জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
৩১ ডিসেম্বর ২০২৩, ০২:২১ পিএম
মনে আছে কি শিশু তানজিম উমায়েরের কথা। ২০২১ সালের শেষ রাতে ঢাকা তিলোত্তমা নগরীতে কিছু উঠতি তরুণ-তরুণী যখন নতুন বছর বরণে উল্লাসে মাতোয়ারা, ঠিক তখন ১৮ মাসের শিশু উমায়ের তাদের আতশবাজি-পটকার আওয়াজে ছটফট করছিল। এক পর্যায়ে হৃদরোগের সমস্যা বেড়ে গিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে ওমায়ের। শিশুটিকে বাঁচাতে তার বাবা চেষ্টার ত্রুটি করেনি। তাকে হাসপাতালে নিয়ে ছোটেন। কিন্তু বাঁচানো সম্ভব হয়নি। দীর্ঘক্ষণ পটকার আওয়াজ তার এমন ক্ষতি করে ফেলেছিল যে, বাঁচার সকল সম্ভাবনাই তখন শেষ হয়ে গিয়েছিল।
তানজিম উমায়েরের বাবা ইউসুফ রায়হান জানান, বর্ষবরণের রাতে আতশবাজির বিকট শব্দে ভয়ে তার ছেলেটি বারবার কেঁপে উঠছিল। ফলে তার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়, হাসপাতালে নিয়ে গেলেও তাকে আর বাঁচানো যায়নি।
শিশু উমায়েরের সেই করুণ মৃত্যু থেকে শিক্ষা নিয়ে পরের বছর ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে আতশবাজি, পটকা ফোটানো ও ফানুস ওড়ানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। কিন্তু ২০২২ সালের সেই নোটিশ কেউ আমলেই নেয়নি। প্রশাসন যেন নোটিশ দিয়েই দায় সেরেছে। পরবর্তী পদক্ষেপ প্রত্যাশা অনুযায়ী ছিল না।
আরও পড়ুন: আশঙ্কায় শুরু, সহিংসতায় বছর শেষ
প্রাণীদের নিয়ে কাজ করা পিপলস ফর এনিমেল ফাউন্ডেশনের (পিএডাব্লিউ) চেয়ারম্যান রাকিবুল হক এমিল বলেন, প্রতিবছর আনন্দের নামে যে আতশবাজি ফুটিয়ে উচ্চ শব্দ তৈরি করা হয় এ থেকে আমরা মুক্তি চাই। যারা আতশবাজি ফুটায় তারাও কিন্তু নগরীর নাগরিক। তাদেরও পরিবারের কেউ না কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নিশ্চয়ই তারাও চায় যেকোনো ক্ষতি এড়াতে, তাদেরও দাবি একই। কিন্তু তারা কেয়ারলেস থাকে। যখন আমরা আনন্দ বিনোদন করি তখন যেনো অন্যের কথা মাথায় রাখি, সংবেদনশীল হই। এটাই আমাদের কর্তব্য হওয়া উচিত। বিকট শব্দে আনন্দ প্রকাশ করা বর্বরতা। এর বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। তবেই বর্বরতা থেকে মুক্তি মিলবে।
বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) নামের একটি সংগঠন জানিয়েছে, ক্যাপস এর গবেষণা দল গত ৬ বছরব্যাপী (৩১ ডিসেম্বর ২০১৭ থেকে ১ জানুয়ারি ২০২৩) ইংরেজি নববর্ষ উদযাপন উপলক্ষে বায়ু ও শব্দ দূষণের তীব্রতা পর্যবেক্ষণ করে আসছে। তাদের গবেষণায় দেখা যায় যে, ডিসেম্বরের শেষ দিনের তুলনায় জানুয়ারি মাসের প্রথম দিনের বায়ুমান অনেক বেশি খারাপ থাকে। উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৩১ ডিসেম্বর থেকে ১ জানুয়ারি বায়ুমান সূচক সর্বনিম্ন ৬ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ৬৬ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়।
গবেষণায় তারা আরও দেখিয়েছে, পটকা-আতশবাজি ইত্যাদি ফুটানোর ফলে শব্দের তীব্রতা সহনীয় মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। বর্ষবরণের পটকা-আতশবাজি থেকে উৎপন্ন শব্দের মাত্রা পূর্বের দিনের তুলনায় সর্বনিম্ন ৪৬ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ১১৩ শতাংশ পর্যন্ত বেশি হয়ে থাকে।
আরও পড়ুন: থার্টি ফার্স্ট নাইট ঘিরে ডিএমপির ১২ নির্দেশনা
সংস্থাটি বলছে, আতশবাজির উচ্চশব্দে প্রাণী ছাড়াও শিশু, বয়স্ক, গর্ভবতী মা এবং রোগীদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বেড়ে যায়। আমাদের দেশেই বর্ষবরণের বাজির শব্দে গত বছর শিশু প্রাণহানি ঘটেছে, অনেকেই হার্ট অ্যাটাক করেছেন এবং অসুস্থ হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। পাখিরা প্রচণ্ড আওয়াজের কারণে কষ্ট পায়। অনেকসময় গাছে বা বিল্ডিংয়ের দেয়ালে আঘাত পেয়ে নিচে পড়ে যায় ফলে আহত হয় এবং মারাও যায়। রাস্তার কুকুর-বিড়াল, গৃহপালিত প্রাণী এমনকি বন্যপ্রাণীরাও শব্দের কারণে ভয়ে বিভ্রান্ত হয়ে দিক-বিদিক ছোটাছুটি করতে গিয়ে মারা যায়। ২০২২ সালের রাতেও একই ঘটনা ঘটে। কিন্তু শিক্ষা নেওয়া হচ্ছে না। কাউকে থামানো যায়নি। এসব ফানুস, আতশবাজি ও পটকা উৎপাদন এবং আমদানিকারদেরও কোনো শাস্তি হয়নি। কয়েকজনকে গ্রেফতার করেই প্রশাসনের দায়িত্ব যেন শেষ। এভাবে কি থামানো যাবে? এবারও কি তবে একই অবস্থা তৈরি হতে যাচ্ছে?
ডিএমপির পক্ষ থেকে নববর্ষ উদযাপনকেন্দ্রিক ১২টি বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে এবার। এর মধ্যে আতশবাজি, পটকা ও ফানুস ওড়ানো বন্ধের কথা রয়েছে।। কিন্তু বাস্তব অর্থেই এসব বন্ধে যেরকম কার্যকর উদ্যোগ ও পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল, সেরকম কিছু লক্ষ্য করা যায়নি।
সর্বশেষ খবর হলো লালবাগ থেকে কোতোয়ালী থানা পুলিশ পৃথক পৃথক অভিযানে ১৫ কেজি আতশবাজি (বিস্ফোরক) দ্রব্যসহ একজন এবং ২০ কেজি আতশবাজি (বিস্ফোরক) দ্রব্যসহ আরো একজনকে আটক করেছে এবং এর জন্য কোতোয়ালী থানায় দুইটি মামলা হয়েছে। প্রতিবছর এভাবে আতশবাজি বিক্রয়কারীদের ধরা হয় কিন্তু যারা উৎপাদন ও আমদানি করে তাদের ধরতে প্রশাসনের তেমন কর্মকাণ্ড চোখে পড়ে না।
তবে ভালো খবর হলো—এবার মানুষের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে। ইতোমধ্যে আওয়াজ ওঠেছে সামাজিক মাধ্যমে। থার্টি ফার্স্টে আতশবাজি ও ফানুসকে না বলি শিরোনামে ফেসবুকে একটি গ্রুপ খুলে সচেতনতা তৈরির পক্ষে জনমত চলছে। তাতে সর্বশেষ সাড়ে ৬৪ হাজার লোকজন এসব বর্বর উল্লাস বন্ধের পক্ষে মত দিয়েছেন। এভাবে জনমত বাড়ছে; প্রশাসনকেও এ বিষয়ে আন্তরিক হতে হবে। এবার ডিএমপি’র নির্দেশনা ক’জন মানবেন আর কতজনকে তারা মানাতে বাধ্য করবেন সেটাই দেখার বিষয়।
আরও পড়ুন: ঢাকায় আতশবাজি, পটকা ও ফানুস নিষিদ্ধ
ডিএমপি জানিয়েছে, উন্মুক্ত স্থানে সভা-জমায়েত বা উৎসব, অনুষ্ঠান, সমাবেশ, নাচ, গান ও কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করা যাবে না। কোথাও কোনো ধরনের আতশবাজি, পটকা ফোটানো ও ফানুস ওড়ানো বা ক্রয় বিক্রয় করা যাবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, গুলশান, বনানী ও বারিধারায় ৩১ ডিসেম্বর রাত ৮টার পর বহিরাগতরা প্রবেশ করতে পারবে না। সবাই রাত ৮টার মধ্যে স্ব-স্ব এলাকায় প্রত্যাবর্তন করবেন। হাতিরঝিল এলাকায় সন্ধ্যা ৬টার পর থেকে কোনো সমাবেশ বা অনুষ্ঠান করা যাবে না এবং কোনো যানবাহন থামিয়ে অথবা পার্কিং করে কেউ অবস্থান করতে পারবে না। ৩১ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৬টার পর ঢাকা মহানগরীর কোনো বার খোলা রাখা যাবে না। ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন আবাসিক হোটেল, রেস্তোরাঁ, জনসমাবেশ ও উৎসবস্থলে সব প্রকার লাইসেন্স করা আগ্নেয়াস্ত্র বহন করা ৩১ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৬টা থেকে ১ জানুয়ারি ভোর ৫ টা পর্যন্ত নিষিদ্ধ।
কিন্তু এসব নির্দেশনার কোথাও বলা হয়নি যে, ৩১ ডিসেম্বর রাতে নগরীর কোনো বাসাবাড়ির ছাদে আতশবাজি, পটকা ফুটানো ও ফানুস ওড়ানো যাবে না। গত দুই বছরে দেখা গেছে, নববর্ষের রাতে বেশির ভাগ বাসা-বাড়ি, উঁচু ভবন ও স্থাপনার ছাদ থেকে আতশবাজি ও পটকা ফুটানো ও ফানুস ওড়ানো হয়। ফলে অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটেছে। শুধুমাত্র ফানুসের আগুনে ২০০ স্থানে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এরপরও বন্ধ হয়নি আতশবাজি, পটকা ও ফানুস নিয়ে উল্লাস।
আরও পড়ুন: আতশবাজি ও ফানুস বন্ধের দাবি সচেতন নাগরিকদের
বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) এর চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, প্রতিবছর ৩১ ডিসেম্বর রাত ১২টা এক মিনিট থেকেই শুরু হয় নতুন বছর উদযাপনের উন্মাদনা। মুহুর্মুহু শব্দ করে আকাশে ছড়িয়ে পড়ে আতশবাজির আলোকছটা। প্রতিবছরই ইংরেজি নববর্ষ উপলক্ষে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে রাতের বেলা আতশবাজি ও ফানুস পোড়ানো হয়। ফলশ্রুতিতে বছরের প্রথম দিন শুরু হয় অস্বাস্থ্যকর বায়ু সেবন করে এবং সরব উপস্থিতিতে শব্দ দূষণের মত নীরব ঘাতককে সঙ্গে নিয়ে। এই আকস্মিক বায়ু ও শব্দ দূষণ মানুষ, পশুপাখি ও পরিবেশ প্রতিবেশ ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে।
এমতাবস্থায় বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) দেশবাসীর নিকট অনুরোধ করছে যে, প্রত্যেকে যেন সামাজিকভাবে নিজ নিজ স্থান হতে সচেতন হয় এবং পরিবেশ ও জান-মালের নিরাপত্তার জন্য আতশবাজি ও ফানুস বর্জন করেন। একজনের ক্ষণিকের আনন্দ উল্লাস যেন অন্যের ক্ষতির কারণ না হয়। আমাদেরকে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে এবং একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে জনগণের কথা মাথায় রেখে নববর্ষকে আমন্ত্রণ জানাতে হবে।
থার্টিফাস্ট নাইট উপলক্ষে প্রস্তুতি ও নাশকতার হুমকি আছে কি জানতে চাইলে ডিবির প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ বলেন, ডিএমপির পক্ষ থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে- কী কী করা যাবে না। পাশাপাশি আমরা খোঁজ খবর রাখছি কেউ নিষেধাজ্ঞা অমান্য করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে আমাদের পর্যাপ্ত সংখ্যক পুলিশ সদস্য কাজ করছে। একদিকে বছর শেষে নতুন বছর আসছে। অন্যদিকে নির্বাচন সামনে সবকিছু মিলিয়ে আমাদের পর্যাপ্ত ফোর্স মাঠে কাজ করছে।
এমআইকে