আমিনুল ইসলাম মল্লিক
০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০২:৪৭ পিএম
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরে সংস্কারের উদ্যোগ নেয়। এর অংশ হিসেবে বিচার বিভাগ সংস্কারেও গঠন করা হয় একটি কমিশন। সেই কমিশন সম্প্রতি সংস্কারের বেশ কিছু সুপারিশ সরকারের কাছে হস্তান্তর করেছে। এই কমিশনের কিছু সুপারিশ সমাদৃত হলেও কোনো কোনো সুপারিশ নিয়ে বিভিন্ন মহলে সমালোচনা হচ্ছে। বিশেষ করে বিভাগীয় পর্যায়ে হাইকোর্ট স্থাপন এবং উপজেলা পর্যায়ে আদালত গঠনের সুপারিশের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন আইনজ্ঞদের কেউ কেউ।
বিভাগীয় পর্যায়ে হাইকোর্টের বেঞ্চ স্থাপনের প্রস্তাবকে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং আদালত অবমাননার শামিল বলে উল্লেখ করেছেন আইনজ্ঞদের কেউ কেউ। বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশন এ বিষয়ে কতটুকু গবেষণা করেছে সেটা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তারা। আইনজীবীরা বলছেন, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে বিভাগীয় পর্যায়ে হাইকোর্ট বেঞ্চ গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। সেটি সুপ্রিম কোর্ট মানেননি এবং পরবর্তী সময়ে অবৈধ ঘোষণা করেন। একই বিষয়ে নতুন করে এরকম সিদ্ধান্ত সরকার নিতে পারে না। জাতীয় সংসদের যেকোনো সিদ্ধান্ত সুপ্রিম কোর্ট অবৈধ ঘোষণা দিতে পারেন। এরকম কোনো সিদ্ধান্ত সরকার নিলে সুপ্রিম কোর্টের এখতিয়ার আছে তা অবৈধ ঘোষণার।
বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশনের সুপারিশ আদালত অবমাননার শামিল বলে মন্তব্য করেছেন হিউম্যান রাইডস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। তিনি বলেন, নিষ্পত্তি হওয়া একটা বিষয়, সেটেল্ট হওয়া একটা বিষয় নিয়ে বিচার বিভাগীয় কমিশনের সুপারিশ অপ্রয়োজনীয়। হাইকোর্ট স্থানান্তরের বিষয়টি সেটেল্ট হয়ে গেছে অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে। বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশন যে সুপারিশ করেছে তা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও আদালত অবমাননার শামিল।
এই আইনজ্ঞ আরও বলেন, আমাদের দেশের যোগাযোগব্যবস্থা এখন অনেক উন্নত। মানুষ চাইলে খুব অল্প সময়ের মধ্যে ঢাকায় আসতে পারে। বরিশাল থেকে তিন ঘণ্টায় ঢাকায় আসা যায়। একটা উপজেলা থেকে জেলা সদরে আসতে আর বেশি সময় লাগে না। তাহলে কেন হাইকোর্ট সরিয়ে বিভাগীয় পর্যায়ে স্থাপন করতে হবে।
মনজিল মোরসেদ বলেন, যেসব এলাকা থেকে জেলা সদরে হেঁটে আসতে হতো, কোনো রাস্তাঘাট ছিল না, যোগাযোগব্যবস্থা ছিল না, তখন মানুষের বিচার পাওয়ার জন্য চৌকি আদালত গঠন করা হয়েছিল। ব্রিটিশ আমলেই এটা করা হয়েছিল। এখন সেই পরিস্থিতি নেই। আর সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে বিভাগীয় পর্যায়ে হাইকোর্ট বেঞ্চ গঠনের সিদ্ধান্ত সেটেল্ট হয়ে গেছে। এখন এগুলো বলা মানে হচ্ছে আদালত অবমাননার শামিল। তবে বিভাগীয় পর্যায়ে অস্থায়ীভাবে হাইকোর্ট বেঞ্চ বসানো যাবে বলে মনে করেন এই আইনজীবী।
সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের সাবেক বিচারপতি ও সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার এবিএম আলতাফ হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, এরশাদ সাহেবের আমলে হাইকোর্টের কয়েকটি বেঞ্চ বিভাগীয় পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। পরে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে এমন সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। চট্টগ্রাম রংপুর খুলনাসহ কয়েকটি এলাকায় হাইকোর্ট স্থাপন করা হয়েছিল। পরে আপিল বিভাগ এটি অবৈধ ঘোষণা করেছিল। বেসিকেলি অষ্টম সংশোধনী সেটেল্ট হয়ে গেছে। আবার যদি বিভাগীয় পর্যায়ে হাইকোর্টের বেঞ্চ নেওয়া হয়, তাহলে এটা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে।
জেলা থেকে উপজেলা পর্যায়ে আদালত বিকেন্দ্রীকরণের বিষয়ে এই আইনঙ্গ বলেন, মামলা জট কীভাবে দূর করা যায় সেটি হচ্ছে বিবেচ্য বিষয়। কীভাবে মামলা জট কমানো যায় সেটি দেখতে হবে। যদি বিচার বিভাগীয় কমিশন মনে করেন এমন সিদ্ধান্ত নিলে মামলা জট কমবে তাহলে আদালত বিকেন্দ্রীকরণ করা যেতে পারে। মামলার জট বুঝে এরকম সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে।
আদালতের আর্থিক ব্যবস্থার বিষয়ে তিনি বলেন, দেশের বিচার বিভাগীয় কাজের আর্থিক বরাদ্দ সুপ্রিম কোর্টের হাতেই থাকা উচিত। কারণ মাজদার হোসেন মামলার মূল স্পিরিট ছিল এমন। এজন্য বিচার বিভাগের জন্য আর্থিক বরাদ্দ সুপ্রিম কোর্টের হাতেই থাকতে মত দিয়েছেন তিনি।
কী বলা হয়েছে সংস্কার কমিশনের সুপারিশে
গত বুধবার (৫ ফেব্রুয়ারি) অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে হস্তান্তর করা ৩৯০ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনে বিচারহীনতার সংস্কৃতি, বিচার বিভাগের আর্থিক স্বাধীনতা, মামলা জট হ্রাস, আদালতের বিকেন্দ্রীকরন, মোবাইল কোর্ট, গ্রাম আদালত, আইন পেশা ও শিক্ষার সংস্কারসহ ৩১টি বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত সহকারে নানা সুপারিশ তুলে ধরেছে কমিশন।
সংস্কার কমিশনের খসড়া সুপারিশে বিভাগীয় পর্যায়ে হাইকোর্ট স্থানান্তর প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, প্রতিটি স্থায়ী বেঞ্চ কোন কোন এলাকা থেকে উদ্ভূত মামলা গ্রহণ করতে পারবে সেটি সুনির্দিষ্ট করে দিতে হবে। তবে বিচার কাজ পরিচালনা এবং রায়, আদেশ, নির্দেশ ইত্যাদি দেয়ার ক্ষেত্রে হাইকোর্টের এখতিয়ারের পূর্ণাঙ্গতা বজায় রাখতে হবে। অর্থাৎ স্থায়ী বেঞ্চগুলো স্থাপনের কারণে দেশব্যাপী কর্তৃত্ব প্রয়োগের ক্ষেত্রে হাইকোর্ট বিভাগের এখতিয়ার কোনো ভৌগোলিক সীমারেখা দিয়ে বিভাজিত হবে না এবং রাষ্ট্রের একক চরিত্র ক্ষুণ্ণ হবে না।
এতে আরও বলা হয়েছে, প্রধান বিচারপতি স্বতঃপ্রণোদিতভাবে বা কোনো স্থায়ী বেঞ্চে বিচারাধীন মামলার কোনো পক্ষের আবেদনের ভিত্তিতে যৌক্তিক কারণে বা ন্যায়বিচারের স্বার্থে ওই মামলা অন্য কোনো যথাযথ বেঞ্চে স্থানান্তর করতে পারবেন। সব স্থায়ী বেঞ্চ এক সঙ্গে কার্যকর করা কঠিন মনে হলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পর্যায়ক্রমে বিভাগীয় সদর দপ্তরগুলোতে স্থায়ী বেঞ্চ কার্যকর করা যেতে পারে বলে সংস্কার কমিশনের খসড়ায় সুপারিশ করা হয়েছে।
বিভাগীয় স্থায়ী বেঞ্চগুলো সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য আদালত ও সহায়ক কার্যালয়, বিচারক ও সহায়ক জনবলের জন্য উপযুক্ত বাসস্থানসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো স্থাপন এবং প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে বলেও সুপারিশ করা হয়েছে।
এআইএম/জেবি