেড়িবাঁধ সড়কের লোক ঘেষেই সাদিক অ্যাগ্রোর কোটি টাকার স্থাপনা। জায়গাটিতে গরু, ছাগল, দুম্বা, উট লালন, বিক্রি করা হতো। একই সঙ্গে দুগ্ধজাত বিভিন্ন পণ্যও বিক্রি করা হতো এই খামার থেকে। খামারের একাংশ ব্যক্তি মালিকানা জায়গায় হলেও আরেক অংশ সরকারি জমিতে।
বৃহস্পতিবার দুপুরে সে খামারেও হানা দেয় সিটি করপোরেশন। পানি উন্নয়ন বোর্ডের জায়গা দখল করে গড়ে তোলা বিশাল ছাউনি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়।
খামারের কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উচ্ছেদের আগেই অবৈধ অংশের গবাদি পশু সরিয়ে বৈধ অংশে রাখা হয়েছে৷
অবৈধ খামার, প্রবেশের অনুমতি নেই!
সাত সমজিদ হাউজিং ১নং সড়কের খামার ও নবীনগর হাউজিং এলাকার ৭নং রোডের খামার ছাড়াও আরও একটি খামার আছে সাদিক এগ্রোর। যা নবীনগর হাউজিং এলাকার ১৬নং সড়কে গড়ে তোলা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, রামচন্দ্রপুর খালের জায়গা দখল করেই ওই খামারটি তৈরি করা হয়েছে৷
স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, সাদিক অ্যাগ্রোর পরিচিত দুই খামারে জনসাধারণের প্রবেশ সংরক্ষিত না হলেও নবীনগর হাউজিং এলাকার ১৬নং সড়কের খামারে বিনা অনুমতিতে প্রবেশের সুযোগ নেই।
দেশের বাইরে থেকে গোপন পথে নিয়ে আসা দামি ব্রাহামা গরু রাখা হয় ওই খামারেই।
কোটি টাকার সম্পদ নিলাম হলো ৬৭ হাজারে
কোটি টাকা খরচ করে গড়ে তোলা সাদিক অ্যাগ্রোর সাম্রাজের ভাঙা অংশ বিক্রি হয়েছে মাত্র ৬৭ হাজার ৫০০ টাকায়।
উচ্ছেদের পর ভাঙা জিনিসপত্র নিলামে বিক্রি করে দেয় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। উন্মুক্ত নিলামে সব জিনিসপত্র কিনে নেন স্থানীয় একজন বাসিন্দা।
এ বিষয়ে সিটি করপোরেশনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোতাকাব্বীর আহমেদ বলেন, 'অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ শেষে জব্দ করা মালামাল উন্মুক্ত নিলামে বিক্রি করা হয়েছে। নিলামে উপস্থিত ব্যক্তিদের মধ্যে একজন ৬৭ হাজার ৫০০ টাকা সকল মালামাল কিনে নিয়েছেন। তাকে দ্রুত সময়ের মধ্যে নিলামে কেনা মালামাল সরিয়ে নিতে বলা হয়েছে।'
সাদিক অ্যাগ্রো টার্গেট নয়: সিটি করপোরেশন
অভিযান প্রসঙ্গে জানাতে গিয়ে সিটি করপোরেশনের অঞ্চল-৫ এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা মোতাকাব্বীর আহমেদ দাবি করেন, এই অভিযান খাল উদ্ধারে। সাদিক এগ্রো তাদের টার্গেট নয়।
মোতাকাব্বীর আহমেদ আরও বলেন, রামচন্দ্রপুর খালের দুই ধারে যারা অবৈধ দখলদার ছিল তাদের বিরুদ্ধে অভিযান। খালের জমি পানি উন্নয়ন বোর্ড ও সিটি করপোরেশন থেকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর আগেও এখান থেকে উত্তর সিটির মেয়র ট্রাক স্ট্যান্ড সরিয়েছেন, বহুতল ভবন ভেঙেছেন। এটা আমাদের নিয়মিত অভিযানের অংশ।
কর্মকর্তা বলেন, আজকের অভিযানে দেখেছেন রামচন্দ্রপুর খালের তীর দখল করে স্থাপনা করা হয়েছে। সেই স্থাপনা দখল উচ্ছেদ করা হয়েছে। কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়, সবাইকে আইন মেনে ব্যবসা করতে হবে। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযান নয়। আমাদের অভিযান অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে। সাদেক অ্যাগ্রোর মালিক মালিককে ঈদের আগেও আমরা নোটিশ দিয়েছি। অবৈধ স্থাপনা থাকলে সরিয়ে নিতে বলা হয়েছে। আমরা ঈদের আগে উচ্ছেদ অভিযান করিনি, কারণ এর ফলে বাজারে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হতো। আমরা এমনটা চাইনি বলে উচ্ছেদে যাইনি। সেই নোটিশের কোনো ব্যবস্থা নেননি।
জমির মালিকের অভিযোগ তিনি কোনো নোটিশ পাননি। তাহলে সাদিক অ্যাগ্রো ভাড়াটিয়া হিসেবে নোটিশ কীভাবে পায়-জানতে চাইলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বলেন, খালের একটা নীতিমালা আছে। খালের প্রবাহীকার ৩০ ফিটের ভেতরে কোনো স্থাপনা থাকতে পারবে না এই নীতিমালা রয়েছে। জমির মালিক কাগজ দেখিয়েছেন ৪ শতাংশের, কিন্তু দখল করেছেন এক বিঘা। আর আমরা উচ্ছেদ করেছি অবৈধ স্থাপনা জমির মালিককে না। খালের ভেতরের যে অংশ আছে সেটা আমরা উচ্ছেদ করেছি।
উত্তর সিটি করপোরেশনের এই কর্মকর্তা বলেন, অভিযানে একজন জমির মালিক এসেছিলেন। সাদেক এগ্রোর মালিক বা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কেউ আসেনি। আর সাদেক অ্যাগ্রোকে গত ১৮ তারিখ নোটিশ করা হয়েছে যেন খালে বর্জ্য না ফেলে। কিন্তু তারা কোনো সহযোগিতা করেনি। আমরা খালের অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করছি। এরপর আমরা পরবর্তী সময়ে খাল পরিষ্কারে অভিযান চালাবো।
একই তথ্য জানিয়েছেন উত্তর সিটির ৩৩নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আসিফ আহমেদ। তিনি বলেন, 'আমরা সাদিক অ্যাগ্রোকে চিনি। কিন্তু আমরা সাদিক অ্যাগ্রোতে অভিযান করছি না। আমাদের অভিযান খাল উদ্ধারে। এখন খালের জায়গায় এক্স, ওয়াই, জেড যারই স্থাপনা থাকুক, তাই ভাঙা হচ্ছে।'
কারই/জেবি