শিশুকালে বাবাকে হারিয়েছেন আমার বাবা। এত ছোট ছিলেন যে বাবার কোনো স্মৃতি তার মনে নেই। নিদারুণ কষ্টে, খেয়ে না খেয়ে তিন সন্তানকে লালন পালন করতে হয়েছে দাদীকে। বাবা বড় সন্তান হওয়ায় একসময়ে বাবাকে পরিবারের হাল ধরতে হয়েছে। কিন্তু এত কষ্টের জীবন ছিল তাদের তবুও উচ্চশিক্ষা লাভের অদম্য ইচ্ছাপূরণে বাবা-চাচা সফল হয়েছেন। দেশের একাধিক জায়গায় শিক্ষকতা করে বাবা একসময় থিতু হন নিজ এলাকা পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলার অন্যতম বিদ্যাপীঠ সুবিদখালী রহমান ইসহাক পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। স্বনামধন্য এই প্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেলেও বাবাকে ইংরেজী দ্বিতীয় পত্র পড়াতে হয়েছে বহুবছর। তার সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীরাও কেনো যেন ‘ইসলাম ধর্মের’ পাশাপাশি ইংরেজিটাও বাবার কাছে পড়তে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করত।
শিক্ষকতার পাশাপাশি একটা সময় বাবা উপজেলা নিকাহ রেজিস্ট্রার হিসেবে নিয়োগ পান। আগে পুরো উপজেলায় একজন নিকাহ রেজিস্ট্রার ছিল। বর্তমানে প্রতি ওয়ার্ডে একজন দায়িত্ব পালন করেন। যে কারণে বাবাকে মির্জাগঞ্জের মানুষ ‘কাজী সাহেব’ বলে সম্মোধন করেন। স্কুল আঙ্গিনায় বাবা পরিচিত ছিলেন কাজী হুজুর নামে। এখনও দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা শিক্ষার্থীদের মনে বাবা সম্মানের আসনে আছেন বলে বিশ্বাস করি।
বিজ্ঞাপন
এবার অন্য প্রসঙ্গে আসি। আট ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট হওয়ায় আমি সবসময় কিছুটা বাড়তি আদর পেয়েছি পরিবারে। তবে কখনও অন্যায় আবদারে সহযোগিতা তো মেলেইনি, বরং উল্টো শাসিয়ে দেওয়া হয়েছে কখনও যেন এমন আবদার না করা হয়। আমাদের বড় পরিবার চলতো বাবার একার আয়ে। বাবা-মায়ের স্বপ্ন ছিল নিজেরা কষ্ট করলেও আমাদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করার পাশাপাশি যোগ্য সন্তান হিসেবে গড়ে তোলার। সবসময় আমাদের বাবা বলতেন, চলার পথে সবসময় মনে রাখবে তুমি কার ছেলে। এমন কিছু করবে না যাতে আমার সম্মানহানী হয়। জানি না কতটুকু বাবার যোগ্য সন্তান হতে পেরেছি, তবে বাবার এই নির্দেশনার কথা মাথায় রাখার চেষ্টা করি সবসময়।
বাবা প্রায়ই বলতেন, আমি যা আয় করেছি তা দিয়ে তোমাদের সবাইকে বড় করেছি। তোমরাও অসৎ কিছু করবে না। হালাল পয়সা আয় করবে। আল্লাহ তোমাদের চালাবে। দেখবে কোথাও ঠেকবে না। আর আল্লাহকে ভুলবে না। নামাজ ছাড়বে না। চেষ্টা করি বাবার কাছ থেকে পাওয়া শিক্ষা ব্যক্তি জীবনে পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে। আল্লাহর কাছে সাহায্য চাই আমৃত্যু যেন বাবার নির্দেশনা মেনে চলতে পারি।
সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও বাবা কোনোদিন আমাদের অভাব বুঝতে দেননি। বাজারের সবচেয়ে বড় মাছ থেকে শুরু করে চেষ্টা করেছেন সন্তানদের পছন্দের ভালো জিনিসগুলো কিনতে।
নিজে বাবা হওয়ার পর মাঝেমধ্যে চিন্তা করি; কীভাবে একার আয় দিয়ে এত বড় পরিবারের ব্যয় নির্বাহ করতেন আমার বাবা?
বিজ্ঞাপন
যখন কর্মজীবনে ছিলেন তখন সুঠাম দেহের অধিকারী ছিলেন বাবা। বন্ধের দিন ছাড়া উপজেলা সদরের স্কুল থেকে প্রতিদিন বাবাকে অর্ধেক পথ ইটের ভাঙা রাস্তায় রিকশা দিয়ে, বাকি পথ পায়ে হেঁটে গ্রামের বাড়ি যেতে হতো। রাস্তায় রিকশার সংকট থাকলে কখনও পুরো পথ পায়ে হেঁটে যেতেন। ফলে বাড়িতে যেতে যেতে বাবা অনেকটা ক্লান্ত হয়ে পড়তেন। ঘামে ভিজে যেত ধবধবে সাদা জামা। বাড়ির ভেতরে ঢোকার আগেই আমরা টের পেয়ে যেতাম বাবা আসছেন। মাকে দেখতাম দ্রুত হাতপাখা আর পানির গ্লাস নিয়ে অপেক্ষা করতেন। ঘরে ঢুকেই বাবা শব্দ করে শ্বাস নিতেন। আশপাশের লোকজন শুনতেন সেই শব্দ। আবার পরের দিন দিব্বি ক্লাসে চলে যেতেন। এভাবে করেই তার কেটে গেছে বহুকাল।
তবে ইটের রাস্তা শেষ করে মাটির রাস্তা দিয়ে বাবা যখন বাড়ি যেতেন বৃষ্টির সময় যেন তাকে যুদ্ধ করতে হতো। কারণ বৃষ্টির কারণে প্রচুর কাদা হয়ে যেত রাস্তা। বিশেষ করে দুই একটি পয়েন্টে ভরা বৃষ্টিতে হাঁটুসমান কাদা থাকত। অনেক সময় লাগত সেই জায়গা শুকাতে। বছরের পর বছর এই রাস্তা দিয়ে বাবা স্কুলে যাওয়া-আসা করেছেন। বাবার কত না কষ্ট হত বর্ষা মৌসুমে। কিন্তু কাউকে কিছু বলতেন না। ক্লান্ত শরীরে ঘরে ফিরে নামাজ শেষে রাতের খাবার খেয়ে পরদিন আবারও ঠিকই ছুটতেন স্কুলে।
অথচ বাবা এখন পূর্ণ অবসরে। গ্রামের বাড়িতেও বিদ্যুৎ এসেছে। মাটির সেই রাস্তা এখন পিচ ঠালাই দেওয়া। দিনরাত যানবাহন ছুটে চলে। কিন্তু বাবার এখন এই রাস্তা দিয়ে চলারও প্রয়োজন হয় না। আর চলার সেই শক্তিও নেই। মাঝেমধ্যে মনের অজান্তে ভাবি বাবার স্কুলে যাওয়া-আসার সময়ে যদি এমন রাস্তা থাকত তার কোনো কষ্ট হত না।
বয়সের ভারে বাবা এখন অনেকটা কাহিল। শুকরিয়া ৮০ বছর পার হওয়া বাবার অস্বাভাবিক কাশির বাইরে খুব একটা সমস্যা নেই। কিছুদিন ধরে কিছুটা স্মৃতিশক্তি লোপ পাচ্ছে বলে মনে হয়েছে। চিকিৎসা চলছে। আগের মতো খাওয়া-দাওয়া করতে পারছেন না। তবে বাবা ঘরে যতক্ষণ থাকেন ঘুম ছাড়া বাকি সময় কোরআন তেলাওয়াত আর দোয়া দরুদ পড়েই কাটে। এর বাইরে বেশিরভাগ সময় কাটে মসজিদের জায়নামাজে। অনেক সময় আজান হওয়ার আগেই দ্রুত চলে যান মসজিদে। দাঁড়িয়ে নামাজ পড়তে এখন পারছেন না; বিধায় মসজিদের প্রথম কাতারে কর্নারে তার জায়নামাজ বিছানো থাকে। সেখানে বসে বসে নামাজ আদায় শেষে তসবিহ-তাহলিল করে দিন কাটে বাবার। কেন যেন মনে হয় এই জায়নামাজই এখন বাবার সবচেয়ে স্বস্তির জায়গা। এর বাইরে দুনিয়ার কোনো ভাবনা বাবার নেই। আমরাও চাই না সন্তান, পরিবার, সংসার নিয়ে নূন্যতম কোনো চিন্তা বাবার মনে আসুক। সবচেয়ে বড় চাওয়া আল্লাহ যেন বাবা নামের এই বটবৃক্ষকে সুস্থভাবে, ঈমানের সঙ্গে আমাদের মাথায় ছায়া হিসেবে আরও অনেকদিন বাঁচিয়ে রাখেন। ঈমানের সঙ্গে কবুল করেন। আমিন।
বাবা দিবসে সব বেঁচে থাকা বাবাদের নেক হায়াতের জন্য দোয়া। যারা পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন তাদের জন্য ক্ষমার প্রার্থনা। ভালো থাকুন বাবারা।
লেখক: সাংবাদিক

