images

অভিবাসন

যুক্তরাজ্যে অবৈধ অভিবাসীদের ঠিকানা হলো রুয়ান্ডায়

অভিবাসন ডেস্ক

২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১২:১১ পিএম

ফরাসি উপকূল থেকে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে আসা আশ্রয়প্রার্থীদের রুয়ান্ডায় পাঠাতে যুক্তরাজ্য সরকারের ‘বিতর্কিত’ বিলটি পার্লামেন্টে পাস হওয়ার পর এবার তাতে সম্মতি দিয়েছেন ব্রিটিশ রাজা৷ বৃহস্পতিবার ব্রিটেনের রাজা চার্লসের সম্মতির মধ্য দিয়ে ‘রুয়ান্ডার সুরক্ষা (আশ্রয় ও অভিবাসন) বিল’ আনুষ্ঠানিকভাবে আইনে পরিণত হলো।

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক ঘোষণা দিয়েছেন, আগামী ১০ থেকে ১২ সপ্তাহের মধ্যে আশ্রয়প্রার্থীদের নিয়ে রুয়ান্ডার উদ্দেশে প্রথম ফ্লাইটটি ছেড়ে যাবে।

আরও পড়ুন: ৩৩০০ অভিবাসন প্রত্যাশীকে ফেরত পাঠাল সাইপ্রাস

ইংলিশ চ্যানেলজুড়ে ছোটো নৌকা থামানোর লক্ষ্যে আশ্রয়প্রার্থীদের রুয়ান্ডা পাঠাতে দেশটির প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের নেয়া পরিকল্পনা বেশ কয়েক দফা আইনি বাধার মুখে পড়ে। দেশটির সর্বোচ্চ আদালতও পরিকল্পনাটিকে আইন বর্হিভূত বলে রায় দিয়েছে।

কিন্তু সরকার তার সিদ্ধান্তে অনড় থাকে৷ তাই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ‘রুয়ান্ডাকে নিরাপদ দেশ’ হিসাবে ঘোষণা দিতে একটি বিল আনা হয় পার্লামেন্টে৷ নিম্নকক্ষ এবং উচ্চকক্ষের ‘পিংপং’ শেষে ২২ এপ্রিল রাতে বিলটিতে অনুমোদন দিয়েছে দেশটির পার্লামেন্ট৷ আর বৃহস্পতিবার রাজার সম্মতির মধ্য দিয়ে এটি আইনে পরিণত হলো।

আশ্রয়প্রার্থীদের গ্রহণে প্রস্তুত রুয়ান্ডা

ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বিলটি পাস হওয়ার পরপর রুয়ান্ডা জানিয়েছে, আশ্রয়প্রার্থীদের গ্রহণে প্রস্তুত তারা৷

uik

রুয়ান্ডার রাজধানী কিগালির পাশের কাগুগু এলাকায় হোপ হোস্টেল নামের একটি ভবনকে আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে৷

হোপ হোস্টেলটি মূলত একটি ছাত্রাবাস৷ ১৯৯৪ সালে দেশটিতে গণহত্যার সময় যেসব কলেজ শিক্ষার্থীরা তাদের বাবা-মাকে হারিয়েছেন তাদেরকেই এই ছাত্রাবাসে থাকার সুযোগ দেয়া হতো৷ ওইসময়ে মাত্র ১০০ দিনের ব্যবধানে অন্তত আট লাখ তুতসি সম্প্রদায়ের মানুষকে হত্যা করে হুতুরা৷

এদিকে, আশ্রয়প্রার্থীদের রুয়ান্ডা পাঠাতে জোরেশোরে প্রস্তুতি নিচ্ছে যুক্তরাজ্য সরকারও৷ 

রুয়ান্ডা সরকারের উপ মুখপাত্র আলাইন মুকুরিলিন্ডা বার্তা সংস্থা এপিকে জানিয়েছেন, আশ্রয়প্রার্থীদের গ্রহণ করার জন্য দুই বছর ধরে অপেক্ষা করছে রুয়ান্ডা কর্তৃপক্ষ৷

তিনি বলেন, ‘তারা (আশ্রয়প্রার্থী) যদি এখন কিংবা আগামীকালও আসেন, সব প্রস্তুতি সম্পন্ন৷’

মুকুরিলিন্ডা বলেন, ‘রুয়ান্ডার সমালোচকেরা এবং যুক্তরাজ্যের বিচারকেরা যে বলেছিলেন এটি নিরাপদ দেশ নয়, এই আইনের মধ্য দিয়ে তা ভুল প্রমাণিত হয়েছে৷’

‘রুয়ান্ডা একটি নিরাপদ দেশ’, দাবি করেন সরকারের এই উপ মুখপাত্র৷

কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, হোপ হোস্টেলে অন্তত একশ জন আশ্রয়প্রার্থীকে রাখা যাবে৷ প্রয়োজন অনুযায়ী আগামীতে আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য আরো আবাসন ব্যবস্থা তৈরি করা হবে বলেও জানায় তারা৷

হোস্টেলটির ব্যবস্থাপক ইসমায়েল বাকিনা বলেন, আশ্রয়প্রার্থীরা ব্রিটেন থেকে এখানে আসার পর তাদের বিশ্রামের জন্য নিজ নিজ কক্ষ বুঝিয়ে দেয়া হবে, খাবার দাবার দেয়া হবে এবং কিগালি ও রুয়ান্ডা সম্পর্কে তাদের কিছু ধারণা দেয়া হবে৷

এছাড়াও হোস্টেল চত্বরে তাঁবু খাঁটিয়ে আশ্রয়প্রার্থীদের নিবন্ধন প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করা হবে৷ নিরাপত্তার জন্য পুরো হোস্টেল এলাকাতে বসানো হয়েছে সিসিটিভি ক্যামেরা৷

হোস্টেল চত্বরে বিনোদনের জন্য রাখা হয়েছে ছোট ফুটবল মাঠ, বাস্কেটবল ও ভলিবলের জন্য আলাদা কোর্ট৷ লাল গালিচা বিছিয়ে সাজিয়ে রাখা হয়েছে একটি প্রার্থনা কক্ষ৷ যারা ধূমপায়ী তাদের জন্য বিশেষ একটি কক্ষ রাখা হয়েছে বলেও জানান বাকিনা৷ 

হোস্টেলের ক্যান্টিনেই আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য রান্না-বান্না করা হবে৷ তবে কোনো আশ্রয়প্রার্থী চাইলে নিজেরটা নিজে রেঁধেও খেতে পারবেন বলে জানিয়েছেন ইসমায়েল বাকিনা৷ তিনি বলেন, আশ্রয়প্রার্থীরা হোস্টেল চত্বরের আশপাশে হাঁটাহাঁটি করতে পারবেন, এমনকি কিগালি সিটি সেন্টারে যাওয়ার অনুমতি থাকবে তাদের৷

বাকিনা আরো বলেন, ইংরেজি এবং আরবিসহ ‘আমাদের সঙ্গে নানা ভাষাভাষী মানুষ রয়েছেন, যারা আশ্রয়প্রার্থীদের ভাষা বুঝতে পারবেন৷’

আশ্রয়প্রার্থীদের আসার প্রথম তিন মাসের মধ্যে নথি যাচাই-বাছাইয়ের কাজটি শেষ করতে চায় রুয়ান্ডা সরকার৷ এরপর কেউ যদি রুয়ান্ডায় থাকতে চান, তাদের সেই সুযোগ দেয়া হবে এবং কেউ যদি নিজ দেশে ফিরে যেতে চান, তাকেও সহযোগিতা দেবে দেশটির সরকার৷

uk2

সরকারের উপ মুখপাত্র মুকুরিলিন্ডা জানিয়েছেন, যেসব আশ্রয়প্রার্থী রুয়ান্ডায় থাকতে আগ্রহী হবেন, তাদেরকে পাঁচ বছর পর্যন্ত অর্থনৈতিক থেকে শুরু করে সব ধরনের সহযোগিতা দেবে রুয়ান্ডা সরকার৷ এই পাঁচ বছরের মধ্যে তাদের রুয়ান্ডার সমাজে একীভূত হতে হবে৷ তারপর, নিজেদের ব্যবস্থা নিজেদের করে নিতে হবে৷

রুয়ান্ডা পরিকল্পনায় যা আছে

দেশটির প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের এই পরিকল্পনা অনুযায়ী, ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে দেশটির দক্ষিণ উপকূলে আসা আশ্রয়প্রার্থীদের আফ্রিকার দেশ রুয়ান্ডায় পাঠানো হবে, সেখানেই তাদের আশ্রয় আবেদন যাচাই-বাছাই করা হবে৷ 

মূলত ইংলিশ চ্যানেল পেরিয়ে যারা ব্রিটিশ উপকূলে আসেন, তারা যুক্তরাজ্যে আশ্রয় চেয়ে আবেদন করেন৷ অতীতে তাদের অনেকের আবেদন মঞ্জুরও করা হয়েছে৷ কিন্তু বর্তমান রক্ষণশীল সরকার বলছে, এসব আশ্রয়প্রার্থীদের প্রকৃত শরণার্থী হিসাবে মূল্যায়ন করা উচিত নয়৷ কারণ, তারা ফ্রান্স হয়ে যুক্তরাজ্যে আসেন, কিন্তু ফ্রান্স বা অন্য কোনো নিরাপদ দেশে তারা আশ্রয়ের আবেদন করেন না৷

২০২২ সালে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে দেশটিতে আসেন রেকর্ড সংখ্যক ৪৬ হাজার আশ্রয়প্রার্থী৷ ওই বছর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন আশ্রয়প্রার্থীদের যুক্তরাজ্যের প্রতি নিরুৎসাহিত করতে তাদের রুয়ান্ডা পাঠানোর প্রস্তাবটি সামনে আনেন৷ এরপর সেটিকে এগিয়ে নিতে চান তার উত্তরসুরী ঋষি সুনাকও৷

২০২২ সালের জুনে প্রথম ফ্লাইট পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয় যুক্তরাজ্য সরকার৷ কিন্তু ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালতের রায়ে ভেস্তে যায় সেই পরিকল্পনা৷ যুক্তরাজ্যের রুয়ান্ডার পরিকল্পনা বিরোধিতা করে আসছে মানবাধিকার সংস্থাগুলোও৷ নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে যুক্তরাজ্যের সর্বোচ্চ আদালতেও খারিজ হয়ে যায় পরিকল্পনাটি৷ ফলে এখন পর্যন্ত কোনো আশ্রয়প্রার্থীকে রুয়ান্ডায় পাঠানো সম্ভব হয়নি৷

কিন্তু সরকারের নতুন এই আইনের অধীনে রুয়ান্ডাকে একটি নিরাপদ দেশ হিসাবে ঘোষণা করা হবে৷ এমনকি ব্রিটেনের মানবাধিকার আইনের কিছু অংশ এই আইনকে চ্যালেঞ্জ করতে পারবে না৷ ফলে আশ্রয়প্রার্থীদের রুয়ান্ডা পাঠানোর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সরকারের জন্য সহজ হবে৷ 

যুক্তরাজ্যে কড়া নাড়ছে সাধারণ নির্বাচন৷ তার আগেই রুয়ান্ডায় আশ্রয়প্রার্থীদের পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করতে চায় সুনাক প্রশাসন৷ বিরোধী লেবার পার্টির কাছে জনমত জরিপে পিছিয়ে থাকা ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভরা এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে ভোটের মাঠে নিজেদের চাঙ্গা করতে চান৷

তথ্যসূত্র: ইনফো মাইগ্রেন্টস

এজেড