সাখাওয়াত হোসাইন
১২ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৬:৪৭ এএম
দেশজুড়ে স্বাস্থ্যসেবার বৈষম্য ক্রমেই প্রকট হচ্ছে। উন্নত চিকিৎসা, নিত্যপ্রয়োজনীয় ওষুধ, দক্ষ চিকিৎসক এবং সহজলভ্য স্বাস্থ্যকেন্দ্র—সবকিছুই যেন সীমাবদ্ধতার এক অদৃশ্য দেয়ালে আটকে যাচ্ছে। ফলে অসুস্থতা নিয়ন্ত্রণের আগেই বহু মানুষ জটিলতায় পড়ছেন। চিকিৎসা ব্যয়, পরীক্ষা-নিরীক্ষার খরচ এবং নিয়মিত ওষুধের দাম অনেক পরিবারের সাধ্যের বাইরে চলে গেছে। গ্রামীণ এলাকায় অবস্থাটা আরও কঠিন; সেখানে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সংখ্যা কম, জরুরি সেবার মানও অপ্রতুল। এতে শহর-গ্রাম বিভাজন স্বাস্থ্যসেবার মানে বড় ফাঁক তৈরি করছে, যা সার্বিক জনস্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকে শক্তিশালী করা এবং কমিউনিটি-ভিত্তিক চিকিৎসা উদ্যোগ বাড়ানোই প্রথম করণীয় হতে পারে। পাশাপাশি দরিদ্র ও ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর জন্য ভর্তুকি, ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণ এবং দক্ষ জনবল তৈরি—সব মিলিয়ে এখন সমন্বিত পদক্ষেপ খুব জরুরি। না হলে চিকিৎসা-বঞ্চনার হার আরও বাড়বে, আর স্বাস্থ্যসেবা সত্যিই সাধারণ মানুষের হাতছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে।
ব্যয়বহুল চিকিৎসার চাপে পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত
স্বাস্থ্যসেবার নাগালের বাইরে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো চিকিৎসা খরচের লাগামহীন বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক চাপ। সরকারি কেন্দ্রগুলোতে সুবিধা সীমিত, আর বেসরকারি চিকিৎসা অধিকাংশ মানুষের জন্য ব্যয়বহুল। কোনো গুরুতর রোগে চিকিৎসার ব্যয় অনেক পরিবারকে ঋণের বোঝায় জর্জরিত করে বা সঞ্চয় শেষ করে দেয়। অনেক ক্ষেত্রে রোগীরা প্রয়োজনীয় পরীক্ষা বা দীর্ঘ মেয়াদের চিকিৎসা চালিয়ে যেতে পারেন না। ফলে রোগ জটিল আকার ধারণ করে এবং এর সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হয়।
শহর-গ্রাম চিকিৎসা ব্যবস্থার বিস্তর বৈষম্য
গ্রামে চিকিৎসার অবস্থা সবচেয়ে নাজুক। পর্যাপ্ত চিকিৎসক নেই, অনেক স্থানে ওষুধের অভাব, আর জরুরি সেবার জন্য প্রয়োজনীয় অ্যাম্বুলেন্স বা প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা কম। শহরের বেসরকারি হাসপাতালগুলো আধুনিক যন্ত্রপাতি ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দিয়ে দ্রুত সেবা দিতে পারলেও এর সুবিধা নিতে সক্ষম মানুষের সংখ্যা সীমিত। গ্রাম-শহরের এই ব্যবধান জনস্বাস্থ্যকে কার্যত দুই গতিতে ভাগ করে ফেলেছে।
পিরোজপুরের কাউখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসক সংকট প্রকট। সেখানে ১০টি চিকিৎসকের পদ থাকলেও বর্তমানে কর্মরত আছেন মাত্র একজন। ফলে জরুরি বিভাগ, বহির্বিভাগ ও অন্তঃবিভাগ—সব একাই সামাল দিতে হচ্ছে তাঁকে। এতে সেবা ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি রোগীরাও বিপাকে পড়ছেন।
জানতে চাইলে পিরোজপুর জেলা সিভিল সার্জন অফিসের একজন কর্মকর্তা ঢাকা মেইলকে জানান, চিকিৎসক সংকট দূর করতে বহুবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে জানানো হলেও তেমন অগ্রগতি হয়নি। ডাক্তাররাও উপজেলায় থাকতে চান না, যার ভুক্তভোগী হচ্ছেন চিকিৎসাপ্রত্যাশীরা।
দীর্ঘস্থায়ী রোগ বাড়ছে
ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ক্যানসার, কিডনি সমস্যা—এসব দীর্ঘস্থায়ী রোগ দ্রুত বাড়ছে। এসব রোগের চিকিৎসা দীর্ঘ সময় ধরে চালাতে হয় এবং তা ব্যয়সাপেক্ষ। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সময়মতো নিতে না পেরে আরও বড় ঝুঁকিতে পড়ছেন।
বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ডা. শাহিনুল আলম বলেন, আমাদের দেশে বেশির ভাগ মানুষ ঋণের ওপর নির্ভর হয়ে চিকিৎসা করেন। পরে সেই ঋণ শোধ করতে জমিজমা বিক্রি করতেও বাধ্য হন অনেকে। এটি স্বাস্থ্যব্যবস্থার দুর্বলতা এবং সাধারণ মানুষের প্রতি অবহেলা স্পষ্ট করে।
তিনি বলেন, স্বাস্থ্য খাতে আর্থিক চাপের কারণে মানুষের জীবনযাত্রা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ছে। ঋণ নিয়ে চিকিৎসা করলেও অনেক সময় প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পাওয়া যায় না, আর দীর্ঘমেয়াদে চিকিৎসার ব্যয় বহন করতে গিয়ে মৌলিক চাহিদা থেকেও বঞ্চিত হতে হয়।

সরকারি চিকিৎসা বঞ্চিত ৬৫ শতাংশ মানুষ
ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টস (এএনএইচ) জানায়, দেশের ৬৫ শতাংশ মানুষ সরকারি হাসপাতালের সেবা থেকে বঞ্চিত। সরকারি হাসপাতালে শয্যাসংকট, জনবল ঘাটতি এবং সীমিত সক্ষমতার কারণে রোগীরা বাধ্য হয়ে বেসরকারি চিকিৎসার ওপর নির্ভর করছেন। এর সুযোগে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সংখ্যা। শহরের বেশির ভাগ সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা পেতেও রোগীদের ভোগান্তি পোহাতে হয়, আর সেবার মানও অনেক ক্ষেত্রে সন্তোষজনক নয়।
চিকিৎসায় অবহেলার শিকার প্রতি তিনজনে একজন
বিবিএসের জরিপ বলছে, সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে সেবা নিতে গিয়ে প্রতি তিনজন রোগীর একজন অবহেলা, অযত্ন বা অপচিকিৎসার শিকার হন। গ্রামাঞ্চলের তুলনায় শহরে এ হার বেশি। দেশের ৯১ শতাংশ মানুষ চান, সরকার যেন সবার জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে আইনগতভাবে বাধ্য থাকে।
স্বাস্থ্যসেবায় বরাদ্দে এশিয়ার অন্যতম সর্বনিম্ন বাংলাদেশ
স্বাস্থ্য খাতে সরকারি ব্যয় দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে কম বাংলাদেশে। ২০১৯ সালে স্বাস্থ্যসেবার মোট ব্যয়ে সরকারি অবদান ছিল মাত্র ৩ শতাংশ, যা আফগানিস্তানের চেয়েও কম। মালদ্বীপে এ হার ১৯ দশমিক ১৫ শতাংশ, ভুটানে ১০ দশমিক ৪১ এবং শ্রীলঙ্কায় ৯ দশমিক ২৫ শতাংশ।
বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যখাতে সরকারি ব্যয় সবচেয়ে কম বাংলাদেশে—মাত্র ১ দশমিক ১৯ শতাংশ। যেখানে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো গড়ে ব্যয় করে ৪ দশমিক ৫৯ শতাংশ এবং স্বল্পোন্নত দেশগুলো ৫ দশমিক ৫৫ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হলে স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির অন্তত ৫ শতাংশ বরাদ্দ প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশে তা মাত্র ১ শতাংশের সামান্য বেশি।
জনবল ঘাটতি ও অবকাঠামো সমস্যাকেও বড় সংকট হিসেবে উল্লেখ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, এখন থেকেই উদ্যোগ নিলে ২০৩০ সালের মধ্যে পুরোপুরি না হলেও এসডিজির লক্ষ্যের কাছাকাছি যাওয়া সম্ভব।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. তারিকুল ইসলাম লিমন বলেন, দেশে স্বাস্থ্যখাতের সবচেয়ে বড় সংকট বাজেট ও জনবল—বিশেষ করে ডাক্তার, নার্স ও টেকনিশিয়ান। এসব পদে বিপুলসংখ্যক শূন্যপদ রয়েছে, যা সেবা প্রদানে বড় বাধা তৈরি করছে।
অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ বলেন, স্বাস্থ্য খাতে আর্থিক চাপ মোকাবিলায় সঠিক স্বাস্থ্যবিমা, রাষ্ট্রীয় সহায়তা, সেবার মানোন্নয়ন ও জরুরি সংস্কার জরুরি। উচ্চ আউট অব পকেট ব্যয় সাধারণ মানুষকে বিপদে ফেলছে, আর বেসরকারি খাতের ওপর নির্ভরতা বাড়াচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতায় সেবা সুলভ ও সহজলভ্য করা জরুরি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাবেক উপদেষ্টা ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, প্রতিবছর ৬৪ লাখ মানুষ দরিদ্র হচ্ছেন কেবল স্বাস্থ্যব্যয়ের কারণে। এর বড় অংশই ওষুধ কেনার পেছনে খরচ হয়। তাই সরকারের প্রতিরোধমূলক উদ্যোগ এখন সময়ের দাবি।
এসএইচ/এআর