images

জাতীয়

জাল সনদের ক্রেতাদের বেশির ভাগই প্রতিষ্ঠানপ্রধান!

মোস্তফা ইমরুল কায়েস

২৪ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:৫২ এএম

কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সনদ জালিয়াতির ঘটনায় তদন্ত করতে গিয়ে কেঁচো খুড়তে সাপ বেরিয়ে আসার মতো অবস্থা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ছয়জনকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা গোয়েন্দা পুলিশ। তবে এ ঘটনায় জাল সনদের গ্রাহক হিসেবে ৩৫ থেকে ৪০ জন ক্রেতার তথ্য মিলেছে। যারা নিয়মিত বোর্ডের সিস্টেম এনালিস্ট শামসুজ্জামানের কাছ থেকে চাহিদাপত্র দিয়ে এসব জাল সনদ নিতেন। এরপর তারা সেই জাল সনদ তুলে দিতেন ভুয়া ছাত্রছাত্রীদের হাতে। এসব ক্রেতার বেশির ভাগ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালক, অধ্যক্ষ ও সিনিয়র শিক্ষক।

আলোচিত এই ঘটনায় গ্রেফতার ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদে এমন সব চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ-ডিবি।

ডিবির সূত্রে বলছে, শামসুজ্জামান বোর্ডের চাকরির পাশাপাশি এই সনদ বাণিজ্য করতেন। এজন্য রেখেছিলেন একজন সহকারী। যার কাজই ছিল জাল সনদ তৈরি করা। তবে শামসুজ্জামান এসব জাল সনদ তৈরির কাজ করতেন রাতে। তার সহকারী ফয়সালকে বলে দিতেন কোন দিন কতটি সার্টিফিকেট লাগবে। তার কাছ থেকে বসে থেকে তৈরি করে নিয়ে তা পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন মাধ্যমে পৌঁছে দিতেন সেই ৩৫ থেকে ৪০ জন ক্রেতার কাছে। এসব ক্রেতার নেশা হয়ে গিয়েছিল জাল সনদ কেনা। যার বেশির ভাগই কোনো না কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান। এই চক্রের সদস্যদের বেশির ভাগের বসবাস ঢাকায়।

আরও পড়ুন

টাকায় কারিগরি বোর্ডের সনদ বিক্রি করা সেই প্রকৌশলী বরখাস্ত

ইতোমধ্যে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের কম্পিউটার সেলের সিস্টেম অ্যানালিস্ট একেএম শামসুজ্জামান, তার ব্যক্তিগত সহকারী ফয়সাল ছাড়াও কুষ্টিয়া গড়াই সার্ভে ইনস্টিটিউটের পরিচালক সানজিদা আক্তার কলি, কামরাঙ্গীরচর হিলফুল ফুজুল টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিএম কলেজের অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান ও ঢাকা টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের পরিচালক মো. মাকসুদুর রহমান ওরফে মামুনকে গ্রেফতার করেছে ডিবি লালবাগ বিভাগ। এছাড়া দুই নারীকে গ্রেফতার করা হযেছে। এর মধ্যে কারিগরি বোর্ডের সাবেক চেয়ার‌্যমান খান আকবর আলীর স্ত্রী সেহেলা পারভীনও রয়েছেন। যদিও সাবেক এই চেয়ারম্যান

Jal2

বিষয়টি অস্বীকার করছেন। তার দাবি, স্ত্রী এ ঘটনায় জড়িত নন। তাকে মিথ্যা তথ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে।

এ বিষয়ে ডিবির লালবাগ বিভাগের ডিসি মশিউর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘এ ঘটনায় অনেক তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। বোর্ডের কয়েকজ ছাড়াও অনেকেই জড়িত। আমরা তাদেরও গ্রেফতার করব। এখানে আমরা জাল সনদের কিছু ক্রেতাও পেয়েছি। তবে এই মুহূর্তে নামগুলো প্রকাশ করা যাচ্ছে না, কারণ ইতোমধ্যে অনেকে গা ঢাকা দিয়েছে।’

ডিবির সূত্রটি আরও জানায়, যারা ক্রেতা হিসেবে শামসুজ্জামানের কাছ থেকে নিয়মিত এসব জাল সনদ কিনতেন তাদের তথ্য সংগ্রহ চলছে। খুব শিগগির তাদেরও গ্রেফতার করা হবে।

আরও পড়ুন

সনদ জালিয়াতি: প্রয়োজনে বোর্ড চেয়ারম্যানকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে ডিবি

ডিবির আরেকটি সূত্র বলছে, শামসুজ্জামানকে জিজ্ঞাসাবাদে তিনি ছাড়াও বাকি পাঁচজন নানা গুরুত্বপূর্ণ ও চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন। এসব তথ্যের সূত্র ধরে তারা এখন পর্যন্ত শুধু বোর্ডের মধ্যেই তিনজনের সংশ্লিষ্টতা পেয়েছেন। এর মধ্যে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সিবিএ নেতাও রয়েছেন। যার নাম আব্দুল বাছের। আরও রয়েছেন রেজিস্ট্রেশন শাখার অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রোগ্রামার মামুনুর রশীদ ও বোর্ডের উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক জাকারিয়া আব্বাস। তারা বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানের কাছ থেকে সার্টিফিকেট ও রেজাল্ট পরিবর্তনের চাহিদাপত্র নিতেন। সেই অনুযায়ী তারা শামসুজ্জামানকে বলতেন। তিনি তাদের সার্টিফিকেট তৈরি করে দিতেন। তবে এজন্য তাদের কাছ থেকে তেমন কোনো টাকা নিত না, কারণ তারা বোর্ডের লোক।

Jal3

এর বাইরে শামসুজ্জামান সারাদেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানদের দেওয়া চাহিদামতো জাল সনদ তৈরি করে দিয়েছেন। ওই সব প্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রী বেশি ভর্তির জন্যই মূলত তারা এসব কাজ করতেন। এছাড়াও রেজাল্টের মান ঠিক রাখার জন্যও কোনো কোনো প্রধান এই জাল সনদ তৈরি করে নিতেন বলেও জানিয়েছেন গ্রেফতার ব্যক্তিরা।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানরাই দালাল!

ডিবি বলছে, ছাত্রছাত্রীরা তাদের সার্টিফিকেট বা নম্বর পরিবর্তন করা মার্কশিট লাগবে বিষয়টি জানাতো প্রতিষ্ঠানপ্রধানের কাছে। তারাই ভায়া হিসেবে কাজ করতেন। মূলত তারাই ছিলেন শামসুজ্জামানের দালাল। প্রতিটি সার্টিফিকেট তৈরি করে দেওয়ার জন্য জনপ্রতি ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা নেওয়া হতো। তবে এই টাকা নিয়ে শামসুজ্জামান নিজে নিতেন নাকি অন্য কাউকেও দিতেন তা নিয়ে তদন্ত করছে ডিবি।

আরও পড়ুন

নিজের ‘দায় স্বীকার’ করলেন কারিগরি বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান

শামসুজ্জামানকে জিজ্ঞাসাবাদে তিনি ডিবিকে জানিয়েছেন কীভাবে কার কাছে এই জাল সনদ তৈরি শিখেছেন। তিনি জানিয়েছেন, তার এই কাজের গুরু ছিলেন কারিগরি বোর্ডের সাবেক সিস্টেম এনালিস্ট শামসুল হক। তিনি ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং পরীক্ষায় যারা উত্তীর্ণ হতে পারত না তাদের জাল সনদ তৈরি করে পাস দেখাতেন। এছাড়াও তাদের নম্বর বাড়িয়ে দেওয়ার কাজটিও তিনি করতেন।

এমআইকে/জেবি