আন্তর্জাতিক ডেস্ক
১২ জুন ২০২৩, ০২:৫১ পিএম
মুসলিম বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী দেশ তুরস্ক। কৌশলগত অবস্থানের কারণে বরাবরই বিশ্বের আকর্ষণের কেন্দ্রে থাকে দেশটি। বর্তমান প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ক্ষমতায় রয়েছেন দুই দশকের বেশি সময় ধরে। আবারও তিনি ক্ষমতায় এসেছেন। তুরস্ককে অটোমান সম্রাজ্যের আভিজাত্যে ফিরিয়ে নিতে চান তিনি। চলুন তুরস্ক সম্পর্কে সাধারণ কিছু প্রশ্নের উত্তর জেনে আসি।
তুরস্ক পশ্চিম এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের একটি রাষ্ট্র। তুরস্কের প্রায় পুরোটাই এশীয় অংশে, পর্বতময় আনাতোলিয়া বা এশিয়া মাইনর উপদ্বীপে পড়েছে। তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারা আনাতোলিয়াতেই অবস্থিত। তুরস্কের বাকি অংশের নাম পূর্ব বা তুর্কীয় থ্রাস এবং এটি ইউরোপের দক্ষিণ-পূর্ব কোনায় অবস্থিত। এই অঞ্চলটি উর্বর উঁচু-নিচু টিলাপাহাড় নিয়ে গঠিত। এখানে তুরস্কের বৃহত্তম শহর ইস্তাম্বুল অবস্থিত।
সামরিক কৌশলগত দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তিনটি জলপথ এশীয় ও ইউরোপীয় তুরস্ককে পৃথক করেছে মার্মারা সাগর এবং বসফরাস প্রণালী ও দার্দানেলেস প্রণালী। এই তিনটি জলপথ একত্রে কৃষ্ণ সাগর থেকে এজিয়ান সাগরে যাবার একমাত্র পথ তৈরি করেছে।
তুরস্কের আয়তন ৭ লাখ ৮৩ হাজার ৫৬২ বর্গ কিলোমিটার। প্রশাসনিক সুবিধার্থে তুরস্ককে ৮১টি প্রদেশে বিভক্ত করা হয়েছে। সব বিভাগ আবার সাতটি অঞ্চলে বিভক্ত। তবে এই সাতটি অঞ্চল কোনো প্রশাসনিক বিভাজন নয়। প্রতিটি প্রদেশ কয়েকটি করে জেলায় বিভক্ত। তুরস্কে মোট জেলা আছে ৯২৩টি। প্রতিটি প্রদেশের নামই সেই প্রদেশের রাজধানীর নাম। আর প্রতিটি প্রাদেশিক রাজধানী সংশ্লিষ্ট প্রদেশের কেন্দ্রীয় জেলা। সবচেয়ে বড় শহর ইস্তাম্বুল। এটি হচ্ছে তুরস্কের বাণিজ্যিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রবিন্দু।
আরও পড়ুন: তুর্কি বায়রাক্টার ড্রোন কতটা শক্তিশালী, দাম কত?
বহু শতাব্দী ধরে তুরস্ক ছিল মূলত কৃষিপ্রধান একটি দেশ। বর্তমানে কৃষিখামার তুরস্কের অর্থনীতির একটি বড় অংশ এবং দেশের শ্রমশক্তির ৩৪% এই কাজে নিয়োজিত। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে তুরস্কতে শিল্প ও সেবাখাতের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। বিশেষত অর্থসংস্থান, পরিবহন, এবং পেশাদারী ও সরকারি সেবায়। অন্যদিকে কৃষির ভূমিকা হ্রাস পেয়েছে। টেক্সটাইল ও বস্ত্রশিল্প দেশের রফতানির প্রধান উৎস। দেশটির অর্থনীতি কয়েক বছর ধরে দোলাচলে রয়েছে। ধীরে ধীরে এর উন্নতি ঘটছে।
অর্থনৈতিক রূপান্তরের সঙ্গে সঙ্গে নগরায়নের হারও অনেক বেড়েছে। বর্তমানে তুরস্কের ৭৫% জনগণ শহরে বাস করে। ১৯৫০ সালেও মাত্র ২১% শহরে বাস করত। জনসংখ্যার ৯০% তুরস্কের এশীয় অংশে বাস করে। বাকি ১০% ইউরোপীয় অংশে বাস করে।
তুরস্কের ইতিহাস
তুরস্কের ইতিহাস দীর্ঘ ও ঘটনাবহুল। প্রাচীনকাল থেকে বহু বিচিত্র জাতি ও সংস্কৃতির লোক এলাকাটি দখল করেছে। ১৯০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে এখানে হিটাইটদের বাস ছিল। তাদের সময়েই এখানে প্রথম বড় শহর গড়ে ওঠে। এরপর এখানে ফ্রিজীয়, গ্রিক, পারসিক, রোমান এবং আরবদের আগমন ঘটে। মধ্য এশিয়ার যাযাবর তুর্কি জাতির লোকেরা ১১শ শতকে দেশটি দখল করে এবং এখানে সেলজুক রাজবংশের পত্তন করে। তাদের শাসনের মাধ্যমেই এই অঞ্চলের জনগণ তুর্কি ভাষা ও সংস্কৃতির সাথে মিশে যায়।
১৩শ শতকে মোঙ্গলদের আক্রমণে সেলজুক রাজবংশের পতন ঘটে। ১৩ শতকের শেষ দিকে এখানে উসমানীয় সাম্রাজ্যের পত্তন হয়। এরা পরবর্তী ৬০০ বছর তুরস্ক শাসন করে এবং আনাতোলিয়া ছাড়িয়ে মধ্যপ্রাচ্য, পূর্ব ইউরোপ এবং উত্তর আফ্রিকার এক বিশাল এলাকা জুড়ে বিস্তৃতি লাভ করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর সাম্রাজ্যটির পতন ঘটে।
১৯২৩ সালে উসমানীয় সাম্রাজ্যের তুর্কি ভাষী এলাকা আনাতোলিয়া ও পূর্ব থ্রাস নিয়ে মুস্তাফা কামাল (পরবর্তীতে কামাল আতাতুর্ক)-এর নেতৃত্বে আধুনিক তুরস্ক প্রজাতন্ত্রের তথা তুর্কি জাতিরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয়। ১৯৩৮ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আতাতুর্ক তুরস্কের রাষ্ট্রপতি ছিলেন। তিনি একটি শক্তিশালী, আধুনিক ইউরোপীয় রাষ্ট্র হিসেবে তুরস্কের পরিচয় প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। তার সরকারের মূলনীতিগুলো কেমালবাদ নামে পরিচিত এবং এগুলো পরবর্তী সমস্ত তুরস্ক সরকারের জন্য নির্দেশিকা হিসেবে কাজ করেছে।
আতাতুর্কের একটি বিতর্কিত মূলনীতি ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। কামালের কট্টর অনুসারীরা মনে করেন ব্যক্তিগত জীবনের বাইরে ধর্মের স্থান নেই এবং রাজনৈতিক দলগুলির ধর্মীয় ইস্যু এড়িয়ে চলা উচিত। ১৯৫০ এর দশক থেকে রাজনীতিতে ধর্মের ভূমিকা তুরস্কের একটি বিতর্কিত ইস্যু। তুরস্কের সামরিক বাহিনী নিজেদেরকে কেমালবাদের রক্ষী বলে মনে করে এবং তারা ১৯৬০, ১৯৭১, ১৯৮০ এবং ১৯৯৭ সালে মোট চারবার তুরস্কের রাজনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতার স্বার্থে হস্তক্ষেপ করেছে।
তুরস্কের রাজনীতি
তুরস্কের রাজনীতি একটি বহুদলীয় রাষ্ট্রপতি-শাসিত গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র কাঠামোয় সংঘটিত হয়। রাষ্ট্রের নির্বাহী ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের উপর ন্যস্ত। আইন প্রণয়নের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির উপর ন্যাস্ত। তুরস্কে ৫৫০ আসনের একটি সংসদ আছে, যার সদস্যরা ৫ বছরের জন্য জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হন। ২০১৭ সালের গণভোটের পর থেকে রাষ্ট্রপতিও জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হচ্ছেন। রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান দেশটির বর্তমান প্রেসিডেন্ট এবং ফুয়াত ওকতায় দেশটির বর্তমান উপ-রাষ্ট্রপতি। তুরস্কের সংবিধানের সর্বশেষ সংশোধনে ধর্মনিরপেক্ষতাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
তুরস্কের অর্থনীতি
১৯২৩ সালে তুরস্ক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর দেশটিতে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। পরবর্তী ছয় দশকব্যাপী অর্থাৎ ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত উন্নয়ন প্রচেষ্টা একই ধারাবাহিকতায় চলতে থাকে। এরপর অধিকতর উন্নয়নের জন্য ১৯৮৩ সালে সংস্কার কর্মসূচি হাতে নেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তুরগুত ওজাল। তিনি বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করেন এবং বাজার অর্থনীতির প্রসার ঘটান।
এই সংস্কারের ফলে প্রবৃদ্ধি বাড়তে থাকে। কিন্তু অর্থনৈতিক মন্দার কারণে ১৯৯৪ সালে এই প্রবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য হারে কমে যায়। ১৯৯৯ সালে ভয়াবহ ভূমিকম্পের ফলে অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধাক্কা লাগে। এসব সমস্যার কারণে ১৯৮১ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত গড় প্রবৃদ্ধির হার ছিল মাত্র ৪ শতাংশ। ২০০১ সালের সৃষ্ট অর্থনৈতিক সমস্যার পর নতুন করে সংস্কার কর্মসূচি শুরু করেন অর্থমন্ত্রী কামাল দারবিশ। তার সংস্কারের ফলে মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্ব অনেক কমে যায়। তুরস্ক তার বাজার ধীরে ধীরে মুক্ত করতে শুরু করে। ২০০২ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত প্রবৃদ্ধির হার ছিল গড়ে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। ২০০৮ সালে দেশটির প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৫ দশমিক ৪ শতাংশ।
২০০৯ সালে বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার ধাক্কা তুরস্কেও লাগে। দেশটির অর্থমন্ত্রী জানান, এ বছর ঘাটতি বাজেটের পরিমাণ হচ্ছে ২৩ দশমিক ২ বিলিয়ন তুর্কি লিরা। ২০০৭ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী তুরস্কে মোট জাতীয় আয়ের ৮ দশমিক ৯ শতাংশ আসে কৃষি থেকে, ৩০ দশমিক ৮ শতাংশ আসে শিল্পখাত থেকে এবং ৫৯ দশমিক ৩ শতাংশ আসে সেবাখাত থেকে।
তুরস্কের পর্যটন শিল্প দেশটির অর্থনীতিতে বড় ধরনের অবদান রেখে চলছে। ২০০৮ সালে দেশটিতে পর্যটকের সংখ্যা ছিল তিন কোটি ৯ লাখ ২৯ হাজার ১৯২ জন। যাদের কাছ থেকে কর আদায় হয় দুই হাজার ১৯০ কোটি ডলার। এছাড়া তুর্কি অর্থনীতির অন্যান্য খাতের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ব্যাংকিং খাত, নির্মাণ খাত, গার্মেন্টস, বিদ্যুৎ, তেল, পরিশোধন, খাদ্য, লোহা, স্টিল, অটোমোটিভ ইত্যাদি।
২০১২ সালের হিসাব অনুযায়ী অটোমোটিভ তৈরির দিক থেকে তুরস্কের অবস্থান বিশ্বে ১৭তম। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মুদ্রাস্ফীতি ব্যাপকভাবে কমে এসেছে। ১৯৯৫ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে এক চুক্তি করে তুরস্ক। ২০০৭ সালে বিদেশি বিনিয়োগ থেকে তুরস্কের আয় হয় দুই হাজার ১৯০ কোটি ডলার।
আরও পড়ুন: অপছন্দের হলেও যেসব কারণে পশ্চিমাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র এরদোয়ান
তবে বেশ কয়েকবছর ধরে দেশটি অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলা করছে। এরদোয়ান এই অবস্থার কিছুটা উন্নতি ঘটাতে পারলেও সাম্প্রতিক ভয়াবহ ভূমিকম্পের কারণে ফের বিপাকে পড়েছেন। তৃতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। তুর্কিদের আশা আগামী ৫ বছরে অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে পারবেন এরদোয়ান।
অর্থনৈতিক উপাত্ত নিয়ে কাজ করা ওয়েবসাইট সিইআইসি ডাটা জানিয়েছে, ২০২৩ সালের এপ্রিল পর্যন্ত তুরস্কের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এটি কয়েকমাস আগের চেয়ে দুই বিলিয়ন ডলার কম।
তুরস্কের পররাষ্ট্র ও দেশরক্ষা নীতি
জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য তুরস্ক।এ ছাড়া ওইসিডি, ওআইসি, ওএসসিই, ইসিও, বিএসইসি, ডি৮, জি-২০ ইত্যাদি সংগঠনের সদস্য তুরস্ক। ২০০৮ সালের ১৭ অক্টোবর তুরস্ক ১৫১টি দেশের সমর্থন পেয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য নির্বাচিত হয়। তার এ সদস্যপদ ২০০৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হয়। এর আগেও তুরস্ক জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য ছিল ১৯৫১-১৯৫২, ১৯৫৪-১৯৫৫ এবং ১৯৬১ সালে।
পশ্চিমাদের সাথে সম্পর্ক, বিশেষ করে ইউরোপের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখাই তুরস্কের পররাষ্ট্রনীতির মূল কাজ। কাউন্সিল অব ইউরোপের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য তুরস্ক। দেশটি ১৯৫৯ সালে ইইসির সদস্য হওয়ার জন্য আবেদন করে এবং ১৯৬৩ সালে দেশটি সংস্থাটির সহযোগী সদস্যের মর্যাদা পায়। ১৯৮৭ সালে তুরস্ক ইইসির পূর্ণ সদস্যপদ পাওয়ার জন্য আবেদন করে। ১৯৯২ সালে ওয়েস্টার্ন ইউরোপীয় ইউনিয়ন এর সহযোগী সদস্যপদ লাভ করে। দেশটি ইইউর পূর্ণ সদস্যপদ লাভের জন্য ১৯৯৫ সালে একটি চুক্তি করে। এ চুক্তি অনুসারে ২০০৫ সালের ৩ অক্টোবর সমঝোতা শুরু হয়। তবে সে সমঝোতা এখনো শেষ হয়নি। ধারণা করা হচ্ছে গ্রিক-সাইপ্রাসকে কেন্দ্র করে ইউরোপের অন্যান্য দেশের সাথে তুরস্কের যে বিরোধ তা শেষ না হওয়া পর্যন্ত সমঝোতা চলতেই থাকবে।
এ ছাড়া তুর্কি পররাষ্ট্রনীতির আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক। এখানে উভয় দেশেরই অভিন্ন স্বার্থ রয়েছে। আর তা হলো সোভিয়েত আগ্রাসন মোকাবেলা। সে লক্ষ্যে তুরস্ক ১৯৫২ সালে ন্যাটোতে যোগ দেয়। এর মাধ্যমে দেশটি ওয়াশিংটনের সাথে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক গড়ে তোলে।
স্নায়ুযুদ্ধের পর তুরস্ক মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে। ইরাক ও সিরিয়া সীমান্তের কাছে তুরস্কে ন্যাটোর বিমান ঘাঁটি রয়েছে। ওআইসির সদস্য হওয়ার পরও ইসরাইলের সাথে তুরস্কের ভালো সম্পর্ক রয়েছে, তবে ক্ষমতাসীন জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির অধীনে সাম্প্রতিক সময়ে সেই সম্পর্ক স্থিতিশীল। ১৯৮০ সালের পর তুরস্ক পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলে। বিশেষ করে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে বড় ধরনের লেনদেনে জড়ায় দেশটি। আর এসব ক্ষেত্রেই যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল সমর্থন পেয়েছে তুরস্ক।
সামরিক শক্তি
গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ারের রিপোর্ট অনুযায়ী, সামরিক শক্তিতে তুরস্ক বর্তমানে বিশ্বের ১১তম রাষ্ট্র। সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী নিয়ে তুরস্কের প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠিত। জেন্ডারমেরি ও কোস্টগার্ডরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে কাজ করলেও যুদ্ধের সময় এরা যথাক্রমে সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীর কমান্ড অনুসরণ করে। এ সময় বাহিনী দু’টিতে নিজস্ব আইন কার্যকর থাকলেও এরা সামরিক কিছু নিয়মকানুন মেনে চলে।
ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে তুরস্কের প্রতিরক্ষা বাহিনী হচ্ছে দ্বিতীয় বৃহত্তম। একমাত্র যুক্তরাষ্ট্রেরই রয়েছে তুরস্কের চেয়ে বড় প্রতিরক্ষা শক্তি। তুরস্কে প্রতিরক্ষা বিভাগে মোট ১০ লাখ ৪৩ হাজার ৫৫০ জন সামরিক সদস্য রয়েছে। ন্যাটোভুক্ত যে পাঁচটি দেশ যৌথ পরমাণু কর্মসূচি গ্রহণ করেছে তুরস্ক তার অন্যতম সদস্য। বাকি দেশগুলো হলো বেলজিয়াম, জার্মানি, ইতালি ও নেদারল্যান্ডস। প্রতিরক্ষা বিভাগকে আধুনিকীকরণের লক্ষ্যে ১৯৯৮ সালে তুরস্ক ১৬ হাজার কোটি ডলারের কর্মসূচি গ্রহণ করে।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মিশনে তুর্কি বাহিনী কাজ করছে। জাতিসংঘ ও ন্যাটোর অধীনেই তারা বিভিন্ন মিশনে অংশ নিচ্ছে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর অধীনে তুর্কি বাহিনীর সদস্যরা বর্তমানে সোমালিয়ায় কাজ করছে। এছাড়া সাবেক যুগোস্লাভিয়ায় শান্তি মিশনে ও প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধে যৌথ বাহিনীর সাথে সহায়তা করেছে।
বর্তমানে তুর্কি স্বীকৃত সাইপ্রাসে ৩৬ হাজার তুর্কি সেনা দায়িত্ব পালন করছে এবং ন্যাটো নেতৃত্বাধীন বাহিনীর সাথে ২০০১ সাল থেকে আফগানিস্তানেও দায়িত্ব পালন করছে তুর্কি সেনারা। ইসরায়েল-লেবানন সঙ্ঘাত এড়াতে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের আওতায় ২০০৬ সালে সংশ্লিষ্ট এলাকায় তুরস্ক কয়েকটি যুদ্ধজাহাজ ও ৭০০ সৈন্য মোতায়েন করে।
দেশটির সেনাপ্রধানকে নিয়োগ দেন প্রেসিডেন্ট। ২০১৮ সালের সংবিধান সংশোধনীর পর থেকে জাতীয় নিরাপত্তার ব্যাপারে দেশটির প্রেসিডেন্ট পার্লামেন্টের কাছে দায়বদ্ধ নন। কোনো যুদ্ধ ঘোষণা, বিদেশে সৈন্য প্রেরণ কিংবা দেশের ভেতরে বিদেশী সৈন্যদের ঘাঁটি স্থাপন প্রত্যেকটি বিষয়েই প্রেসিডেন্টের অনুমোদন লাগে।
আরও পড়ুন: শরবত বিক্রেতা থেকে যেভাবে তুর্কির মসনদে এরদোয়ান
তুরস্কের বিমানবাহিনী তার প্রয়োজনের তুলনায় ক্ষুদ্র। বেশ কিছু ক্ষেত্রে মার্কিন নীতির বিরোধিতা করলেও দেশের বিমান বাহিনী মূলত ৯০টি একক আসনের একক ইঞ্জিনের মার্কিন এফ-১৬সি যুদ্ধ বিমানে সজ্জিত।
জনসংখ্যা
তুরস্কের জনসংখ্যা প্রায় ৭ কোটি ১৫ লাখ। দেশটির জন্মহার গড়ে ১ দশমিক ৩১। প্রতি বর্গকিলোমিটারে জনসংখ্যা ৯২ জন। এর মধ্যে শহরে বসবাস করে ৭০.৫ জন।
শিক্ষা
৬ থেকে ১৫ বছর বয়সী শিশুদের জন্য শিক্ষা বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক। শিক্ষার হার পুরুষের ৯৫ দশমিক ৩ শতাংশ ও নারীদের ৭৯ দশমিক ৬ শতাংশ। গড় শিক্ষার হার ৮৭ দশমিক ৪ শতাংশ। তুর্কি সংবিধানের ৬৬ নম্বর আর্টিক্যাল অনুসারে, তুরস্কের নাগরিকত্ব যাদের আছে তারাই তুর্কি বলে পরিচিত।
ভাষা
তুর্কি ভাষা তুরস্কের সরকারি ভাষা। এখানকার প্রায় ৯০% লোক তুর্কি ভাষাতে কথা বলেন। এছাড়াও আরও প্রায় ৩০টি ভাষা প্রচলিত। এদের মধ্যে আদিগে, আরবি, আর্মেনীয়, আজারবাইজানি, জর্জীয়, কুর্দি এবং রোমানি উল্লেখযোগ্য। আন্তর্জাতিক কর্মকাণ্ডে ইংরেজি ব্যবহার করা হয়।
ধর্ম
বর্তমানকালে তুরস্ক একটি সাংবিধানিক ধর্মনিরপেক্ষ দেশ যার কোনো রাষ্ট্রধর্ম নেই এবং সংবিধানে এর প্রতিটি নাগরিকের ধর্মীয় স্বাধীনতার নিশ্চয়তায় গুরুত্তারোপ করা হয়েছে। তবে পরিসংখ্যান অনুযায়ী, তুরস্কের ৯৬.৫ শতাংশ লোক ইসলাম ধর্মাবলম্বী। এছাড়া ০.৩ শতাংশ খ্রিস্টান ও ৩.২ শতাংশ অন্যান্য ধর্মাবলম্বী।
তুুুরস্ক-বাংলাদেশ সম্পর্ক
বাঙালি মুসলমানসহ দক্ষিণ এশিয়ার সকল মুসলিমগণ তুরস্কের স্বাধীনতা যুদ্ধে সমর্থন দিয়েছিল। বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৯২১ সালে তার রচিত 'কামাল পাশা' নামক কবিতায় কামাল আতাতুর্কের প্রতি সম্মান ও প্রশংসা জ্ঞাপন করেন। পাশাপাশি ঢাকা ও চট্টগ্রামের দুটি স্থানকে কামাল আতাতুর্ক এভিনিউ নামে নামকরণ করা হয়। উপরন্তু ফেনীতে আতাতুর্ক মডেল উচ্চ বিদ্যালয় এবং ঢাকায় মুস্তফা কামাল তুর্কি ভাষা কেন্দ্র নামে একটি ভাষা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরকে হজরত শাহজালালের নামানুসারে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হিসেবে নামকরণ করা হয়, যিনি নিজেও একজন তুর্কি এবং তুর্কি সুফি পণ্ডিত জালালুদ্দিন রুমির শিষ্য ছিলেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত ওআইসির সম্মেলনে তুরস্ক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। ১৯৭৬ সালে ঢাকায় তুরস্কের দূতাবাস এবং ১৯৮১ সালে আঙ্কারায় বাংলাদেশের দূতাবাস প্রতিষ্ঠিত হয়।
সূত্র: বিবিসি, সিইআইসি, এপি, আনাদুলু ও উইকিপিডিয়া
একে
তুরস্ক কিসের জন্য বিখ্যাত, তুরস্ক নির্বাচন, তুরস্ক মানচিত্র, তুরস্কের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা, তুরস্কের বর্তমান প্রেসিডেন্টের নাম কি, তুরস্কের বর্তমান অবস্থা, তুরস্ক কোন মহাদেশে অবস্থিত, তুরস্ক ভূমিকম্প, তুরস্কের স্বাধীনতার ইতিহাস, তুরস্কের আয়তন কত।