images

আন্তর্জাতিক

গাজার সব মানুষকে তাড়িয়ে সিনাইয়ে পাঠাতে চায় ইসরায়েল: নথি ফাঁস

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

৩১ অক্টোবর ২০২৩, ০২:০০ পিএম

ইসরায়েলি সরকারের একটি মন্ত্রণালয় গাজার ২৩ লাখ ফিলিস্তিনিকে মিশরের সিনাই উপদ্বীপে স্থানান্তর করার জন্য একটি যুদ্ধকালীন প্রস্তাবের খসড়া তৈরি করেছে। সেটি একটি ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যমে ফাঁস হয়েছে। এটির তীব্র নিন্দা জানিয়েছে ফিলিস্তিন এবং কায়রোর সংঙ্গে ইসরায়েলের উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে।

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কার্যালয়ের গোয়েন্দা মন্ত্রণালয় এমন খসড়া প্রস্তাব দিয়েছে। তারা এটিকে 'কনসেপ্ট পেপার' (ধারণাপত্র) হিসেবে উপস্থাপন করেছে।

ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করতে চায়। যেমনটি আগের যুদ্ধের সময়ে ইসরায়েল করেছিল।

 ইসরায়েল গাজাকে মিশরের সমস্যায় পরিণত করতে এবং ফিলিস্তিনিদের ওপর ১৯৪৮ এর স্মৃতি ফিরিয়ে আনতে চায়। সেই সময় লাখ লাখ ফিলিস্তিনিকে নিজ ভূমি থেকে বিতাড়িত করে ইসরায়েল। সেই একই পরিকল্পনা আবারও নিয়েছে ইসরায়েল।

ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের মুখপাত্র নাবিল আবু রুদেইনেহ রিপোর্ট সম্পর্কে বলেছেন, 'আমরা যেকোনো জায়গায়, যেকোনো রূপে হস্তান্তরের বিরুদ্ধে। আমরা এটিকে একটি লাল রেখা বলে মনে করি যা আমরা অতিক্রম করতে দেব না। ১৯৪৮ আর ঘটতে দেওয়া হবে না।'

আরও পড়ুন: অবরুদ্ধ গাজা কত বড়, কীভাবে জীবন কাটে ফিলিস্তিনিদের?

আবু রুদেনেহ বলেন, একটি গণ বাস্তুচ্যুতি হবে 'নতুন যুদ্ধ ঘোষণার সমান'। ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় পূর্ণ মাত্রায় ইসরায়েলি আক্রমণে এখন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৮ হাজার ফিলিস্তিনির মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে প্রায় ৬ হাজারই নারী ও শিশু। অন্যান্য নিহতদের মধ্যেও বেশিরভাগই বেসামরিক।

সিনাইয়ে স্থায়ী তাঁবুর শহর বানাতে চায় ইসরায়েল
নথিতে সিনাইয়ে স্থায়ী তাঁবুর শহর বানানোর প্রস্তাব দিয়েছে ইসরায়েলি মন্ত্রণালয়। নথিটি অক্টোবর ১৩ তারিখের এবং এটি প্রথম স্থানীয় সংবাদ সাইট সিচা মেকোমিতে প্রকাশিত হয়। ওই রিপোর্টে ইসরায়েলের গোয়েন্দা মন্ত্রণালয়ের তিনটি প্রস্তাব রয়েছে। যদিও তারা নীতি নির্ধারণ করে না।

ইসরায়েলি মন্ত্রণালয়ের নথিতে গাজার ফিলিস্তিনি জনসংখ্যাকে মিশরের উত্তর সিনাইয়ের তাঁবুর শহরগুলোতে স্থানান্তরিত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। তারপর স্থায়ী শহরগুলো এবং একটি অনির্ধারিত মানবিক করিডোর তৈরি করা হয়েছে।

আরও পড়ুন: ফিলিস্তিনিরা কখনও গাজা ছাড়বে না: হামাস প্রধান

সেখানে বলা হয়েছে, বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের প্রবেশে বাধা দিতে ইসরায়েলের অভ্যন্তরে একটি নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা হবে। তবে প্রতিবেদনে বলা হয়নি যে, গাজার সব মানুষকে তাড়িয়ে দেওয়ার পর সেখানে কী করা হবে।

মিশরের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিবেদনে মন্তব্য করার অনুরোধের জবাব দেয়নি। তবে মিশর এই সাম্প্রতিক সংঘর্ষের সময় স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, তারা গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের বিতাড়নের সম্পূর্ণ বিপক্ষে।

gaza_1
গাজায় নির্বিচারে ফিলিস্তিনিদের হত্যা করছে ইসরায়েল। ছবি: আল জাজিরা

মিশর দীর্ঘদিন ধরে উদ্বিগ্ন যে, ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করতে চায়। যেমনটি আগের যুদ্ধের সময়ে ইসরায়েল করেছিল।

১৯৪৮ থেকে ১৯৬৭ সালের মধ্যে মিশর গাজা শাসন করেছিল, যখন ইসরায়েল পশ্চিম তীর এবং পূর্ব জেরুজালেমসহ অঞ্চলটি দখল করে নেয়। গাজার জনসংখ্যার সিংহভাগই ইসরায়েলের দখলদারিত্ব থেকে উৎখাত হওয়া ফিলিস্তিনিদের বংশধর।

আরও পড়ুন: মরবো তবুও পালাব না, বলছে গাজাবাসী

মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি বলেছেন, গাজা থেকে উদ্বাস্তুদের ব্যাপক প্রবাহ ফিলিস্তিনি কারণকে শেষ করে দেবে। তিনি সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে এই ধরনের পদক্ষেপ কায়রোকে ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে টেনে আনবে।

ইসরায়েলের 'কনসেপ্ট পেপার' (ধারণাপত্র)
নথিতেই ইসরায়েলি মন্ত্রণালয় বলেছে যে, এই প্রস্তাব আন্তর্জাতিক বৈধতার পরিপ্রেক্ষিতে জটিল। তারা সেখানে দাবি করেছে যে, জনসংখ্যাকে সরিয়ে নেওয়ার পড় লড়াইয়ে বেসামরিক মানুষের হতাহতের ঘটনা কমবে।

নথিটির সাথে পরিচিত একজন ইসরায়েলি কর্মকর্তা বলেছেন যে, এটি বাধ্যতামূলক নয় এবং নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের সঙ্গে এটি নিয়ে কোনও সারগর্ভ আলোচনা হয়নি।

নেতানিয়াহুর কার্যালয় এটিকে একটি 'কনসেপ্ট পেপার' বলে অভিহিত করেছে, যার প্রস্তাবগুলো সরকার এবং এর নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর সমস্ত স্তরে আলোচনা করা হয়েছে।

আরও পড়ুন: হামাসের শীর্ষ নেতা কারা, শিক্ষাগত যোগ্যতা কতটুকু?

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় বলেছে, 'ইসরায়েলের কোনো অফিসিয়াল ফোরামে গুরুত্বসহকারে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হয়নি। তারা এই সময়ে হামাসের শাসন ও সামরিক সক্ষমতা ধ্বংসের দিকে নজর দিয়েছে।'

নথিতে আরও দুটি বিকল্প প্রস্তাব রয়েছে যা ইসরায়েলি সরকার খারিজ করে দিয়েছে। সেগুলো হলো-  অধিকৃত পশ্চিম তীর-ভিত্তিক ফিলিস্তিনি জাতীয় কর্তৃপক্ষকে গাজার সার্বভৌম হিসাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা বা স্থানীয় শাসনকে সমর্থন করা।

gaza_2
গাজায় নিহতদের প্রায় অর্ধেকই শিশু। ছবি: এপি

ওই নথিতে বলা হয়েছে, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের পুনঃপ্রতিষ্ঠা হবে ফিলিস্তিনি জাতীয় আন্দোলনের একটি অভূতপূর্ব বিজয়। এমন একটি বিজয় যা হাজার হাজার ইসরায়েলি বেসামরিক ও সেনার জীবনের জন্য হুমকি। এটি ইসরায়েলের নিরাপত্তা রক্ষা করবে না।'

এদিকে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু জানিয়েছেন, যতক্ষণ ইসরায়েলের জয় নিশ্চিত না হচ্ছে, ততক্ষণ লড়াই অব্যাহত থাকবে। হামাসকে ছাড় দেওয়ার কোনো প্রশ্নই নেই।

ইইউতে কাজ করছে নেতানিয়াহুর লবি

তবে ইসরায়েল গোয়েন্দা মন্ত্রণালয়ের নথিকে যতই সাধারণ হিসেবে বর্ণনা করুক না কেন এ বিষয়টি এতটা গুরুত্বহীন নয়। কারণ এ বিষয়ে মিসরকে চাপ দিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) কাজ করছে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর লবি। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের এক প্রতিবেদন থেকে নেতানিয়াহুর এই পরিকল্পনার বিষয়টি জানা গেছে।

বিষয়টির সঙ্গে পরিচিত একটি সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে জানিয়েছে, এই বিষয়টি নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে গত সপ্তাহেই আলাপ হয়েছে। তাঁরা জানিয়েছেন, অস্ট্রিয়া ও চেক রিপাবলিকের নেতার বিষয়টির প্রতি সম্মতি জ্ঞাপন করেছেন। আগামী বৃহস্পতিবার বা শুক্রবার বিষয়টি ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতাদের আলোচনার টেবিলে উপস্থাপন করা হবে।

আরও পড়ুন: জীবন বাঁচাতে লবণাক্ত পানি পান করছে গাজাবাসী

তবে ইউরোপের শক্তিশালী দেশ জার্মানি ও ফ্রান্স এরই মধ্যে এমন প্রস্তাব অবাস্তব বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তারা জানিয়েছেন, মিসরের কর্মকর্তারা এর আগেও এমন প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন এবারও তাই করবেন। এমনকি অস্থায়ী ভিত্তিতেও মিসর গাজাবাসীকে শরণার্থী হিসেবে গ্রহণ করবে না। 

মিসর বারবার জানিয়েছে, ফিলিস্তিনিরা যে রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখে তা অর্জন করতে হলে গাজাবাসীকে নিজের ভূমি ছেড়ে অন্য কোথাও যাওয়া উচিত হবে না। এর আগে, গত রোববার হোয়াইট হাউস জানিয়েছে—গাজাবাসীকে যাতে নিজের ভূমি ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে না হয় তা নিশ্চিত করার বিষয়টি অন্যতম এজেন্ডা ছিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও মিসরীয় প্রেসিডেন্ট আব্দেল ফাত্তাহ আল-সিসির মধ্যকার ফোনালাপে। 

গাজায় হামাস নয়, ফিলিস্তিনি শিশুদের টার্গেট করছে ইসরায়েল
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, ইসরায়েলি হামলায় নিহত ফিলিস্তিনিদের মধ্যে সাড়ে তিন হাজারের বেশি শিশু। এছাড়া এ বর্বর হামলা শুরু হওয়ার পর থেকে ১৯ হাজার ৭৩৪ জন ফিলিস্তিনি নাগরিক আহত হয়েছেন।

আল জাজিরার খবরে বলা হয়েছে, ইসরায়েলের হামলায় গাজায় হাজার হাজার ভবন পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। বিশাল অবরুদ্ধ এই উপত্যকার অর্ধেকেরও বেশি জনসংখ্যা বাস্তুচ্যুত হয়েছে।

জাতিসংঘের প্রধান আন্তোনিও গুতেরেস উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যে, ইসরায়েল গাজায় তাদের সামরিক অভিযান জোরদার করছে। সেখানে মানবিক বিপর্যয় ঘটেছে।

সূত্র: টিআরটি

একে