images

জাতীয়

মিয়ানমারে সংঘাতের ধাক্কা এপারে, কী করবে বাংলাদেশ?

ঢাকা মেইল ডেস্ক

০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১০:৩৩ পিএম

বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের বিদ্রোহী দল আরাকান আর্মির সঙ্গে সংঘর্ষের মুখে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) ৫৮ জন সদস্য বিজিবি ক্যাম্পে এসে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবির) ৩৪ ব্যটালিয়নের একটি স্থানীয় তামব্রু ফাঁড়িতে রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিজিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম৷

এদিকে রোববার বিকেল থেকে সীমান্তের ওই অঞ্চলে গোলাগুলির আওয়াজ আর তেমন একটা পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানিয়েছে স্থানীরা৷ 

সীমান্ত লাগোয়া নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়নের এক নাম্বার ওয়ার্ডের মেম্বার মো. শফিকুর রাহমান রোববার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে জার্মানভিত্তিক গণমাধ্যম ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘বিকেল থেকে মিয়ানমারে আর গোলাগুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে না৷ মিয়ানমারের বিজিপির সদস্যরা বাংলাদেশের বিজিবির তামব্রু ক্যাম্পে আছেন৷ আরাকান আর্মি মিয়ানমারে বিজিপির একটি ক্যাম্প দখল করে নিয়েছে বলে আমরা খবর পেয়েছি৷'

নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাকারিয়াও গেলাগুলির শব্দ রোববার সন্ধ্যায় আর না পাওয়ার কথা বলেছেন৷

আরও পড়ুন

সীমান্তে ৫ স্কুল বন্ধ ঘোষণা, স্থানীয়দের সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ

শনিবার দুপুরের পর থেকে বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়৷ গোলাগুলির শব্দ বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে শোনা যায়৷ সীমান্ত এলাকার বাড়িতে গুলি ও মর্টার সেল এসে পড়ে৷ এতে তিন বাংলাদেশি নাগরিক আহত হন৷

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসদুজ্জামান খান কামাল রোববার দুপুরে সচিবালয়ে এক ব্রিফিংয়ে জানান, ‘মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) সদস্যরা আমাদের সীমানর মধ্যে ঢুকে সহযোগিতা চেয়েছেন৷ তাদের অস্ত্র জমা রেখে মিয়ানমারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে৷ আমরা কোনো যুদ্ধে জড়াতে চাই না৷ আমাদের বিজিবির শক্তি সেখানে বৃদ্ধি করেছি যাতে আমাদের সীমানায় কেউ প্রবেশ করতে না পারে৷'

02

তিনি সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘তারা তো তাদের গভর্নমেন্ট ফোর্স৷ তাদের ফেরত নেবে না কেন? তাদের ফেরত পাঠানোর জন্য পরররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আলোচনা চলছে৷’

এদিকে বাংলাদেশে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন রোববার সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে দেখা করেছেন সচিবালয়ে৷ পরে ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, ‘মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ লড়াইয়ের রেশ বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকাতেও পড়েছে৷ এ বিষয়ে চীনের সহায়তা প্রত্যাশা করা হয়েছে৷’

স্থানীয় সূত্র বলছে, ১৮ ঘণ্টা পর রোববার বিকেলে আরাকান আর্মি সেখানকার একটি ক্যাম্প (মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশ ক্যাম্প) দখল করে নেওয়ার পর সন্ধ্যায় সেখানে আর গোলাগুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে না৷

সীমান্ত লাগোয়া ঘুমধুম ইউনিয়নের এক নাম্বার ওয়ার্ডের মেম্বার মো. শফিকুর রাহমানের বাড়ি তামব্রু পশ্চিমকুল গ্রামে৷ তিনি বলেন, ‘রাত তিনটার দিকে আমার বাড়িতে মর্টারশেল পড়ে ওপার থেকে এসে৷ ওই সময় থেকেই ওখানে তীব্র যুদ্ধ শুরু হয়৷ ১৮ ঘণ্টা যুদ্ধের পর পরিস্থিতি এখন শান্ত৷ আমরা শুনেছি আরাকান আর্মি একটি ক্যাম্প দখল করে নিয়েছে৷’

আরও পড়ুন

প্রাণহানির শঙ্কায় মিয়ানমার সীমান্ত বাহিনীর ৫৮ সদস্য বিজিবি ক্যাম্পে

শফিক মেম্বার জানান, ‘আমরা বাড়ি ছাড়াও আরও একটি বাড়িতে মর্টারশেল পড়েছে৷ দুই বাড়িতে কেউ আহত না হলেও আশপাশ এলাকায় তিনজন আহত হয়েছেন৷ স্থানীয় লোকজন আতঙ্কে থাকলেও তারা এলাকা ছেড়ে চলে যায়নি৷ তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে৷’

রোববার ভোররাত থেকে তামব্রু সীমান্তে অবস্থান করছেন স্থানীয় সাংবাদিক আব্দুল হাকিম৷ তার বাড়ি নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায়৷ তিনি বলেন, ‘শনিবার বিকেল ৩টার দিক থেকেই ওইপাড়ে গুলির শব্দ শোনা যায়৷ রাতে আরও তীব্র হয়৷ গুলি ও মর্টারের শেল বাংলাদেশ অংশেও এসে পড়ে৷ রোববার বিকেল থেকে গোলাগুলির শব্দ কমে যায়৷ আমরা জানতে পেরেছি বিকাল পর্যন্ত ৫০ জনেরও বেশি মিয়ানমারের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর সদস্য বিজিবির বাছে এসে আশ্রয় নিয়েছে৷ তবে বিজিবি ১৪ জনের পর আর কিছু জানায়নি৷ তাদের প্রেস ব্রিফিং করার কথা ছিলো তাও করেনি৷’

পুরো এলাকায় আতঙ্ক বিরাজ করছে৷ সীমান্তের আশপাশের বাড়িতে পুরুষরা থাকলেও নারীদের সরিয়ে নেয়া হয়৷ আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি৷

স্থানীয় পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের ৩৪ নাম্বার পিলারের ওপারে মিয়ানমারের অংশে একটি ক্যাম্প দখল নিয়ে বাংলাদেশ সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারে বিজিপি এং আরাকান আর্মির মধ্যে তুমুল লড়াই হয়৷ শনিবার বিকাল ৩টা থেকে দুই পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি হয়৷

নাইক্ষ্যংছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এ এফ এম সায়েদ বলেন, ‘সীমান্ত বিজিবি সদস্যরা দেখছেন৷ আর নাগরিকদের নিরাপত্তার কোনো সমস্যা হলে আমরা দেখব৷ এখনো তেমন কোনো সমস্যা হয়নি৷’

আর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাকারিয়া রোববার সন্ধ্যা ৭টার দিকে জানান, ‘আমরা এখন আর গোলাগুলির শব্দ শুনছি না৷ কিছুটা শান্ত হয়ে এসেছে৷’

ইউএনও বলেন, ‘সীমান্তের লোকজনের জন্য আমরা আশ্রয়কেন্দ্র খুলেছি৷ তবে কেউ আশ্রয় কেন্দ্রে আসেননি৷ কেউ কেউ ওই এলাকা ছেড়ে আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতে নিরাপদ আশ্রয় নিয়েছে বলে শুনেছি৷ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রেখেছি৷ আরও একদিন বন্ধ থাকবে৷'

বাংলাদেশের করণীয়

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান বলেন, ‘আমাদের বর্ডারকে আরও সুরক্ষিত করতে হবে৷ আর ওখানে (মিয়ানমার) কী ঘটছে তার গোয়েন্দা তথ্যের ব্যাপারে আমাদের ঘাটতি আছে বলে আমার কাছে মনে হচ্ছে৷ তাই সেই তথ্যের নেটওয়ার্ক আমাদের আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন৷ তাহলে আমরা আগাম ব্যবস্থা নিতে পারব৷’

03

তার কথা, ‘মিয়ানমারের ভেতরে যুদ্ধ কতটা বিস্তৃত হচ্ছে সেটা আমাদের জেনে ব্যবস্থা নিতে হবে৷ কারণ একবার যদি রোহিঙ্গারা আসা শুরু করে তাহলে কিন্তু ঠেকানো যাবে না৷ ২০১৭ সালে আমরা বলেছিলাম আমাদের প্রস্তুতি ছিলে না৷ এবার যেন সেরকম না হয়৷'

‘আর আমাদের এই বিষয় নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যোগাযোগ বাড়াতে হবে৷ বিশেষ করে আসিয়ানের সঙ্গে আমাদের কথা বলতে হবে৷ এই ধরনের পরিস্থিতিতে তাদের অবস্থান জেনে আমাদের কথা বলছে হবে৷ আর আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এর প্রভাব কী পড়ে তাও খেয়াল রাখতে হবে৷ বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সেই ধরনের তৎপরতা আমি দেখছিনা এখনো৷’

আরও পড়ুন

‘যুদ্ধ চাই না, তবে গায়ে এসে পড়লে ছাড় দেব না’

আর মিয়ানমারে বাংলাদেশের সাবেক সামরিক অ্যাটাশে এবং সাবেক রাষ্টদূত মেজর জেনারেল (অব.) এম শহীদুল হক বলেন, ‘আরাকান আর্মি পালাতেয়া নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এখন বাংলাদেশ-মিয়ানমার বর্ডার তারা নিয়ন্দ্রণে নিতে চাইছে৷ এখন যে যুদ্ধটা হচ্ছে সেটা মূলত আরকান আর্মি ও মিয়ানমারের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর মধ্যে৷ পালাতেয়া নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার ফলে মিয়ানমার-ভারত সীমান্ত এরইমধ্যে আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে৷’

তার কথা, ‘মিয়ানমারের ভেতরে আরও অনেক জায়গায় যুদ্ধ চলছে৷ সিটুয়েতে যুদ্ধ চলছে৷ পুরাতন আকিয়াব বন্দর যেখানে ওটার টাউনশিপের আশেপাশে যুদ্ধ চলছে৷ ওই সব এলাকায় দুই লাখের বেশি মুসলমান আছে৷ এর আগে ক্লিনজিং করা হয়েছিল৷ এখন যদি আবার শুরু হয় তাহলে বাংলাদেশে কিন্তু তারা চলে আসতে পারে বলে আমার আশঙ্কা৷’

‘সীমান্তে বিজিবি মোতায়েনের পরও আরও অনেক জায়গা আছে, পাহাড়ি এলাকা আছে যেখান থেকে মিয়ানমারের লোকজন ঢুতে পড়তে পারে৷ ওইসব জায়গা থেকে সব সময়ই তারা আসা-যাওয়া করে৷ ২০১৭ সালে এসেছে৷ এখনো আসা-যাওয়া করছে৷ ওই গ্যাপগুলো বন্ধ করতে হবে। সেখান থেকে কেউ এলে তাদের বুঝিয়ে পুশব্যাক করতে হবে' বলে জানান তিনি৷

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আরাকান আর্মি পালাতেয়া দখল করলেও সেখানে চীনের অনেক স্থাপনা ও ব্যবসা আছে৷ আরাকান আর্মি চীনা কোনো স্থাপনায় হামলা চালায়নি৷ তারা ভারতের স্থাপনায় হামলা করেছে৷ আরাকান আর্মির সঙ্গে চীনের একটা সম্পর্ক আছে৷ তাই বাংলাদেশ সরকারের উচিত হবে বিষয়টি নিয়ে চীনের সঙ্গে কথা বলা৷ তাদের সঙ্গে এটা নিয়ে যোগাযোগ বাড়াতে হবে৷’সূত্র: ডয়চে ভেলে

জেবি