মুহা. তারিক আবেদীন ইমন
০৬ মে ২০২৪, ০৯:৪৫ পিএম
সারা বিশ্বে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়লেও তেমন উন্নতি নেই বাংলাদেশে। বৈশ্বিক হিসাবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ৪৩ দশমিক ২ শতাংশে উন্নীত হলেও বাংলাদেশে ঘুরে ফিরে ৪ শতাংশের ঘরেই অবস্থান করছে। বিশ্বের সম্পদশালী দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের বড় পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। সে লক্ষ্যে প্রণয়ন করা হয়েছে ‘ন্যাশনাল সোলার এনার্জি রোডম্যাপ ২০২১-২০৪১’।
২০৪১ সালের মধ্যে ৪০ ভাগ ক্লিন এনার্জি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া ২০৩০ সালে সোলার থেকে চার হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা বলা হচ্ছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিকল্পনা নেওয়া হলেও নবায়নযোগ্য জ্বালানির পরিধি যে গতিতে এগোচ্ছে তা অনেকটাই হতাশাজনক।
বৈশ্বিক নবায়নযোগ্য জ্বালানি সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল রিনিউয়েবল এনার্জি এজেন্সির (আইআরএনইএ) ‘নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ পরিসংখ্যান ২০২৪’ অনুযায়ী ২০১৯-২৩ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোর সক্ষমতা তিন হাজার ৮৬৯ গিগাওয়াটে পৌঁছেছে। এছাড়া ২০২৩ সালে মোট বিদ্যুৎ সক্ষমতার তুলনায় নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের হিস্যা ৪৩ দশমিক ২ শতাংশে পৌঁছেছে। এই উৎপাদন সক্ষমতা ২০১৯ সালের তুলনায় ৮ দশমিক ৬ শতাংশ বেশি। আইআরএনইর তথ্য বলছে, নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের উৎসের ক্ষেত্রে সৌর ও বায়ুবিদ্যুৎ খাতে আগ্রহ ও বিনিয়োগ দিন দিন বাড়ছে।
২০১৯-২৩ সালের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রের সংখ্যা বেড়েছে তুলনামূলক বেশি। পাঁচ বছরে স্থাপিত সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রের সক্ষমতা ১৩৮ দশমিক ৫ শতাংশ বেড়ে এক হাজার ৪১৯ গিগাওয়াট হয়েছে। এরপরই রয়েছে বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো, এ খাতে ২০১৯ সালের তুলনায় ৬৩ দশমিক ৫ শতাংশ বেড়েছে। বৈশ্বিক বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকে গত বছর মোট উৎপাদন এক হাজার ১৭ গিগাওয়াটে পৌঁছেছে।
অন্যদিকে প্রাণিজ ও উদ্ভিজ্জ বর্জ্য নির্ভর বায়োমাস বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে। ২০১৯-২৩ পর্যন্ত এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সক্ষমতা ২০ শতাংশ বেড়ে ১৫০ গিগাওয়াটে পৌঁছেছে। পিছিয়ে নেই ভূতাপীয় বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোও। গত বছর এসব প্রকল্প থেকে ১৫ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে, যা ২০১৯ সাল থেকে ৭ দশমিক ১ শতাংশ বেশি।
নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের ক্ষেত্রে সবচেয়ে পুরনো প্রযুক্তি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র। পরিবেশগতভাবে এই প্রযুক্তি কয়েক দশক ধরে সমালোচনার শিকার হয়ে আসছে। পাঁচ বছরে বৈশ্বিক জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা ৬ দশমিক ৪ শতাংশ বেড়ে এক হাজার ২৬৮ গিগাওয়াটে পৌঁছেছে। বিদ্যুতের এ সক্ষমতার ক্ষেত্রে ছোট একটি পরিবর্তন এনেছে সামুদ্রিক শক্তি। এর আওতায় রয়েছে ঢেউ, জোয়ার-ভাটার গতি প্রকৃতি ও সামুদ্রিক বাতাস। এসব উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন দশমিক ২ শতাংশ বেড়েছে। ৫২৭ মেগাওয়াট সক্ষমতাসহ সামুদ্রিক এ প্রকল্পগুলোর অর্ধেক এশিয়ায় ও ৪৫ শতাংশ ইউরোপে অবস্থিত।
আইআরএনইর প্রতিবেদন অনুসারে, পাঁচ বছরে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ সক্ষমতার সবচেয়ে বড় বৃদ্ধি দেখা গেছে এশিয়ায় ৭৪ শতাংশ। এর পরই রয়েছে ওশেনিয়া দেশগুলো। এখানে বেড়েছে ৫৬ শতাংশ। ইউরোপীয় অঞ্চলে উৎপাদন বেড়েছে ৩৭ শতাংশ। একই সময়ের মধ্যে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা উত্তর আমেরিকায় ৩৬ ও দক্ষিণ আমেরিকায় ২৯ শতাংশ বেড়েছে। এছাড়া ২৩ শতাংশ বৃদ্ধি দেখেছে আফ্রিকার এই খাতের প্রকল্পগুলো।
আইআরএনইএ জানিয়েছে, উল্লিখিত পাঁচ বছরে মোট অফ-গ্রিড নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের ক্ষমতা ৩৬ শতাংশ বেড়েছে। যার পরিমাণ ১২ হাজার ৭৫৪ মেগাওয়াট।
আইআরএনইর প্রতিবেদন অনুসারে, নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ ব্যবহারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে চীন। ২০২৩ সালে যে পরিমাণ সোলার পিভি ব্যবহার করেছে দেশটি, তা ২০২২ সালে পুরো বিশ্বে ব্যবহার হতো। এছাড়া চীনে বায়ুবিদ্যুতের ব্যবহার বার্ষিক ৬৬ শতাংশ বেড়েছে। গত বছর ইউরোপে নবায়নযোগ্য জ্বালানি সক্ষমতা বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রাজিলে নবায়নযোগ্য জ্বালানি সক্ষমতা সর্বকালের সর্বোচ্চ রেকর্ড করেছে।
এদিকে বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে কাজ করছে টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (স্রেডা)। স্রেডার তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির মূল হচ্ছে, পানি বিদ্যুৎ, সোলার পিভি ব্যবহার করে সৌর বিদ্যুৎ, বায়ু বিদ্যুৎ, পৌর বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ, গোবর এবং পোল্ট্রি বর্জ্য ব্যবহার করে বায়োগ্যাস, বাতাসের গতি, ধানের তুস এবং ইক্ষুর ছোবড়া, বর্জ্য, শিল্প প্রক্রিয়ার অব্যবহৃত তাপ থেকে বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি উৎপাদন। নবায়নযোগ্য এসব জ্বালানি উৎসের মধ্যে সৌরশক্তি সবচেয়ে সম্ভাবনাময় এবং বায়োগ্যাস ও বায়োমাসের রয়েছে সীমিত ব্যবহার। দেশে প্রতিদিন গড়ে ৪.৫ কিলোওয়াট আওয়ার/বর্গমিটার সৌর বিকিরণ লাভ করে। তবে বায়ু বিদ্যুতের জন্য সম্ভাবনা এখনো গবেষণাধীন। বর্তমানে ১৩টি স্থান থেকে বাতাসের উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে।

স্রেডার সর্বশেষ (৬ মে ২০২৪) তথ্যমতে, বর্তমানে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা এক হাজার ৩০৩ দশমিক ২৬ মেগাওয়াট। এরমধ্যে অন গ্রিডে রয়েছে ৯২৮ দশমিক ৪৬ মেগাওয়াট। এর বেশিরভাগ আসে সোলার থেকে, ১০৬৯ মেগাওয়াট। বর্তমানে দেশে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৯ হাজার ৩৬৫ মেগাওয়াট। সে হিসেবে মোট উৎপাদনের ৪ দশমিক ৪৪ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি। দেশে ২০২১ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে মোট বিদ্যুতের ১০ শতাংশ যোগ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ থাকলেও ২০২৪ সালে এসেও তা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি।
বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, নিম্ন কার্বন নিঃসরণসহ টেকসই জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য ব্যবহারকারী পর্যায়ে প্রাথমিক এবং দ্বিতীয় পর্যায়ের জ্বলানি ব্যবহার এবং সংরক্ষণের মাধ্যমে জ্বালানি দক্ষতা ও সংরক্ষণ মহাপরিকল্পনা ২০৩০ সালের মধ্যে ১৫% জ্বালানি সাশ্রয় করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। সম্প্রতি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানিয়েছেন, ২০৪১ সালের মধ্যে ৪০ ভাগ ক্লিন এনার্জি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ২০৩০ সালে সোলার থেকে চার হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। বর্তমানে বায়ুবিদ্যুৎ, বর্জ্যবিদ্যুৎ, জলবিদ্যুৎসহ অন্যান্য নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকেও বিদ্যুৎ উৎপাদনের কার্যক্রম চলছে। নবায়নযোগ্য উৎস থেকে এক হাজার ১৯৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হলেও ৮২৫ দশমিক ২৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ গ্রিডে আসে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ৩০টি প্রকল্পের মাধ্যমে আরও এক হাজার ২৬২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রকল্প চলমান এবং আট হাজার ৬৬৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রকল্প প্রক্রিয়াধীন। অর্থাৎ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে নয় হাজার ৯৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন পাইপ লাইনে আছে। আমরা নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ প্রতিবেশী দেশ থেকে আমদানির প্রক্রিয়াতেও আছি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে গতিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির তৎপরতা দেখা যাচ্ছে তাতে কাঙ্ক্ষিত সময়ের মধ্যে লক্ষমাত্রা অর্জন করা সম্ভব না। ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) বলছে, নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতি ২০০৮ মতে ২০২১ সালে বিদ্যুতের ১০ শতাংশ হতো নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ। বাস্তবে এক শতাংশও হয়নি। সৌরবিদ্যুৎ এখন ১০ টাকা ব্যয় হারেই উৎপাদন সম্ভব। অথচ আমদানিকৃত কয়লায় বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ আমদানি ব্যয়হার গড়ে ১৭-১৮ টাকা। তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় আরও বেশি। চলমান বিদ্যুৎ ও ডলার সংকট সমাধানে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ হতো গুরুত্বপূর্ণ।
এ বিষয়ে ক্যাবের জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘২০০৯-২০১০ সালের দিকে সরকার তো বলেছিল, ২১ সালের মধ্যেই ১০ পার্সেন্ট এচিভ করবে। এখন তো ২০২৪ সাল। এচিভ করতে হবে বিদ্যুতে, ক্ষমতায় তো না। শুধু মুখে বললে তো হবে না, কাজে বাস্তবায়ন করতে হবে। আমাদের কারিগরি যোগ্যতাও থাকা লাগবে। স্কিল ডেভেলপড করতে হবে। প্রফেশনাল লোকজন তৈরি হতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সোলার সিস্টেমে যাওয়ার জমি নেই। এসব কোনো যৌক্তিক কথা না। আমাদের যে জমি কম তাই বলে আমাদের কি খাদ্য উৎপাদন বাড়ছে না? যে সব জায়গা ব্যবহার করার সেগুলো কি আমরা ব্যবহার করতে পেরেছি? বহু জায়গা ব্যবহারের সুযোগ আছে, সেগুলো ব্যবহার করে দেখিয়ে বলতে হবে আর পারছি না, তখন আলাদা হিসাব। মোটেই কিছু না করে জায়গা নেই বলে ধুয়ো তোলা এটা এক ধরনের অজ্ঞতার পরিচয়।’
এ বিষয়ে স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমাদের অবজার্ভেশন অনুযায়ী নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন চার শতাংশেরও নিচে। ধরেই নিলাম সরকারের হিসাব অনুযায়ী চার পার্সেন্টও হয়। আমাদের ২০৪০ সাল নাগাদ যে ৪০ পার্সেন্টের ওপর নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনের কথা বলা হচ্ছে, এটা অর্জন করা বর্তমানে আমরা যে রেশিওতে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে যাচ্ছি, খুব চ্যালেঞ্জিং। এটা বলা যায় যে, প্রায় অসম্ভব। কিন্তু বাংলাদেশে ১০০ পার্সেন্ট নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। আমরা চাইলে তা করতে পারি। এখন দরকার সদিচ্ছা এবং আমাদের যে সুযোগ সুবিধাগুলো আছে সেগুলো কাজে লাগানো।’
টিএই/জেবি