images

হেলথ

মাতৃ ও শিশুমৃত্যু কমাতে স্বাস্থ্য খাতে বড় বিনিয়োগের উদ্যোগ

আব্দুল হাকিম

২৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১:০৪ পিএম

স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামো শক্তিশালীকরণ এবং মা ও শিশুস্বাস্থ্যের মানোন্নয়নে সরকার জেলা পর্যায়ে একটি বৃহৎ উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের প্রস্তাবিত এই প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের ২৯টি জেলা শহরে বিদ্যমান মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রকে ৩০ শয্যাবিশিষ্ট আধুনিক হাসপাতাল হিসেবে উন্নীত ও পুনর্নিমাণ করা হবে। প্রকল্পটির মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ৩২৯ কোটি ৫৩ লাখ ৩৫ হাজার টাকা, যা সম্পূর্ণভাবে সরকারি অর্থায়নে বাস্তবায়িত হবে। এতে কোনো বৈদেশিক ঋণ বা অনুদান অন্তর্ভুক্ত নেই।

জুলাই ২০২৫ থেকে জুন ২০২৮ পর্যন্ত তিন বছর মেয়াদে এই উন্নয়ন কার্যক্রম সম্পন্ন হবে। প্রস্তাবিত প্রকল্পটি ইতোমধ্যেই প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সুপারিশ লাভ করেছে এবং জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)-এর অনুমোদন জন্য উপস্থাপনার প্রস্তুতি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মোট ব্যয়ের মধ্যে রাজস্ব ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১৪ কোটি ৫৫ লাখ টাকা, যা মোট ব্যয়ের মাত্র ১.০৯ শতাংশ। এই রাজস্ব ব্যয় মূলত প্রকল্প পরিচালনা, প্রশাসনিক কার্যক্রম এবং সাময়িক সেবামূলক খাতে ব্যয় করা হবে। এর মধ্যে প্রকল্প পরিচালক (পিডি) অফিসের কর্মকর্তা ও স্টাফদের বেতন-ভাতা, অফিস ভাড়া, পরিবহন খরচ, বিদ্যুৎ ও টেলিফোন বিল, ডাক ব্যয়, প্রচার ও বিজ্ঞাপন, ভ্রমণ ব্যয় এবং মুদ্রণ ও বাঁধাই খরচ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়নকালে অস্থায়ীভাবে হাসপাতাল ভবন ভাড়া বাবদ প্রায় ৮ কোটি ৬৯ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা রাজস্ব ব্যয়ের সবচেয়ে বড় অংশ। রাজস্ব ব্যয়ের আওতায় আরও রয়েছে মৃত্তিকা পরীক্ষা, ডিজিটাল জরিপ, পরিবেশ অধিদফতর থেকে ছাড়পত্র সংগ্রহ এবং সম্মানী বা পারিশ্রমিক সংক্রান্ত ব্যয়। 

 

অন্যদিকে প্রকল্পের মূলধন ব্যয় বা অ্যাসেট খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে মোট ১২৮ কোটি ৯০৫ লাখ টাকা। প্রকল্পের সবচেয়ে বড় ব্যয় খাত হলো হাসপাতাল ভবন নির্মাণ কাজে ১৪৫ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। যা মোট প্রকল্প ব্যয়ের প্রায় ৭৯ শতাংশ। মানিকগঞ্জ মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের জন্য আলাদাভাবে আবাসিক ও অনাবাসিক ভবন নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১৭ কোটি ৪ লাখ টাকা। এছাড়া এসব কেন্দ্রে ২৮টি প্যাসেঞ্জার লিফট ও ২৮টি বেড লিফট স্থাপনে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৮৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা।

চিকিৎসা সেবার মান বাড়াতে প্রকল্পের একটি বড় অংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে আধুনিক চিকিৎসা যন্ত্রপাতির জন্য। ২৯টি মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের জন্য মোট ৮ হাজার ৪৩৯টি চিকিৎসা যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১২৯ কোটি ১৩ লাখ টাকা, যা মোট ব্যয়ের প্রায় ৯.৬ শতাংশ। পাশাপাশি প্রতিটি কেন্দ্রের জন্য কম্পিউটার ও আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম কেনায় প্রায় সাড়ে ৫ কোটি টাকা এবং অনলাইন মেডিকেল ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যার উন্নয়নে প্রায় দেড় কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।

বর্তমানে পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের অধীনে পরিচালিত অধিকাংশ মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের ভবন ৫০ থেকে ৬০ বছর পুরোনো, জরাজীর্ণ এবং মাত্র ১০ থেকে ২০ শয্যাবিশিষ্ট। প্রয়োজনের তুলনায় এসব কেন্দ্রের শয্যা সংখ্যা অপ্রতুল। এছাড়া চিকিৎসক, নার্স ও সহায়ক জনবলের সংকট, আধুনিক চিকিৎসা যন্ত্রপাতির অভাব, প্যাথলজি ল্যাব ও জরুরি সেবার সীমাবদ্ধতার কারণে এসব কেন্দ্র থেকে কাঙ্ক্ষিত সেবা পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে জেলা ও আশপাশের উপজেলার সাধারণ মানুষ বড় হাসপাতালের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে।

এই বাস্তবতা বিবেচনায় স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ ‘জেলা শহরে বিদ্যমান মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রকে ৩০ শয্যাবিশিষ্ট মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে উন্নীতকরণ/পুনর্র্নিমাণ (প্রথম ফেইজ)’ শীর্ষক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। প্রকল্পের মূল লক্ষ্য- জেলা শহরে বসবাসরত সুবিধাবঞ্চিত ও নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর জন্য স্বল্প ব্যয়ে মানসম্মত মা ও শিশুস্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা।

প্রকল্পের আওতায় প্রথম পর্যায়ে ২৮টি নতুন হাসপাতাল ভবন নির্মাণ এবং একটি বিদ্যমান ভবনের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। প্রতিটি নতুন হাসপাতাল ভবন হবে ৯ তলা ফাউন্ডেশনসহ ৮ তলা বিশিষ্ট। এতে অন্তর্ভুক্ত থাকবে অভ্যন্তরীণ বিদ্যুতায়ন, পানি সরবরাহ, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, বহিঃস্থ স্যানিটেশন, ভূগর্ভস্থ জলাধার, কমপাউন্ড ড্রেনসহ প্রয়োজনীয় সব আনুষঙ্গিক সুবিধা। এছাড়া লিফট, জেনারেটর, সোলার প্যানেল, ফায়ার ফাইটিং সিস্টেম, সিসিটিভি ও এক্সেস কন্ট্রোলসহ আধুনিক ইলেক্ট্রো-মেকানিক্যাল যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হবে।

হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা আরও কার্যকর করতে ওয়েবভিত্তিক অনলাইন মেডিকেল ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যার চালুর পরিকল্পনা রয়েছে। পাশাপাশি চিকিৎসা সরঞ্জাম, আধুনিক যন্ত্রপাতি, কম্পিউটার ও প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র ক্রয় এবং নতুন জনবল নিয়োগের মাধ্যমে সেবার মান বাড়ানো হবে। ভূমি উন্নয়ন, সবুজায়ন ও ল্যান্ডস্কেপিং কার্যক্রমও প্রকল্পের অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

প্রকল্প এলাকা নির্বাচনের ক্ষেত্রে জেলা শহরগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে, কারণ এসব শহরের যোগাযোগ ব্যবস্থা তুলনামূলক ভালো হওয়ায় আশপাশের উপজেলা ও গ্রামাঞ্চলের মানুষ সহজেই সেখানে যাতায়াত করতে পারবে। দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৭টি বিভাগীয় শহরে ইতিমধ্যে ১০০ শয্যাবিশিষ্ট মা ও শিশু স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান নির্মাণের পৃথক প্রকল্প প্রক্রিয়াধীন থাকায় এবং সুনামগঞ্জ জেলায় ২০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল নির্মাণাধীন থাকায় এই ৮টি জেলা প্রকল্পের আওতার বাইরে রাখা হয়েছে। অবশিষ্ট ৫৬ জেলার মধ্যে যেসব জেলায় পর্যাপ্ত জমি রয়েছে এবং যেখানে ৩০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল নির্মাণ জরুরি, সেসব জেলা থেকে ২৯টি জেলা প্রথম ধাপে নির্বাচিত হয়েছে।

নির্বাচিত জেলাগুলোর মধ্যে রয়েছে- মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী, কিশোরগঞ্জ, টাঙ্গাইল, গোপালগঞ্জ, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কক্সবাজার, লক্ষ্মীপুর, রাঙ্গামাটি, নওগাঁ, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, যশোর, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, বাগেরহাট, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি, বরগুনা, পিরোজপুর, হবিগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, জামালপুর ও শেরপুর।

অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে প্রকল্পটির বেনিফিট কস্ট রেশিও ১.৪২ এবং ইন্টারনাল রেট অব রিটার্ন ৩২.৮৩ শতাংশ নির্ধারিত হয়েছে, যা প্রকল্পটির অর্থনৈতিক সম্ভাব্যতা নির্দেশ করে।

পরিকল্পনা কমিশন সূত্র বলছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে নিরাপদ হাসপাতাল ডেলিভারি, জরুরি প্রসূতি সেবা, নবজাতক সেবা, কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্যসেবা ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা আরও সম্প্রসারিত হবে। এর ফলে মাতৃ ও শিশুমৃত্যু হ্রাসের পাশাপাশি জেলা পর্যায়ে বড় হাসপাতালের ওপর চাপ কমবে এবং স্বাস্থ্যসেবায় মানুষের আস্থা বৃদ্ধি পাবে।

পরিকল্পনা কমিশন জানিয়েছে, দেশের স্বাস্থ্য খাতে—বিশেষ করে মা ও শিশুস্বাস্থ্য সেবায়—উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলেও মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার এখনো প্রত্যাশিত মাত্রায় নামিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। এই পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়নে বিদ্যমান মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রগুলোর অবকাঠামো সংস্কার ও পুনর্নির্মাণের পাশাপাশি দক্ষ জনবল নিয়োগ ও পদায়ন জরুরি বলে মত দিয়েছে কমিশন। এতে সেবা কেন্দ্রগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়বে এবং সেবা গ্রহণকারীরা কাঙ্ক্ষিত মানের চিকিৎসাসেবা পাবেন।

স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের আওতায় পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতর একটি উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব করেছে। ‘জেলা শহরে বিদ্যমান মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রকে ৩০ শয্যাবিশিষ্ট মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে উন্নীতকরণ ও পুনর্র্নিমাণ (প্রথম ধাপ)’ শীর্ষক প্রকল্পটির মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৩২৯ কোটি ৫৩ লাখ ৩৩ হাজার ৫০০ টাকা, যা সম্পূর্ণভাবে সরকারি অর্থায়নে বাস্তবায়ন করা হবে।

পরিকল্পনা কমিশন জানায়, প্রকল্পটির ব্যয় ৫০ কোটি টাকার বেশি হওয়ায় সরকারি উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদনসংক্রান্ত নির্দেশিকা অনুযায়ী এটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির অনুমোদনের আওতাভুক্ত। প্রস্তাব অনুযায়ী, প্রকল্পটি জুলাই ২০২৫ থেকে জুন ২০২৮ পর্যন্ত তিন বছর মেয়াদে বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এমতাবস্থায়, দেশের মা ও শিশুস্বাস্থ্য সেবার অবকাঠামো ও সক্ষমতা জোরদারে প্রস্তাবিত প্রকল্পটি একনেকের অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হয়েছে।

দেশের ২৯টি জেলা শহরে মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রকে ৩০ শয্যাবিশিষ্ট আধুনিক হাসপাতালে রূপান্তরের লক্ষ্যে প্রস্তাবিত উন্নয়ন প্রকল্পে রাজস্ব ও মূলধন—দুই খাত মিলিয়ে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৩২৯ কোটি ৫৩ লাখ টাকার বেশি। প্রকল্পের অর্থনৈতিক কোডভিত্তিক ব্যয় বিশ্লেষণে দেখা গেছে, অবকাঠামো নির্মাণ ও চিকিৎসা যন্ত্রপাতি খাতেই ব্যয়ের সিংহভাগ বরাদ্দ রাখা হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ গত তিন দশকে মা ও শিশুস্বাস্থ্য খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করলেও মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যু হার প্রত্যাশিত মাত্রায় কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে এখনো চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। বিশেষ করে বাড়িতে অনিরাপদ প্রসব, দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীর ঘাটতি এবং জেলা পর্যায়ের হাসপাতাল অবকাঠামোর সীমাবদ্ধতা এই খাতে বড় অন্তরায় হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এসব সমস্যা নিরসনে জেলা শহরভিত্তিক মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রগুলোকে শক্তিশালী করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

এএইচ/জেবি