images

আন্তর্জাতিক

ফিলিস্তিনিদের ফসল, জমি চুরি করছে ইসরায়েলিরা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

২৭ নভেম্বর ২০২৩, ০৪:২৯ পিএম

অধিকৃত পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনি কৃষকরা ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের কাছ থেকে প্রায় প্রতিদিনই অনুপ্রবেশ এবং সহিংসতার মুখোমুখি হচ্ছে। প্রতিনিয়ত তারা তাদের বাড়ি এবং জমি চুরি হওয়ার ভয় নিয়ে বাস করছে। ইসরায়েলি বন্দুক নিয়ে এসে জোর করে ফিলিস্তিনিদের ফসল নিয়ে যায়, দখল করে জমি। এমন ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলেছে।

পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিদের এই সংকটের মধ্যে নতুন করে যোগ হয়েছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর হামলা। গত এক সপ্তাহে সেখানে ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় ১০ জন নিহত এবং ২০ জন আহত হয়েছে।

আরও পড়ুন: এক টেবিলে আরব ও মুসলিম বিশ্ব, কী পেল ফিলিস্তিনিরা?

ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ৭ অক্টোবর থেকে হামাসের সঙ্গে ইসরায়েলের যুদ্ধ শুরুর পর অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে কমপক্ষে ২৩৭ ফিলিস্তিনি নিহত এবং প্রায় ২,৮৫০ জন আহত হয়েছে।

কৃষক আয়মান আসাদ (৪৫) এবং তার পরিবার তাদের বাড়ি থেকে মাত্র ২ কিমি দূরে স্পষ্টভাবে হামলার শব্দ শুনতে পাচ্ছেন। এটি তার স্ত্রী এবং পাঁচ সন্তানের জন্য একটি দুঃস্বপ্ন। তিনি বলেন, ‘শিশুরা ক্রমাগত ভয় পায় এবং তারা বাইরে খেলতে পারে না। এটি খুব বিপজ্জনক।’

আসাদ বলেন, ‘আমরা শরণার্থী শিবিরে হামলা, বিস্ফোরণ এবং গুলির শব্দ শুনতে পাচ্ছি। ছেলেমেয়েরা আর স্কুলে যাচ্ছে না, কারণ তারা যেতে চাইলেও পথ বন্ধ করে দিয়েছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। সব ক্লাস অনলাইন হয়ে গেছে। এই মুহুর্তে সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হলো তার মুরগির খামার। সেখানে ইসরায়েলি বসতিস্থাপনকারীরা আক্রমণ করবে। আমি ভীত যে আমার জমি চুরি হয়ে যাবে।’

ফিলিস্তিনের কৃষকরা জলপাই, জলপাই তেল এবং প্রচুর পরিমাণে শাকসবজি উৎপাদন করে। এটি অনেক দূরে রফতানি হয়। জলপাই গাছ ফিলিস্তিনের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক। পশ্চিম তীর ১৯৬৭ সাল থেকে ইসরায়েলের দখলে রয়েছে। তখন থেকে প্রায় ৭ লাখ ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারী ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে অবৈধভাবে বসতি স্থাপন করেছে। বছরের পর বছর ধরে তারা সেখানকার ফিলিস্তিনি কৃষকদের জলপাই গাছ, কৃষিজমি এবং সম্পত্তি চুরি, আক্রমণ এবং ধ্বংস করে চলেছে।

তবে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ইসরায়েলের অবৈধ বসতিস্থাপনকারীদের এই অনুপ্রবেশ এবং ছিনতাইয়ের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। ইসরায়েলের কারফিউয়ের কারণে ফিলিস্তিনিরা ঘরে বন্দী হয়ে পড়েছে। এই সুযোগে ইসরায়েলি বাহিনী এবং বসতি স্থাপনকারীরা সশস্ত্র অভিযান চালাচ্ছে। তারা ফিলিস্তিনিদের সম্পক চুরির উৎসবে মেতেছে।

রামাল্লার ফিলিস্তিনি কৃষক ইউনিয়নেরর পরিচালক আব্বাস মিলহেম বলেন, ইসরায়েলিরা ফিলিস্তিনের সম্পদকে টার্গেট করছে। ছিনতাই হওয়া সম্পদের মধ্যে আমার পরিবারের খামারও ছিল।

west_bank_palestine
পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের একটি জলপাই বাগান। ছবি: আল জাজিরা

‘পশ্চিম তীরে চলছে দ্বিতীয় যুদ্ধ’
মাত্র দুই সপ্তাহ আগে সশস্ত্র ইসরায়েলি বসতিস্থাপনকারীরা মিলহেমের খামারে আক্রমণ করেছিল। ফসল কাটাতে কাজ করা লোকদের দিকে গুলি ছুড়েছিল এবং জলপাই চুরি করেছিল।

খামারের একজন শ্রমিক ইমান আবদুল্লাহ জাবরি (৪৫) ওই খামারে স্বামীর সঙ্গে জলপাই তুলছিলেন। সেই সময় ইসরায়েলিরা সেখানে আক্রমণ করে। তিনি বলেন, ‘তারা আমাদের দিকে এমনভাবে গুলি চালায় যেন তারা আমাদের ভয় দেখাতে চায়। তারপর যখন তারা কাছে আসে, তারা আমাদের ফোন কেড়ে নেয় যাতে আমরা ছবি তুলতে না পারি। তারপর তারা সব নারীকে চলে যেতে বলে এবং পুরুষদের মারতে শুরু করে। তাদের জলপাই গাছের নিচে মাটিতে বসতে বাধ্য করে।’

আরও পড়ুন: হামাসের যুদ্ধ কৌশল, অবাক বিশ্ব

তিনি বলেন, ‘আমরা (মহিলারা) তখনও দূর থেকে তাদের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। এরপর, তারা আমাদের সব জলপাই নিয়ে গেল এবং আমাদের চলে যেতে বাধ্য করল।’

পশ্চিম তীরের এলাকা বি-তে থাকা সত্ত্বেও খামারটি এখন ইসরায়েলের সামরিক নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, যেখানে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ প্রযুক্তিগতভাবে বেসামরিক বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণ করে। ওই খামারে মিলহেম ও তার কর্মীদের আর যেতে দেওয়া হয়নি।

ইমান বলেন, ‘কৃষকরা গুলি করলে ভয় পায়। আমার অনেক নাতি-নাতনি আছে এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে ভয়। এরপরও আমাদের যা আছে তার জন্য আমি ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাই এবং গাজার জনগণের জন্য প্রার্থনা করি।’

মিলহেম বলেন, ‘ফিলিস্তিনে দ্বিতীয় যুদ্ধ চলছে যা অধিকৃত পশ্চিম তীরে ঘটছে। এটি অধিকৃত পশ্চিম তীরে কৃষকদের কীভাবে প্রভাবিত করে তা বোঝাও গুরুত্বপূর্ণ।’

তিনি যোগ করেছেন যে, তিনি জেনিনে তার বৃদ্ধ মায়ের সাথে দেখা করতে যেতে পারবেন না কারণ ইসরায়েলি বাহিনী অনেক রাস্তা অবরুদ্ধ করে রেখেছে। আমার ছেলেরা যখন রাতে বাইরে যায় তখন আমিও ভয় পাই এবং তারা ঠিক আছে কিনা তা দেখার জন্য আমি তাদের ক্রমাগত ফোন করি।

‘তাদের বন্দুক আছে - আমার শুধু হাত’
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনী অধিকৃত পশ্চিম তীরে এই বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৬ অক্টোবরের মধ্যে আগের চেয়ে অনেক বেশি ফিলিস্তিনিদের হত্যা করেছে। এই সংখ্যা ২০০৫ সালে থেকে জাতিসংঘের প্রাণহানির রেকর্ড করা সর্বোচ্চ সংখ্যা। এটি ফিলিস্তিনিদের জীবন-জীবিকার ভয়ের পাশাপাশি তাদের নিরাপত্তা এবং তাদের পরিবারের নিরাপত্তার জন্য উদ্বেগ বাড়িয়েছে।

ইসরায়েলি বাহিনী এবং সশস্ত্র বসতি স্থাপনকারীদের ব্যাপকভাবে বেপরোয়া আচরণের কারণে পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিরা বন্দী হয়ে পড়েছে। তারা তাদের ফসল তুলতেও যেতে পারছে না। এমন অবস্থায় প্রায় প্রত্যেকে সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে।

 

 

জাতিসংঘের মতে, ৭ অক্টোবর থেকে ফিলিস্তিনে দারিদ্র্য ২০ শতাংশ বেড়েছে এবং মোট অভ্যন্তরীণ পণ্য ৪.২ শতাংশ কমেছে। মিলহেম বলেন, ফিলিস্তিনিদের চলাচলে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর নিষেধাজ্ঞার কারণে রফতানি সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে গেছে এবং প্রায় ৫০ শতাংশ জলপাই সংগ্রহ করা যায়নি।

আরেক ফিলিস্তিনি কৃষক সালাহ আওয়াদ (২৮) আগস্টে অধিকৃত পশ্চিম তীরের দক্ষিণে ওয়াদি তাহতায় তার বাড়ি এবং জমি হারিয়েছেন। বসতি স্থাপনকারীরা তার জমিতে আক্রমণ করেছিল, তার সম্পত্তির চারপাশে বেনজিন ঢেলে দেয় এবং আগুনে পুড়িয়ে দেয় ও তার মৌমাছি ধ্বংস করে। 

ইসরায়েলিরা তার জমি দখল করে নেয় এবং আওয়াদ তার আট সন্তানের পরিবার নিয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। তিনি বলেন, কয়েকদিন পর তিনি তার ১০০টি ভেড়া উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছেন, কিন্তু তিনি আর জমিতে ফিরতে পারবেন না।

শাব তারিকে এ আওয়াদের নতুন বাড়িতে অবস্থার অবনতি হয়েছে। তাকে ভেড়া চরাতেও দেওয়া হয় না। তিনি বলেন, ‘ইসরায়েলি বসতিস্থাপনকারীরা আমাদের বাড়ি ঘিরে রেখেছে। তারা আমাকে কাজ করতে দিচ্ছে না। আমি ভয় পাচ্ছি যে আমাকে গুলি করা হতে পারে, কারণ তারা বন্দুক বহন করে। আমি কি করতে পারি? তাদের অস্ত্র আছে। আমার আছে শুধু হাত।’

west_bank_palestine_1
আওয়াদের মৌমাছির খামার পুড়িয়ে দেয় ইসরায়েলিরা। ছবি: আল জাজিরা 

আওয়াদ যোগ করেছেন যে, যুদ্ধ শুরুর আগে জীবনযাত্রা কঠিন ছিল, কিন্তু সেটি এখন আরও কঠিন হয়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘কেউ আমাদের দিকে তাকায় না শুধু আল্লাহ ছাড়া। তবে যত যাই হোক আমরা সরব না।’

গত ৭ অক্টোবর গাজার সীমান্ত সংলগ্ন ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে হামাসের নজিরবিহীন হামলায় ১২০০ ইসরায়েলি নিহত হয়েছে বলে দেশটির কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। এ সময় হামাস ইসরায়েল থেকে প্রায় ২৪০ জনকে বন্দি করে গাজায় নিয়ে যায়।

হামাসের হামলার পর ওইদিন থেকেই ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড গাজায় ব্যাপক ও ভয়াবহ হামলা শুরু করে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী। ৪৮ দিন ধরে তাদের অবিরাম হামলায় গাজাসহ ফিলিস্তিনে সাড়ে ১৪ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়। কাতারের মধ্যস্থতায় ৪৮ দিন পর তারা হামলা থামিয়ে যুদ্ধে চার দিনের যুদ্ধবিরতির চুক্তিতে পৌঁছায় হামাস ও ইসরায়েল। সেটির আজকে শেষ দিন। ইসরায়েল আগেই সতর্কতা দিয়ে রেখেছে যে, যুদ্ধবিরতি শেষ হলেই তারা পূর্ণমাত্রায় আবার আক্রমণ শুরু করবে।

সূত্র: আল জাজিরা

একে