মুহা. তারিক আবেদীন ইমন
২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১১:৪০ এএম
দেশের অন্যান্য ব্যাংকের মতো এবি ব্যাংকেও গত ১৫ বছরে কিছু অনিয়ম হয়েছে। তবে একীভূত হওয়ার মতো খারাপ অবস্থা হয়নি। বর্তমানে এবি ব্যাংক যে অবস্থায় আছে, সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়াতে আমাদের সময় লাগবে প্রায় তিন বছর। আর করপোরেট গভর্নেন্স ধরে রাখা গেলে আগামী ১০ বছরের মধ্যে আমরা দেশের শক্তিশালী ব্যাংকের তালিকায় নাম লেখাতে পারব।
কথাগুলো বলছিলেন বেসরকারি খাতের এবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ মিজানুর রহমান। ঢাকা মেইলের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় ব্যাংকটির বর্তমান অবস্থা তুলে ধরেন তিনি। সম্প্রতি তার মুখোমুখি হন ঢাকা মেইলের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক তারিক আবেদীন ইমন।
সৈয়দ মিজানুর রহমান: দীর্ঘদিনের কিছু অনিয়মের কারণে ব্যাংক কিছুটা দুর্বল হয়েছে। তবে আমাদের ব্যাংকের ভিত্তি এখনো মজবুত। খুব বেশি তারল্য সংকট নেই এবং আমানত ধীরে ধীরে বাড়ছে। গত ৯ মাসে নিট আমানত বেড়েছে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার বেশি। নতুন আমানত এসেছে ৮ হাজার কোটি টাকারও বেশি। ব্যাংকের গ্রাহকরা এখনো আমাদের ওপর আস্থা রেখেছেন। বর্তমানে ব্যাংকে ফরেনসিক অডিট চলছে, যা শেষ হতে ৩-৪ মাস সময় লাগবে। অডিট শেষ হলে পুরো চিত্র পরিষ্কার হবে এবং কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন সহজ হবে।
সৈয়দ মিজানুর রহমান: পুরো ব্যাংক খাত চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে এগোচ্ছে। তবে আশার কথা হলো, আট মাস আগে যে অবস্থায় ছিল ব্যাংকিং খাত, এখন আর সেই অবস্থায় নেই। ব্যাংকে জমানো টাকা চাহিদামাফিক পরিশোধ করা হচ্ছে, যা গ্রাহকের মূল চাওয়া। খেলাপি ঋণ আদায়ে আইনি ও অন্যান্য পদক্ষেপ চলছে এবং এ বছরের মধ্যে এর ফলাফল দেখা যাবে। বর্তমানে সারা দেশে ১০৪টি পূর্ণাঙ্গ শাখা, সাব-ব্রাঞ্চ, এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেট এবং ২৭০টিরও বেশি এটিএম বুথ আছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে, ভারতের মুম্বাইয়ে একটি শাখা, মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুনে একটি প্রতিনিধি অফিস এবং হংকংয়ে নিজস্ব মালিকানাধীন সাবসিডিয়ারি এবি ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স লিমিটেড পরিচালনা করছে। ব্যাংকটির পাঁচটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যার মধ্যে অফশোর ব্যাংকিং ইউনিট এবং কাস্টোডিয়াল সার্ভিসও অন্তর্ভুক্ত। আমরা ভবিষ্যতে বিদেশে আমাদের ব্যাংকিং পরিধি আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা নিচ্ছি। বিশেষ করে দ্রুত সময়ের মধ্যে ভারতের কলকাতায় আরেকটি শাখা করার চিন্তা রয়েছে।
আরও পড়ুন
‘কোমর ভাঙা’ এক্সিম ব্যাংকের দাঁড়িয়ে থাকার ভান!
থার্ড ক্লাস’ এমডিতে ফার্স্ট সিকিউরিটির সর্বনাশ!
সৈয়দ মিজানুর রহমান: অনেক ‘প্রথমের’ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছি—প্রথম এটিএম স্থাপন, প্রথম বিদেশি শাখা, প্রথম সিন্ডিকেশন ফাইন্যান্সিং। তবে সবচেয়ে বড় অর্জন হলো গ্রাহকের আস্থা অর্জন করা এবং টেকসই ব্যাংকিং সেবা প্রদান করা। আমরা সেই দিকেই বেশি নজর দিচ্ছি। আশা করব আমরা গ্রাহকদের আস্থা ধরে রাখতে পারব। আমরা বিস্তৃত বৈচিত্র্যপূর্ণ পণ্য ও সেবা দিয়ে দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যাংকের অবস্থান নিশ্চিত করেছি। স্টুডেন্ট ব্যাংকিং, প্রায়োরিটি ব্যাংকিং, এসএমই ঋণ, নারী উদ্যোক্তা ঋণ, ভোক্তা ঋণ, ডেবিট-ক্রেডিট কার্ড, এটিএম, ইন্টারনেট ও এসএমএস ব্যাংকিং, রেমিট্যান্স সেবা, ট্রেজারি পণ্য, করপোরেট ফাইন্যান্স, ইসলামি ব্যাংকিং, প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য বিশেষ সেবা এবং মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাপ—সবই রয়েছে। আমাদের রিলেশনশিপ ম্যানেজাররা গ্রাহকের আর্থিক সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
সৈয়দ মিজানুর রহমান: এবি ব্যাংক তার পণ্য ও সেবার মান বজায় রাখতে অত্যন্ত যত্নশীল। ব্যাংকে একজন মেধাবী ও উদ্যমী কর্মকর্তাদের দল কাজ করছে, যারা নতুন উদ্ভাবনী পণ্য ও সেবা নিয়ে আসতে সক্ষম। আমাদের কর্মকর্তারা নতুন ব্যবসা অর্জনে সম্পূর্ণ সক্রিয় ও অনুপ্রাণিত। পাশাপাশি, দক্ষ পরিচালনা পর্ষদ করপোরেট সুশাসন বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ব্যাংকের শক্তিশালী মূলধন ও পর্যাপ্ত লিকুইডিটি আমাদের দীর্ঘমেয়াদি স্থায়িত্বের একটি শক্তিশালী নিশ্চয়তা প্রদান করে। গ্রাহকের চাহিদামাফিক অর্থ পরিশোধে এবি ব্যাংক কখনো ব্যর্থ হয়নি। গ্রাহকের সুবিধার্থে ব্যাংক ট্রেড অপারেশন অটোমেশন, করপোরেট ব্যাংকিংয়ে নতুন সেবা, নিরাপদ ও নির্ভুল সেবা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন আধুনিক সেবা চালু করেছে। তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক ব্যাংকে রূপান্তরিত হয়ে, আমরা গ্রিন ব্যাংকিং ও ডিজিটাল তথ্য সংরক্ষণ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, আমাদের গ্রাহকরা এবি ব্যাংকের অ্যাপ ব্যবহার করে দেশজুড়ে সহজেই লেনদেন করতে পারেন। এছাড়া, ব্যাংকে ইসলামিক ব্যাংকিং, এজেন্ট ব্যাংকিং এবং আধুনিক প্রযুক্তিভিত্তিক অন্যান্য সর্বাধুনিক সেবাও প্রদান করা হচ্ছে।
সৈয়দ মিজানুর রহমান: মূল লক্ষ্য ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা। আমরা করপোরেট ঋণ বিতরণ আপাতত স্থগিত রেখেছি এবং কৃষি, এসএমই এবং নিরাপদ খাতগুলোকে অগ্রাধিকার দিচ্ছি। নতুন উদ্ভাবনী সেবা চালু করে গ্রাহক সেবা উন্নয়ন ও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দেওয়াই আমাদের লক্ষ্য।
সৈয়দ মিজানুর রহমান: খেলাপি ঋণ আদায়ে সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে। ছোট ছোট গ্রাহকের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে। একটি টাস্কফোর্স ও বিশেষ পুনরুদ্ধার দল গঠন করা হয়েছে। গত পাঁচ মাসে প্রায় ১৬শ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ আদায় করা হয়েছে এবং প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। আমরা ছোট গ্রাহকদের থেকে আশানরূপ সাড়া পাচ্ছি। একই সঙ্গে বড় গ্রাহকদের থেকে অর্থ উদ্ধারে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।
সৈয়দ মিজানুর রহমান: বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান ডেলয়েট তিনটি ব্যাংকের অ্যাসেট কোয়ালিটি রিভিউ করছে। এটি আইএমএফের শর্তের অংশ। জনগণ আতঙ্কিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। এবি ব্যাংক নিয়মিত আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। অনেকেই ধারণা করছেন, এই অডিটের কারণে এবি ব্যাংক একীভূত হতে পারে। এটা ভুল ধারণা। এবি ব্যাংক এখনো একীভূত হওয়ার মতো খারাপ অবস্থায় নেই। আমরা দ্রুতই ঘুরে দাঁড়াব।
সৈয়দ মিজানুর রহমান: দেশের অন্যান্য ব্যাংকের মতো এবি ব্যাংকেও গত ১৫ বছরে কিছু অনিয়ম হয়েছে। এজন্য আমাদের খেলাপি ঋণ ৭০ শতাংশ ছাড়িয়েছে এবং প্রভিশনেও ঘাটতি রয়েছে। যদিও ডেফারেল সুবিধার মাধ্যমে প্রভিশন সংরক্ষণে আমরা কিছু সুবিধা ভোগ করছি। বর্তমানে এবি ব্যাংক যে অবস্থায় আছে, সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়াতে আমাদের সময় লাগবে প্রায় ৩ বছর। আর করপোরেট গভর্নেন্স ধরে রাখা গেলে আগামী ১০ বছরের মধ্যে আমরা দেশের শক্তিশালী ব্যাংকের তালিকায় নাম লিখাতে পারব। এজন্য আমরা ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংককে ১০ বছরের কর্মপরিকল্পনা দিয়েছি।
সৈয়দ মিজানুর রহমান: দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে কটেজ, মাইক্রো ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের অবদান অনস্বীকার্য। সার্বিক গুরুত্ব ও ঋণ ঝুঁকি বিবেচনায়, এবি ব্যাংক ছোট ছোট উদ্যোক্তাদেরকে অর্থায়নে বেশ উদ্যোগী ভূমিকায় রয়েছে। আমরা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে প্রচলিত নিয়মাচারের আলোকে ঋণদানে সচেষ্ট আছি। এছাড়া কৃষি ঋণ নিয়ে আমরা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছি।
আরও পড়ুন
লুটেরাদের কাছে ‘গরিবের বউ’ ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক!
লুটপাটে নিঃস্ব ব্যাংকের ‘মামার বাড়ির আবদার’
সৈয়দ মিজানুর রহমান: আমাদের মূল ভিত্তি থাকবে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও করপোরেট গভর্নেন্স। আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিতে খেলাপি ঋণসংক্রান্ত সংস্কার, নতুন আমানত পণ্য, গ্রামীণ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ব্যাংকিং সেবা পৌঁছানো, ডিজিটাল প্রযুক্তি ও সেবা উদ্ভাবনেই জোর দেওয়া হবে। যদি এই সব ধাপ ঠিকমতো অনুসরণ করি, আগামী ১০ বছরের মধ্যে আমরা দেশের শক্তিশালী ব্যাংকগুলোর মধ্যে স্থান করে নিতে পারব।
সৈয়দ মিজানুর রহমান: প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো বিনিয়োগে স্থবিরতা, ডিজিটাল নিরাপত্তা, নন-পারফর্মিং লোন এবং আন্তর্জাতিক নিয়ম-নীতি ও মান রক্ষা। এছাড়া ফিনটেক ও মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের প্রতিযোগিতা, কাস্টমার এক্সপেরিয়েন্স উন্নয়ন এবং দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করা বড় চ্যালেঞ্জ। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারলে দ্রুতই ব্যাংক খাত ঘুরে দাঁড়াবে। বর্তমান গভর্নর এ বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। এখন সব ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো সহযোগিতা করলেই ব্যাংক খাত শক্তিশালী হবে। এর ওপর ভর করেই দেশের অর্থনীতিও ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হবে।
টিএই/জেবি