images

হেলথ

 দেশে শিশু মৃত্যুর ১৮ শতাংশ নিউমোনিয়ায়, এতো মৃত্যু কেন?

সাখাওয়াত হোসাইন

১২ নভেম্বর ২০২৫, ১২:৫৯ এএম

•    শিশু হাসপাতালে ঠাণ্ডাজনিত রোগে প্রতিদিন ৫-৬ শিশুর মৃত্যু
•    প্রতি ঘণ্টায় ২ থেকে ৩টি শিশু নিউমোনিয়ায় মারা যায়
•    নিউমোনিয়ায় মারা যাওয়া শিশুদের ৪৬ শতাংশ অপুষ্টির শিকার
•    মায়ের দুধে নিউমোনিয়ার ঝুঁকি কমে

দিন যত যাচ্ছে, ততই বাড়ছে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা। শুধু নির্দিষ্ট কোনো জেলা কিংবা শহর নয়; সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে নিউমোনিয়ার প্রাদুর্ভাব। প্রতি বছর নিউমোনিয়ায় বাড়ছে মৃত্যুও। দেশে শিশুর মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ নিউমোনিয়া। বিশেষ করে মৌসুমী  পরিবর্তন ও শীতের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ বাড়ছে, যার মধ্যে নিউমোনিয়া সবচেয়ে মারাত্মক। অনেকেই মারাত্মক শ্বাসকষ্ট ও উচ্চ জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। হাসপাতালগুলোতে নিউমোনিয়ায় আক্রান্তদের মধ্যে শিশু ও বয়স্কদের হার বেশি। 

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, বায়ুদূষণ, ঠাণ্ডা ও শুষ্ক আবহাওয়া এবং ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণ এই বৃদ্ধি পাওয়া নিউমোনিয়ার মূল কারণ। রোগটি ছোঁয়াচে হওয়ায় হাঁচি-কাঁশি মাধ্যমে ছড়াতে পারে। যাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল—বিশেষ করে ছোট শিশু, প্রবীণ ও দীর্ঘমেয়াদি রোগী—তাদের জন্য এই রোগটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। চিকিৎসকরা সবাইকে হঠাৎ তাপমাত্রা পরিবর্তনের সময় সাবধান থাকতে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে এবং প্রয়োজনে দ্রুত চিকিৎসা নিতে পরামর্শ দিয়েছেন।

চিকিৎসকরা বলেন, নিউমোনিয়া প্রতিরোধে টিকা গ্রহণ, পর্যাপ্ত বিশ্রাম, পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ ও ধোঁয়া-বাষ্প এড়িয়ে চলতে হবে। পাশাপাশি, শিশুদের নিয়মিতভাবে উষ্ণ পোশাক পরানো এবং ঠান্ডা লাগলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন। সময়মতো সচেতনতা বৃদ্ধি ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমেই নিউমোনিয়া থেকে মৃত্যুহার উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব। 

Child_healt_for_cool_weather_2

বাংলাদেশ শিশু হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী, হাসপাতালটিতে বতর্মানে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ৫৭ জন রোগী ভর্তি রয়েছে। এ বছর দুই হাজার ২০০ নিউমোনিয়া রোগী ভর্তি ছিলেন। ঠাণ্ডাজনিত রোগে প্রতিদিন হাসপাতালটিতে মারা যায় ৫-৬ জন শিশু। হাসপাতালটির আউটডোরে প্রতিদিন ৩০০ শিশু ঠাণ্ডা ও কাঁশির চিকিৎসা সেবা নেন। 

আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) তথ্য মতে, দেশে প্রতি ঘণ্টায় দুই থেকে তিনটি শিশু নিউমোনিয়ায় মারা যায়। দেশে বছরে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে ২৪ হাজার শিশু। ছয় লাখ ৭৭ হাজার শিশু নিউমোনিয়া নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। 

 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতে, দেশে মোট শিশু মৃত্যুর প্রায় ১৮ শতাংশই হয় নিউমোনিয়ার কারণে। এমনকি বিশ্বে নিউমোনিয়ার কারণে প্রতি বছর পাঁচ বছরের কম বয়সি ১৪ লাখ শিশু মারা যায়, যা বিশ্বব্যাপী পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের মোট মৃত্যুর ১৮ শতাংশ।

সংস্থাটির তথ্যমতে, বাংলাদেশে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে ৯৫ শতাংশ হাসপাতালে নিউমোনিয়া চিকিৎসার সুব্যবস্থাপনা নেই এবং সংকট রয়েছে। যে কারণে ফুসফুস সংক্রমণ দেখা দেওয়ার পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে ৪২ শতাংশকে চিকিৎসা নেওয়ার জন্য নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেওয়া হয়। অন্য কোনো চিকিৎসাসেবা না থাকায় ৩৪ শতাংশ শিশুকে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ দেওয়া হয়। অভিভাবকদের অসচেতনতা এবং সরকারি হাসপাতালে অক্সিজেন মাপার যন্ত্রসহ নানা সংকটে দেশে পাঁচ বছর ধরে মৃত্যুর হার প্রায় একই।

ইউনিসেফের মতে, বিশ্বে প্রতি ৩৯ সেকেন্ডে একজন শিশু নিউমোনিয়ায় মারা যায়। বিশ্বে প্রায় ৫০ লাখ শিশুর মৃত্যু। এরমধ্যে ১৪ শতাংশ ছিল নিউমোনিয়ায় মৃত্যু। ৬৫ বছর বয়সি সিওপিডিতে আক্রান্তদের নিউমোকোক্কাল নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি একজন সুস্থ ব্যক্তির চেয়ে ৭ দশমিক ৭ গুণ বেশি। যাদের হাঁপানি রয়েছে তাদের ঝুঁকি ৫ দশমিক ৯ গুণ বেশি। ৫০ বছরের বেশি বয়সি প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে বছরে ১৬ লাখ মানুষের নিউমোনিয়ায় মৃত্যুর জন্য বায়ু দূষণ এবং ধূমপান দায়ী বলে মনে করা হয়। 

1
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতে, দেশে মোট শিশু মৃত্যুর প্রায় ১৮ শতাংশই হয় নিউমোনিয়ার কারণে 

২০২০ সালের জানুয়ারিতে ইউনিসেফ বলেছিল, নিউমোনিয়া প্রতিরোধে আরও পদক্ষেপ না নেওয়া হলে আগামী এক দশকে বাংলাদেশে ১ লাখ ৪০ হাজার শিশু মারা যেতে পারে। অপুষ্টি, বায়ুদূষণ এবং টিকা ও অ্যান্টিবায়োটিক না পাওয়ার কারণে ২০১৯ সালে বাংলাদেশে প্রতি ঘণ্টায় একজন করে শিশু মারা গেছে।

স্টপ নিউমোনিয়া ২০১৭ সালের তথ্য দিয়ে বলেছে, বাংলাদেশে নিউমোনিয়ায় মারা যাওয়া শিশুদের ৪৬ শতাংশ অপুষ্টির শিকার হয়। এ ছাড়া ৩০ শতাংশ গৃহস্থালির জ্বালানির দূষণ ও ২৬ শতাংশ অপরিণত বয়সে জন্ম নেওয়া শিশু ছিল। আর ২০১৮ সালে ১৩ শতাংশ শিশুর মৃত্যু হয় নিউমোনিয়ায়। ২০০০ সাল থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে নিউমোনিয়ায় মৃত্যুর হার হ্রাসের গড় বার্ষিক হার ৮ শতাংশ।

নিউমোনিয়ায় এতো মৃত্যু কেন?

জানতে চাইলে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মাহবুবুল আলম ঢাকা মেইলকে বলেন, নিউমোনিয়ায় এতো মৃত্যুর কারণ দেরি করে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া এবং দেরিতে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা। শিশু পরিচর্যায় অবহেলা এবং অনেক সময় বাবা-মা বুঝতে পারেন না, শিশু নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত। যাদের ঠাণ্ডা কাঁশি হয় তাদের ৩০ শতাংশ হয় নিউমোনিয়ার জন্য।

শিশু হাসপাতালের এই চিকিৎসক বলেন, অপরিণত বয়সে জন্ম নেওয়া, অপুষ্টি, শিশুর রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম থাকা, দূষণ এবং ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে শরীরে জীবাণুর প্রতিরোধব্যবস্থা তৈরি হওয়ার কারণে নিউমোনিয়া হতে পারে।

চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার উন্নতির তাগিদ

নিউমোনিয়া প্রতিরোধে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সার্বিক উন্নতি করার তাগিদ দিয়েছেন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লা। তিনি বলেন, নিউমোনিয়া একটি বিচ্ছিন্ন বিষয় বা ইস্যু নয়। স্বাস্থ্যব্যবস্থার সামগ্রিক উন্নতি না করে নিউমোনিয়া পরিস্থিতির উন্নতি করা যাবে না। এ জন্য সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার পথে যেতে হবে। সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

মোহাম্মদ সহিদুল্লা বলেন, তরুণ, অল্পবয়স্কসহ যেকোনো বয়সের মানুষের নিউমোনিয়া হতে পারে। তবে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের এবং বয়স্ক ব্যক্তিদের ঝুঁকি বেশি। তার চেয়ে বেশি ঝুঁকি এক বছরের কম বয়সী শিশুর, তার চেয়ে বেশি ঝুঁকি নবজাতকের।

শিশুরা কেন আক্রান্ত হচ্ছে?

চিকিৎসকদের মতে, শিশুরাই সহজে ও ঘনঘন নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয় বেশি। কারণ নিউমোনিয়া একটি বায়ুবাহিত রোগ; সুতরাং নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত একটি শিশু যখন হাঁচি-কাশি দেয় বা নিঃশ্বাস ছাড়ে অথবা কথা বলে এর থেকে জীবাণু বের হয়ে বাতাসে মিশে যায়, আর ওই জীবাণুমিশ্রিত বাতাস যে শিশু শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করবে সেই শিশুটিও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে। এ ছাড়া সর্দি-কফের সরাসরি সংস্পর্শেও রোগটি হতে পারে।

শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা এ কারণে বেশি হয় যে প্রথমত বড়দের তুলনায় শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কিছুটা কম থাকে। শিশুরা একে অন্যের সঙ্গে মেলামেশা করে। যেমন- স্কুলে খেলাধুলার সময়। এভাবে একটি আক্রান্ত শিশু থেকে অন্য আরো শিশু আক্রান্ত হতে পারে। 

555
শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা এ কারণে বেশি হয় যে প্রথমত বড়দের তুলনায় শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কিছুটা কম থাকে

 

বিশেষজ্ঞদের মতে, নিউমোনিয়া রোগটি টিকা দিয়ে প্রতিরোধ করা সম্ভব এবং সঠিকভাবে নির্ণয় করা গেলে স্বল্প ব্যয়ের অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে সহজেই চিকিৎসা করা যায়। কিন্তু এখনো কোটি কোটি শিশু নিউমোনিয়ার ভ্যাকসিনের আওতার বাইরে রয়েছে এবং প্রতি তিনটি শিশুর একজনের লক্ষণ দেখা দেয়া সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা পায় না। মারাত্মক নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের ক্ষেত্রে অক্সিজেন সাপোর্টও প্রয়োজন হতে পারে। সেগুলো নিশ্চিত করতে পারলে শিশুকে চূড়ান্ত বিপদ থেকে রক্ষা করা সহজ হবে।

দ্রুত রোগ নির্ণয়ে সংকট

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিউমোনিয়ার প্রতিরোধে মূল সংকট দ্রুত রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া। এ জায়গায় কমিউনিটি লেভেলে বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে। এর কারণ নির্ণয় করে যদি অ্যান্টিবায়োটিক ঠিকমতো দেওয়া যায়, তাহলে এই সংকট কাটবে। শহরে নবজাতককে মায়ের দুধ খাওয়ানোর হার গ্রামের থেকে বেশি। গ্রামের মায়েরা কম খাওয়ান।

তারা বলছেন, সব ক্ষেত্রে হয়তো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য অপেক্ষা করা সম্ভব হয় না। পরীক্ষা-নিরীক্ষারলা ফল আসার আগেই চিকিৎসা শুরু করে দিতে হবে। কারণ, বাচ্চাদের যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এটি কম হওয়ার কারণে যেকোনো সময় নিউমোনিয়া থেকে অন্য কোনো ধরনের জটিলতা, যেমন হার্ট ফেইলিউর হতে পারে। চিকিৎসক কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য পরামর্শ দেবেন। তবে সেই প্রতিবেদন হাতে আসার আগেই, লক্ষণের ওপর ভিত্তি করে, দ্রুত চিকিৎসা শুরু করতে হবে।

মায়ের দুধে নিউমোনিয়ার ঝুঁকি কমে

মায়ের বুকের দুধে শিশুর নিউমোনিয়া ঝুঁকি কমে যায় জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। তারা বলছেন, গ্রামের মায়েরা ১-২ মাস পরেই সম্পূরক খাবারে চলে যান। অন্যান্য খাবার খাওয়ান। অথচ বুকের দুধ নিশ্চিত করা গেলে শিশুর নিউমোনিয়ার ঝুঁকি অনেক কমে যায়। এ ছাড়া যদি টিকার তিনটি ডোজই দেওয়া যায়, তাহলেও নিউমোনিয়ায় মৃত্যুঝুঁকি কমে। আরেকটা হলো ঘরের ভেতর ধোঁয়া, চুলার পাশে থাকা, স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে থাকা, একটা ঘরে অনেক মানুষ একসঙ্গে থাকা এগুলো যদি কমানো যায়, বাবা-মা যদি ঘরের ভেতর ধূমপান না করেন, তাহলে নিউমোনিয়ায় মৃত্যুঝুঁকি কমে। একটা ছোট বাচ্চা ধরার আগে ভালো করে হাত ধোয়া, সর্দি-কাশির সময় নাক-মুখ আড়াল করা এসব করলে নিউমোনিয়ায় মৃত্যুঝুঁকি কমে।

এসএইচ/ক.ম