১৫ জুন ২০২৫, ০৮:৫৭ পিএম
মাঝরাতে চলার সময় হঠাৎ আয়নায় চোখ পড়লে চমকে উঠি, আরে আম্মু কেনো এখানে এই সময়ে? আবার মনে পড়ে, আমিই যেন আম্মুর মতো হয়ে যাচ্ছি দিনকে দিন। জীবনের চার দশক পার হয়ে এসে নিজেকে যখন খুব ক্লান্ত লাগে, মনে হয় মন মাঝিকে বলেই দেই ‘আমি তো আর বাইতে পারি না’। তখন মনে পড়ে, দুইজন সাদাটে চোখ আর পাকাচুল মানুষ এখনও ছাতার মতো ছেয়ে আছেন মাথার ওপর। মনে পড়ে, তাদের কাছ থেকে নিতে নিতে আকণ্ঠ ঋণে ডুবে আছি; কিছুই ফেরত দেইনি। তখন আরও একবার জীবনকে কী মূল্যবান লাগে। মনে হয়, যে কয়টা সেকেন্ড আরও বেঁচে আছি, সবটুকু কাজে লাগাব। সম্ভবত তখন একটু খুশি করা যাবে এই দুইজনকে।
আমার মাঝেমধ্যে খুব অদ্ভুত একটা চিন্তা আসে। ঈসা আলাইহিস সালামকে আল্লাহ যেভাবে পাঠিয়েছিলেন, দুনিয়ার সব মায়েদের কেনো অমনিই মা বানিয়ে দিলেন না? কেনো একটা বাচ্চাকে দুনিয়ায় আনার জন্য এক জোড়া দম্পতিকে নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে একসঙ্গে থাকতে হয়। কেনই বা একটা বাচ্চা দুনিয়ায় বাবার নাক; মায়ের চুল অথবা অন্য অনেকগুলো একই রকম বৈশিষ্ট্য নিয়েই দুনিয়ায় আসে?
আমি শিক্ষক। আনুষ্ঠানিক শিক্ষকতার প্রথম সাত বছর দেখেছি স্কুলের বাচ্চাদের। সেই সময়ের একটা মজার বৈশিষ্ট্য হল, বাচ্চাদেরকে তাদের বাপ-মায়েরাই নিয়ে আসেন; তাদেরকে নিবিড়ভাবে দেখার সুযোগ হয়। খুব গোছানো, টিপটপ পরিবারের আত্মবিশ্বাসী বাচ্চা, আবার বাবা-মায়েরা আলাদা থাকছেন এমন বাচ্চাদেরও দেখেছি। একটা সময়ে গিয়ে আমার সেই প্রশ্নটার যেন জবাব পেয়ে গেলাম; কেনো আল্লাহ চান যে মানুষ একটা পরিবার তৈরি করে তারপরে একটা বাচ্চাকে দুনিয়ায় নিয়ে আসুক।
একটা সন্তান বাবা আর মা, দুইজনের থেকে কী কী পায়? কেবলই নাক-মুখ-চোখ? আজকে বাবার কথা লিখি। আমি বিভিন্ন জায়গায় যখন কথা বলি, তখন আমার আব্বুকে টের পাই। কি করে মাথায় যুক্তি তৈরি করতে হয়, সেটা নিয়ে কথা বলতে হয়, কি করে দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়, কি করে নিজের যুক্তিতে না মিললেও অন্যের কথা হাসিমুখে শোনা যায়। আর যখন মানুষের সঙ্গে মিশি, তখন টের পাই মা’কে। একদিন এক জায়গায় দেখলাম, কিছু মানুষ সামাজিক যোগাযোগ থেকে শক্তি সংগ্রহ করে। সঙ্গে সঙ্গে বুঝলাম, কেনো বাসায় কেউ আসলে আম্মু তাকে ডাইনিং রুমে বসিয়ে কাজ করতে করতে গল্প করেন। আমিও সেই কাজটাই করি।
মায়েদের একটা বাড়তি সুবিধা আছে। শরীরের মধ্যে যখন অন্য একটি প্রাণ বড় হতে থাকে, একজন মা সেই সময়টায় নিজের অজান্তেও আস্তে আস্তে মা হয়ে ওঠার যাত্রাটা শুরু করে দেন। একজন বাবার জন্য সে যাত্রায় নিজেকে তৈরি করে নিতে হয়। তাকে বাবা হয়ে উঠতে হয়। শারীরিকভাবে একজন মা যখন যুঝতে থাকেন, একজন বাবা প্রাণপণ চেষ্টা করে যান বাবা হবার। কী সুন্দর সেই যাত্রা, কী মহিমান্বিত সেই প্রচেষ্টা। আমি আমার বাবাসহ কাছের আরও অনেকের এই যাত্রাটা দেখি, আর ভাবি, মায়ের কথা তিনবার আসার পরে বাবার কথা কেন বলা হয়েছে হাদীসে। গর্ভে ধরেননি, তবু কষ্ট-ঘামের পয়সা খরচ করে আর মূল্যবোধ শিখিয়ে যে বাবারা সন্তানের জীবনের সিঁড়িগুলো তৈরি করে দেন, তাদের এই চেষ্টায় যেন মুছে যায় সকল অপারগতা, অযোগ্যতা।
লেখক: প্রকৌশলী মারদিয়া মমতাজ, শিক্ষক, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি