মো. আব্দুস সবুর (লোটাস)
২০ জুলাই ২০২৫, ০৯:৩১ পিএম
গত বছরের ডিসেম্বরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদরাসা বিভাগের সচিবের দায়িত্ব পান ড. খ ম কবিরুল ইসলাম। মাত্র আট মাসে তিনি নানামুখী কর্মকাণ্ডে এই মন্ত্রণালয়কে আলোচনায় নিয়ে এসেছেন। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষাকে আধুনিকায়নে তিনি বিশেষভাবে জোর দিচ্ছেন। কারিগরি শিক্ষার্থীরা ছয় দফা দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুললেও সচিবের বিভিন্ন পদক্ষেপ এবং আন্তরিকতায় তারা পড়ার টেবিলে ফিরে গেছেন। কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষার বিভিন্ন পরিবর্তন ও আগামী দিনের সম্ভাবনার বিষয়ে ঢাকা মেইলের মুখোমুখি হয়েছেন এই শিক্ষাবিদ ও চৌকস আমলা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ঢাকা মেইলের নিজস্ব প্রতিবেদক আব্দুস সবুর লোটাস।
ঢাকা মেইল: আমরা কয়েক দিন আগে দেখেছি ডিপ্লোমা শিক্ষার্থীরা দেশজুড়ে আন্দোলনে নামেন। তাদের পড়ার টেবিলে ফিরিয়ে নেওয়ার পেছনে আপনার ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি। এটা কীভাবে সম্ভব হলো?
কবিরুল ইসলাম: শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের আগ থেকেই তাদের জন্য আমরা বিভিন্ন কাজ শুরু করেছিলাম। আন্দোলনের এক পর্যায়ে তাদের দাবিগুলো বাস্তবায়নের কমিটি গঠন করে দেয়েছিলাম। তারপর কমিটির অগ্রগতি ও তাদের জন্য আমাদের পরিকল্পনা জানিয়ে দিই। আমাদের পরিকল্পনার কথা তারা হয়ত বিশ্বাস করেই ক্লাস-পরীক্ষার দিকে ফিরে গেছে। বর্তমানে দেশের সব পলিটেকনিকে সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে শিক্ষা কার্যক্রম চলছে।
ঢাকা মেইল: শিক্ষার্থীদের দাবি-দাওয়া পূরণে মন্ত্রাণালয়ের ভূমিকা ছিল। এখন সেটি কোন পর্যায়ে?
কবিরুল ইসলাম: বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার শুরু থেকেই কারিগরি শিক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে আসছে। কিছুদিন আগেই এই খাতের তিনটি বড় প্রকল্প একনেকে অনুমোদন হয়েছে। এছাড়া শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে বড় দাবি ছিল ক্রাফ্ট ইন্সট্রাক্টরদের পদোন্নতির বিষয়। এটার বিধিমালা সংশোধনের কাজ আন্দোলনের আগে থেকেই আমরা শুরু করেছিলাম। এটা বর্তমানে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে রয়েছে। সেখানে তারা পর্যালোচনা করেই অনুমোদন দেবে। ক্রাফ্ট ইন্সট্রাক্টরদের পদ ১১তম গ্রেড পর্যন্ত রাখা হয়েছে। আর ডিপ্লোমার শিক্ষার্থীরা পাবে ১০মত গ্রেড। অন্যদিকে আদালতের রায় ছিল তাদের প্রমোশনের একটা বিষয় রাখতে হবে, ফলে তারা ১৩তম গ্রেড থেকে ১১তম গ্রেডে আসবে পদোন্নতি পেয়ে। আর নিয়োগের ক্ষেত্রে সরাসরি ১৩তম গ্রেডে নয়, ১৬তম গ্রেডে নেওয়া হবে। তাদের নামও পরিবর্তন হবে। তাদের পদবী হবে জুনিয়র ল্যাব সহকারী, ল্যাব সহকারী ও সিনিয়র ল্যাব সহকারী।
ঢাকা মেইল: কারিগরি শিক্ষা জাতীয় উন্নয়নের জন্য খুবই অপরিহার্য। চীনসহ উন্নত দেশগুলো কারিগরি শিক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে উন্নত দেশে পরিণত হয়েছে। আমাদের দেশ পিছিয়ে আছে। এর কারণ কী?
কবিরুল ইসলাম: আমাদের কারিগরি শিক্ষায় বড় সমস্যা হলো কারিকুলাম। এছাড়া আমাদের দেশের ইন্ডাস্ট্রি ও শিক্ষায় সেভাবে সমন্বয় ঘটেনি। শিল্প ইন্ডাস্ট্রিতে যেসব স্কিল প্রয়োজন সেগুলো কারিগরি শিক্ষায় আপডেট করা হয়নি। আমাদের শিক্ষায় প্রশিক্ষণেরও ভালো ব্যবস্থা নেই। ডিপ্লোমায় যেসব শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে তাদের শেষ সেমিস্টারে একটা ইন্টার্নশিপের ব্যবস্থা থাকার কথা, সেটা খুব কার্যকরীভাবে হয়নি। আমি দায়িত্বে আসার পর থেকে ইন্ডাস্ট্রির প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেছি। আমাদের ঘাটতিগুলো জানার চেষ্টা করেছি। সেসব অনুসারে আমরা কারিগরি শিক্ষা আপডেটে কাজ করছি। সারাদেশে আমাদের মাত্র দুটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে। এখন আমরা আরও দুটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনের ব্যাপারে কাজ করছি। যন্ত্রপাতিসহ সবকিছুর আধুনিকায়নের ব্যাপারে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।
ঢাকা মেইল: বর্তমান সরকার উপজেলা পর্যায়ে একটি করে ভোকেশনাল ইনস্টিটিউট স্থাপনের পরিকল্পনা করেছে। কবে নাগাদ এটি বাস্তবায়ন হবে?
কবিরুল ইসলাম: হ্যাঁ, এই প্রজেক্টের কাজ চলমান। কারিগরি শিক্ষার বিস্তারে উপজেলা পর্যায়ে ৩২৯টি টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ স্থাপনে ১৫৪টি উপজেলায় ভূমি নির্বাচন করা হয়েছে। এছাড়া ৪৫টি টিএসসি স্থাপনের লক্ষ্যে ভূমি অধিগ্রহণের প্রশাসনিক আদেশ জারি করা হয়েছে।
ঢাকা মেইল: কারিগরি শিক্ষায় কী কী ধরনের পরিবর্তন আনার চিন্তা-ভাবনা করছে সরকার?
কবিরুল ইসলাম: সরকার কারিগরি শিক্ষাকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে বিভিন্ন প্রজেক্টের অনুমোদন দিয়েছে। আমরা কারিগরি শিক্ষাকে বিশ্বমানের করার জন্য সব ধরনের কাজ করছি। সিলেবাস ও প্রশিক্ষণ আপডেটের ব্যাপারে কাজ করছি। এছাড়া আমরা গাজীপুরে একটি মডেল পলিটেকনিক স্থাপনের প্রজেক্ট হাতে নিয়েছি। এখানে কারিগরির শিক্ষাক-শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এই পলিটেকনিকের সব কিছু সিঙ্গাপুরের ন্যানিয়াং পলিটেকনিকের মতো হবে।
ঢাকা মেইল: বাংলাদেশে মাদরাসা শিক্ষার প্রধান সংকট কী? মাদরাসা শিক্ষার্থীদের নেতিবাচকভাবে উপস্থাপনের একটি মানসিকতা বিগত দিনগুলোতে লক্ষণীয় ছিল। এর কতটুকু পরিবর্তন হয়েছে।
কবিরুল ইসলাম: আগের সরকারের আমলে মাদরাসা শিক্ষা সবচেয়ে অবহেলিত ছিল। মাদরাসা শিক্ষার ভিত্তি হলো ইবতেদায়ি পর্যায়। যারা আমাদের দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মতোই সবকিছু একই পড়াশোনা করায়। অতিরিক্ত কিছু আরবি বিষয় পড়ায়। কিন্তু তাদের সবচেয়ে অবহেলার চোখে দেখা হয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারি করা হলেও ইবতেদায়ি মাদরাসাগুলো এমপিওভুক্তি কাজ করা হয়নি। আমরা ইবতেদায়ি মাদরাসা এমপিওভুক্ত করার নীতিমালা করেছি। তারা আবেদন করতে পারবে।
ঢাকা মেইল: বর্তমান সরকার মাদরাসা শিক্ষার উন্নয়নে কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে?
কবিরুল ইসলাম: দেশের মাদরাসা শিক্ষার উন্নয়ন সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। যার মধ্যে প্রতিষ্ঠার পর থেকে তিন হাজার মাদরাসা কোনো একাডেমিক ভবন পায়নি, তাদের জন্য একাডেমিক ভবন নির্মাণের একটা বড় প্রোজেক্ট হাতে নিয়েছি। এছাড়া আরও কিছু মাদরাসার জন্য ভবন নির্মাণ ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণের ব্যাপারে আমরা কাজ করছি।
ঢাকা মেইল: দেশের কওমি মাদরাসাগুলো মূলধারায় যুক্ত করার কোনো পরিকল্পনা আছে কি?
কবিরুল ইসলাম: কওমি মাদরাসা নিয়ে কাজ করা খুবই জটিল৷ তারা সরকারের অধীনে আসতে চায় না। তাদের সঙ্গেও আলোচনা করেছি। তারা যদি শিক্ষার্থীদের আরও বেশি কারিগরি জ্ঞান দেওয়ার ব্যাপারে সম্মত হয় তাহলে আমরা সেটি নিয়ে কাজ করব৷ এতে তাদের কর্মসংস্থানের সমস্যাটা অনেকটাই দূর হবে।
ঢাকা মেইল: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
কবিরুল ইসলাম: স্বাগতম, আপনাকেও ধন্যবাদ।
এএসএল/জেবি