লাইফস্টাইল ডেস্ক
০৪ নভেম্বর ২০২২, ১০:০৯ এএম
৯৮ সালের বন্যায় ভেসে যায় উঠোন, ভেসে যায় বাড়িঘর। টঙ বেঁধে ঘরের ভিতরের দিনগুলো এখনো স্বপ্নে ভাসে। তখন এলাকায় চিংড়ির আবাদ সবে শুরু হয়েছে। বয়সী বন্ধুরা এই মাছ ধরে, এটা ওটা করে। আমার দ্বারা কিচ্ছু হয় না। অনেক কষ্টে জলের মাঝ থেকে একটা বড় চিংড়ি ধরলাম। চিংড়ি দামের সুবাদে বেশ নামকরা ছিল। ভাবলাম এই দামে কিছু একটা খেলনা হবে। দোকানে দিতেই দাম হলো দশ টাকা, বানের জলে মাছের দাম কোথায় ভেসে গেছে কী জানি!
বানের জল নেমে যাবার সঙ্গে সঙ্গে মাছেরা পানির ওপর ভাসতে থাকে। সবাই শুনি সকালে ফুলকুচি (মাছ ধরার যন্ত্রবিষেশ) দিয়ে মাছ কোপায়। বাবাকে অনেক বুঝিয়ে বিলে যাই। আমি নৌকা চালাই, বাবার সামনে সতর্ক দৃষ্টি। আমি নৌকা চালানোয় ভুল করে ফেলি, আর মাছ পাওয়া হয় না।
আমাদের বিলে পানি যখন শুকিয়ে যাওয়া শুরু করে পানি সেচে মাছ ধরা হয়। যাদের কুয়ো তারা মাছ ধরে যাবার পর পিছন থেকে সবাই মাছ ধরে, আমিও শখ বশত ওদের সাথে যাই। সবাই হাড়ি ভর্তি করে মাছ ধরে, আমার আর কিচ্ছু করা হয়ে ওঠে না।
পঞ্চম শ্রেণীর বৃত্তি পরীক্ষায় বিদ্যার দেবী সরস্বতীর একটা ছবি মেলা থেকে কিনে নিয়ে যাই। পরীক্ষা শেষে সব খাতায় তার ছবি বুলিয়ে দেই, বিশ্বাস ছিল দেবীর ছোঁয়ায় খাতা ভরে উঠবে হীরা, মনি-মানিক্যে। কিন্তু সাধারণ বৃত্তি পেয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়।
স্বপ্ন পূরণের যে ছকে বাঁধা জীবন সেটা হয়তো আমার জন্য ছিল না। এরপরের সবকিছুতেই স্বপ্নের কাছাকাছি গিয়ে গাড়ির চাকা থেমে যায়। তাই জীবনকে আর ধরে রাখতে চেষ্টা করিনি। সামনে যা এসেছে সেটাকেই মেনে নিয়েছি। মেনে নেওয়ার সংস্কৃতিতে হারিয়ে ফেলেছি ক্যাম্পাসের বন্ধুদের, সুন্দর সন্ধ্যা, আড্ডা, আর আজন্ম লালিত পরীক্ষার নম্বরপত্র।
অনার্স শেষে জীবনের জয়ভেরী যখন দিশাহীন তখন আমাদের প্রশাসনিক ভবনের সামনে ক্যাম্পাসের এক বড় ভাইয়ের সাথে দেখা হয়। একই হলে থাকার সুবাদে বেশ সখ্যতা ছিল বলেই বিশ্বাস করি। যেহেতু দিশাহীন গন্তব্য ছিল, আমি ভাইকে আধো অভিমানে বলে ফেলি এখন মনে হয় ক্যাম্পাসেই জব করতে হবে। ক্যাম্পাসে তখন সার্কুলার চলছিল। ভাই খুব রুক্ষভাবেই আমার প্রত্যুত্তরে আমার সীমাবদ্ধতার কথা স্মরণ করে দেন। আমি খুব চেষ্টা করলেও যে এই জব পাব না এটা এতো বিশ্রীভাবে বলেন আমার আর জবে অ্যাপ্লাই করার রুচি ছিল না। আমি ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসি।
>> আরও পড়ুন: হাত ভেঙেছে, থামেনি কনিকার এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন
আজ আমি বিসিএস ক্যাডার। মেধাক্রম ২৮ নিয়ে সহকারী পুলিশ সুপার হয়েছি। এই অবস্থানে এসে আমার শুধু তার কথাই মনে হয়। উনি আমার জীবনের লাইটপোস্ট, উনি নিজের অজান্তে আমার অনেক উপকার করে গেছেন। আমার এই ছোট্ট জীবনে যদি সম্মানের কোনো জায়গা থাকে, উনি নিসন্দেহে বিরাট একটা অংশ দখল করে রাখবেন। আমি আমৃত্যু ভাইয়ের জন্য শুভকামনা জানিয়ে যাব।
জীবনকে সব ক্ষেত্রেই আমার রহস্যময় মনে হয়। কই থেকে পজিটিভ ভাইভ আসবে কেউ জানে না। সব ধাপ পেরিয়ে ভাইভায় যখন থেমে যাচ্ছিলাম, একটা কথাই মনে হচ্ছিল, তাকে আমার জবাবটা দেওয়া হলো না। এখনো সময় পেলে প্রশাসনিক ভবনের কোনায় গিয়ে দাঁড়াই, যে চত্বর আমাকে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে। শিখিয়েছে কে আপন, কে পর।
>> আরও পড়ুন: ‘শৈশবে দুর্গাপূজা মানেই ছিল মামাবাড়ি যাওয়া’
সৃষ্টিকর্তা এই শেষ বিকেলে এসে স্বপ্নপূরণ করে দেবেন আমি কখনো ভাবতে পারিনি। মাঝে মাঝে জীবন আমাদের শেখায়, জীবন থামার জন্য নয়, পা চালালে নতুন অনেক পথের দিশা আপনাআপনি সৃষ্টি হয়। স্বপ্ন এক অদ্ভুত সুন্দর জিনিস, মাঝে মাঝে ঠিক ঠাহর হয় না কোনটি আসলে জীবন! স্বপ্নেরটা নাকি যাবতীয় যাপন!
জীবনকে আসলে আমি নিক্তি দিয়ে মাপতে চাই না। এই একটা পোশাক আমার মা-বাবা, বোনের কান্না মুছিয়েছে। আমার সহধর্মিণীর সম্মান রেখেছে। এর থেকে বড় পুরস্কার আমার আর চাই না এই জীবনে। এই কন্টকবস্ত্র আমাকে সব দিয়েছে, আমি এর যোগ্য সম্মান রাখার চেষ্টা করব।
জীবনের এই অদ্ভুত সুন্দর বন্ধুর পথে যারা আমাকে নিয়ে এসেছেন তাদের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা। যাদের কাছে অপরাধ করেছি আমি ব্যক্তিগত ভাবে ক্ষমা চেয়েছি, অজান্তে যাদের কষ্ট দিয়েছি তাদের প্রতি আমার ভালোবাসা রইলো। জীবন নিয়ত পরিবর্তিত হয়। পরিবর্তনই সংসারের নিয়ম। আমার খুব সাধারণ একটা জীবন যেন হয় সবাই এই আশীর্বাদ করবেন।
আমার সবকিছুর জন্য যারা সবকিছু উজাড় করে দিয়েছেন, আমার পরিবারের সবাই যেন সুস্থ থাকে সেই আশীর্বাদ করবেন। আমার শিক্ষক পিতামাতার রেখে যাওয়া আদর্শ যেন আমার চলার পথের পাথেয় হয়। আমার বাবা মায়ের বার্ধক্যজনিত ধকল যেন সৃষ্টিকর্তা আমার ললাটে দেন। আমাকে মানুষ করতে তাঁদের এই বন্ধুরতম পথ চলাচলের শেষ প্রান্তে এসে তাঁরা যেন মানসিক সুখ পান। অন্তত কিছু মানুষের পাশে যেন দাঁড়াতে পারি, তাদের চোখের জলের কিছুটা দুঃখ যেন আমার হয়, সেই প্রার্থনা করবেন। জীবন সুন্দর, জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক।
অবশেষে প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মচারী হিসেবে গেজেটেড হলাম। সবাই প্রার্থনায় রাখবেন।
লেখক: সহকারী পুলিশ সুপার, মেধাক্রম ২৮ (৪০তম বিসিএস)
এনএম