নিশীতা মিতু
১০ আগস্ট ২০২২, ১১:০৯ এএম
রক্তরাঙা লালচে পাতা। তার চারপাশে সবুজ রঙের মুক্তার মতো বর্ডার। এ যেন শিল্পীর শৈল্পিক এক সৃষ্টি। বাড়ির কোণায় কিংবা বাগানে এই পাতা আপনি দেখেছেন নিশ্চয়ই। তার সরু ডালের হালকা বেগুনি ফুলও মুগ্ধ করেছে হয়তো আপনাকে। পাতাবাহার হিসেবে চেনা এই গাছটির নাম কী জানেন আপনি? দেখতে যেমন সুন্দর, তেমনি এর নামও আভিজাত্যপূর্ণ। বলছিলাম পাতাবাহার গাছ কৈলাসের কথা।
সাধারণত কৈলাস শব্দটি শুনলেই আমাদের মাথায় আসে পর্বতের নাম। তবে হিমালয়ের কোনো অংশের কথা বলছি না। আমাদের চোখের সামনে বেড়ে ওঠা পাতাবাহার গাছটি সম্পর্কে বলছি। যার নাম আমরা অনেকেই জানি না। এর ইতিহাসও হয়তো অজানা।
আজ থেকে প্রায় দুইশ বছর আগে রাণী ভিক্টোরিয়ার আমলে কৈলাসের প্রথম বিস্তার ঘটেছিল। এগুলো বেশিরভাগ রাখা হতো পার্লারের অভ্যন্তরে। ভিক্টোরিয়ান পার্লারগুলো ছিল বসতবাটির বিশাল আকারের ড্রইংরুমের মতো। বাড়ির লোকজন এই কক্ষ খুব একটা ব্যবহার করতেন না। কেবল রবিবারে অতিথিকে আপ্যায়ন করার জন্য ঘরটি ব্যবহৃত হতো।
নান্দনিকভাবে রঙ-বৈচিত্র্যে অলংকৃত করা হতো সেই বিশাল ঘর। আর ঘর সাজানোর অন্যতম একটি উপাদান ছিল কৈলাস। জানালার পাশে যা স্থান পেত। চড়া দামে কিনতে হতো এই গাছ।
ইন্দোনেশীয় দ্বীপ জাভা থেকে তখন এসব কৈলাসের আগমন ঘটতো পার্লারকে কেন্দ্র করে। তবে মূল্য বেশি হওয়ায় এই গাছের ব্যবহার ছিল সীমিত। কেবল অবস্থাপন্ন অভিজাত মানুষদের ঘরেই শোভা বাড়াত কৈলাস। পরবর্তীতে উৎপাদন খরচ কমে যাওয়ায় সাধারণ মানুষও গাছটি কিনতে শুরু করেন।
পুরাতন ভিক্টোরিয়ান গার্ডেনগুলোতে কৈলাস লাগানো হতো ‘কার্পেট গার্ডেনিং’ পদ্ধতিতে। উঁচু বিল্ডিংয়ের জানালা বাঁ বারান্দা থেকে দেখলে একে মনে হতো পারস্য গালিচা। তাই লিভিং কার্পেট হিসেবেও পরিচিত এটি।
কৈলাসের বর্তমান বৈজ্ঞানিক নাম 'প্লেকট্রানথাস স্কুটেলারিঅয়ডিজ' (Plectranthus scutelarioides)। এই পরিবারে পরিচিত উদ্ভিদদের মধ্যে রয়েছে তুলসি, পুদিনা, ল্যাভেন্ডার, অরেগ্যানো ইত্যাদি। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, আফ্রিকা প্রভৃতি দেশগুলোতে গাছটি জন্মে থাকে। গ্রীক শব্দ ‘কোলিয়াস’ থেকে বাংলাদেশে একে আত্তীকরণ করা হয়েছে ‘কৈলাস’ নামে।
কাটিং বা বীজ থেকে কৈলাসের চারা উৎপন্ন করা যায়। অনুর্বর মাটিতেও এটি জন্মাতে সক্ষম। টব প্রস্তুতিতে ১ ভাগ মাটির সঙ্গে ২ ভাগ বালি ও ২ ভাগ পিট মিশিয়ে নিলে ভালো হয়। জানালার ধারে বা বারান্দায় উজ্জ্বল আলোকিত স্থান কৈলাসের জন্য উপযুক্ত। সকাল বা বিকালের কিছুটা সময় সরাসরি সূর্যালোক পাওয়া গাছের জন্য ভালো। কিন্তু দুপুরের তীব্র আলো অধিকাংশ প্রজাতিই সহ্য করতে পারে না।
কৈলাস মূলত পত্রসর্বস্ব গাছ, অর্থাৎ পাতাবাহার। তবে এর সুন্দর ফুলও হয়। ফুল থেকে বীজ তৈরি করে নতুন চারা প্রস্তুত করা যায়।
কেবল যে বাহ্যিক সৌন্দর্য রয়েছে তা নয়, কৈলাস থেকে নানা ধরনের ওষুধও তৈরি হয় পৃথিবীর নানা দেশে। আয়ুর্বেদে এর ব্যবহার আছে হার্টের অসুখ, বুক ব্যথা, ফুসফুস, পরিপাকতন্ত্র, নিদ্রাহীনতা ইত্যাদি রোগে। কৈলাস গাছে ‘ফরস্কোলিন’ নামক রসায়ন থাকে যা পেশীকে শিথিল করে, ব্লাড প্রেশার কমিয়ে দেয়, থাইরয়েড গ্রন্থির কাজ করে বিশেষত যখন গ্রন্থি কম কাজ করে। চক্ষু চিকিৎসায় এবং ওজন কমাতেও সাহায্য করে এটি। বিদেশের বাজারে কৈলাসের ক্যাপসুল কিনতে পাওয়া যায়। উপমহাদেশে কৈলাসের জনপ্রিয়তা বাড়ছে আমেরিকা ইউরোপের মতই।
কৈলাসকে এক ধরনের বেডিং প্লান্ট বলা যায়। যেসব গাছ পার্ক, রাস্তার পাশে বা বাড়ির সামনের দিকের উঠানে লাগানো হয় তাদের বেডিং প্লান্ট বলে। এই গাছ খাড়া, ঝোপালো বা লতাজাতীয় হতে পারে। বিভিন্ন রকম রং ও উচ্চতার জন্য একে নির্বাচিতভাবে শোভা বর্ধনের জন্য লাগানো হয়।
এনএম