images

হেলথ

ভুয়া ডিগ্রি: জাহাঙ্গীর কবিরের সমালোচনায় খোদ চিকিৎসকরাও

নিজস্ব প্রতিবেদক

০৮ নভেম্বর ২০২৫, ১০:২২ এএম

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আলোচিত চিকিৎসক জাহাঙ্গীর কবির। অনলাইনে বিভিন্ন রোগীদের পরামর্শ দেন তিনি। পরিচিতি পান কিটো ডায়েটের পরামর্শদাতা হিসেবে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনিয়ম ও বিতর্কের সঙ্গে জড়িয়েছেন এই চিকিৎসক। অনুমোদনহীন ওষুধ বিক্রি করে জরিমানাও গুনেছেন। সম্প্রতি এফসিপিএস (চূড়ান্ত) ডিগ্রি সম্পন্ন না করেও নামের পাশে ভুয়া ডিগ্রি ব্যবহার করে চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচালনার অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। শুধু তাই নয়, দেশের চিকিৎসকদের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলে (বিএমডিসি) আবেদন ও অনুমোদন ছাড়াই চারটি ডিগ্রি ব্যবহার করারও অভিযোগ রয়েছে এই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে।

ডা. জাহাঙ্গীর কবিরের এসব কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করছেন খোদ চিকিৎসকরাই। তার বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়েছে চিকিৎসকদের সংগঠন ফাউন্ডেশন ফর ডক্টরস সেফটি, রাইটস অ্যান্ড রেসপন্সিবিলিজ (এফডিএসআর)। সম্প্রতি তাকে শোকজ করেছে বিএমডিসি। ডিগ্রি ব্যবহার করে এ নিয়ে দুবার ডা. জাহাঙ্গীর কবিরকে শোকজ করেছে চিকিৎসকদের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।

ডা. জাহাঙ্গীর কবিরকে দেওয়া শোকজ নোটিশে বলা হয়, ‘আপনি এফসিপিএস ডিগ্রি সম্পন্ন না করে নামের পাশে উক্ত ডিগ্রি লিখে চিকিৎসাকার্য পরিচালনা করছেন। এই মর্মে অত্র কাউন্সিলকে অবগত করেন অধ্যাপক আবুল বাসার মো. জামাল, সচিব, বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনস (বিসিপিএস) (ফটোকপি সংযুক্ত)। আপনি উক্ত ডিগ্রি সম্পন্ন না করে এবং বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের রেজিস্ট্রেশন ছাড়া এ ধরনের ডিগ্রি ব্যবহার স্পষ্টতই বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল আইনের পরিপন্থী ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ।’

নোটিশের বিষয়ে বিএমডিসির ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার ডা. লিয়াকত হোসেন বলেন, ‘এর আগেও আমরা তাকে শোকজ করেছিলাম। কারণ তিনি যেসব ডিগ্রি অর্জন করেননি, তা ব্যবহার করে চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। এখনকার শোকজ নোটিশ পাননি বলে তিনি দাবি করলেও আমাদের কাছে রেকর্ড আছে যে, তাকে শোকজ নোটিশ পাঠানো হয়েছে। অবশ্য এই সময়ে নোটিশ তার কাছে পৌঁছানোর কথা। তিনি যদি তা গ্রহণ না করে থাকেন বা এখনো না পৌঁছে থাকে, তার অর্থ এই নয় যে, আমরা পাঠাইনি, বরং আমরা পাঠিয়েছি।’

নোটিশের বিষয়ে ডা. জাহাঙ্গীর নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে লিখেন, ‘আমি সিম্পল এমবিবিএস আমি কোথাও এমবিবিএস ব্যতীত কোনো ডিগ্রি ব্যবহার করি না, দীর্ঘদিন ধরে আপনারা আমকে চিনেন, আমার প্রেসক্রিপশন অনেকের কাছে আছে। সেখানে শুধুই একটি ডিগ্রি এমবিবিএস কমেন্ট সেকশন এ ছবি দিয়ে দিচ্ছি। আমার মনে হয় কোথাও কোনো মিসআন্ডারেস্টিং হচ্ছে।’

গোপন নোটিশটি বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পরপর ডা. জাহাঙ্গীর কবিরের নানা সমালোচনা করেছেন খোদ চিকিৎসকরা। স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী ডা. মঈনুল ইসলাম লিখেন, ‘কিটোবাবা বিপদে।’

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের (সিএমসি) শিক্ষার্থী ইয়ামিন আব্দুল্লাহ খান লিখেছেন, ‘চীনের দুঃখ হোয়াংহু, কুমিল্লার দুঃখ গোমতি, আর সিএমসির দুঃখ অর্গানিক ... জাহাঙ্গীর।’

আরও পড়ুন

যেসব কারণে বিতর্কিত ডা. জাহাঙ্গীর কবির

আসিফ সৈকত নামে আলোচিত এই চিকিৎসক লিখেছেন, ‘উস্তাদ জাহাঙ্গীর কুব্রা’।

আরেক চিকিৎসক একেএম মহিউদ্দিন ভূঁইয়া লিখেছেন, ‘তাকে অপচিকিৎসার জন্য জাতীয় পুরস্কার প্রদান করার জোর দাবি জানাচ্ছি।’

ডা. সজীব হোসেন নামের আরেকজন লিখেন, ‘এইরকম অনেক আশেপাশে আছে। ওইগুলারেও ধরা উচিত।’

Kabir1
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচিত চিকিৎসক জাহাঙ্গীর কবির। ছবি: সংগৃহীত

সিএমসির ডা. আমিনুল ইসলাম লিখেছেন, ‘বস্তা পচা কনটেন্ট ক্রিয়েটর, ডাক্তার বলা উচিত না। সন্তোষজনক জবাব দিতে না পারলে বিএমডিসি স্থগিত করে দেওয়া উচিত।’

অনুমোদনহীন চারটি ডিগ্রি ব্যবহার

এর আগে ২০২১ সালে প্রেসক্রিপশন বা ভিজিটিং কার্ডে বিএমডিসির অনুমোদনহীন চারটি ডিগ্রি ব্যবহার করেন ডা. জাহাঙ্গীর কবির। এ বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়ে ডা. জাহাঙ্গীরকে শোকজ করে বিএমডিসি। ডিগ্রি ব্যবহারের অনুমোদন পেতে বিএমডিসিতে আবেদন না করার কথা স্বীকার করেছেন ডা. জাহাঙ্গীরও।

আইন অনুযায়ী, প্র্যাকটিস করা যেকোনো চিকিৎসককে তাদের অর্জিত ডিগ্রির সদনের কপি বিএমডিসিতে জমা দিয়ে ব্যবহারের অনুমোদন নিতে হয়। বিএমডিসি সেগুলো যাচাই করে একটি নিবন্ধন নম্বর দেয়। এরপর ডিগ্রির তথ্য বিভিন্ন জায়গায় উল্লেখ করার অনুমতি মেলে। তবে ডা. জাহাঙ্গীর কবির তার সাইনবোর্ডে, প্রেসক্রিপশনে যেসব ডিগ্রি উল্লেখ করেছেন সেগুলোর বিষয়ে কোনো আবেদনই করেননি।

ওই সময়ে ডা. জাহাঙ্গীর এমবিবিএস ছাড়াও চারটি ডিপ্লোমা ডিগ্রি ব্যবহার করছেন। এগুলো হলো ডিপ্লোমা মডিউল ইন ডায়াবেটিস (এডুকেশন ফর হেলথ), ডিপ্লোমা মডিউল ইন অ্যাস্থামা (এডুকেশন ফর হেলথ), ডিপ্লোমা মডিউল ইন সিওপিডি (এডুকেশন ফর হেলথ), স্পিরো ৩৬০ স্পাইরোমেট্রি কোর্স (ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি)। এর কোনোটিই ব্যবহারের অনুমোদন দেয়নি বিএমডিসি।

ডা. জাহাঙ্গীর কবিরের এমন কর্মকাণ্ডকে অবৈজ্ঞানিক, অসত্য, দায়িত্বজ্ঞানহীন এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে আখ্যা দিয়েছিল এফডিএসআর। সংগঠনটি বলছে, ‘আপনি যে ধরনের কর্মকাণ্ড করছেন তা চিকিৎসাবিজ্ঞানের নীতিবিরোধী ও জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। আপনি নিয়মিত বিভিন্ন চিকিৎসা ও পরামর্শ দিচ্ছেন যা চিকিৎসাবিজ্ঞানের পাঠ্যপুস্তকে বর্ণিত রোগনিরাময়ের পদ্ধতির সাথে সাংঘর্ষিক। সামাজিক মাধ্যমে নানারকম ভুল ও বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য দিচ্ছেন যা মানুষের জন্য ক্ষতিকর। চিকিৎসকদের চিকিৎসা নিয়ে যুক্তিবিবর্জিত বিষোদগার করছেন যা সাধারণ মানুষের মধ্যে অহেতুক চিকিৎসকদের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ বৃদ্ধি করছে। আপনার এই কর্মকাণ্ড ম্যালপ্র্যাকটিস বা অপচিকিৎসা ছাড়া আর কিছু নয়।’

আরও পড়ুন

এফসিপিএস ডিগ্রি জালিয়াতি: যা বললেন ডা. জাহাঙ্গীর

পরে ভুলের জন্য ক্ষমা চান ডা. জাহাঙ্গীর কবির। তিনি বলেন, আজকের পুরো বিশ্ব চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নয়ন ও বাস্তবায়নের সাথে জড়িত সকলের কাছে কৃতজ্ঞ। আমি সকলের প্রতি সম্মান রেখে বলছি, মানুষ মাত্রই ভুল হতে পারে। তাই আপনারা আমার কোনো ভুল ধরিয়ে দিলে আমি তা শুধরে নেব। নিজের ভুলকে আমি ভুল হিসেবে গ্রহণ করে তা শুধরে নেব। আর আপনাদের কাছেও আমার অনুরোধ আপনারা আমার পূর্বের ভুলগুলো ক্ষমা-সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

দুই প্রতিষ্ঠানকে সাড়ে ৪ লাখ টাকা জরিমানা

অনুমোদনহীন অবৈধ ওষুধ বিক্রির অপরাধে ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে আলোচিত চিকিৎসক জাহাঙ্গীর কবির পরিচালিত দুটি প্রতিষ্ঠানকে সাড়ে চার লাখ টাকা জরিমানা করেছিল ভোক্তা অধিদফতর। অভিযানের নেতৃত্ব দেন অধিদফতরের ঢাকা জেলা কার্যালয়ের অফিস প্রধান ও সহকারী পরিচালক আব্দুল জব্বার মন্ডল।

এই কর্মকর্তা বলেন, বিভিন্ন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আফতাব নগর হেলথ রেভুলেশন নামের প্রতিষ্ঠানে অভিযান পরিচালনা করি। এখানে ডা. জাহাঙ্গীর কবিরের চেম্বার রয়েছে। অভিযানকালে অনুমোদনহীন ওষুধ বিক্রির অপরাধে আল্টিমেট অর্গানিক লাইফকে সাড়ে তিন লাখ এবং অবৈধভাবে ওষুধ আমদানি করে সরবরাহ ও বাজারজাত করার অপরাধে ইন-মোশন ট্রেডিং ইন্টারন্যাশনালকে এক লাখ টাকাসহ মোট সাড়ে ৪ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

অধিদফতর জানায়, ডা. জাহাঙ্গীর কবিরের গোডাউনে ‘অর্গানিকো কেয়ার’ নামে একটি ব্রান্ডের ঘি প্যাকেজিং হচ্ছিল। বোতলের গায়ে ঘি উৎপাদন, বাজারজাত ও মোড়কজাতের ঠিকানা দেওয়া আছে, গাছা, জয়দেবপুর, গাজীপুরে। তবে পণ্যটি প্যাকেজিং হচ্ছে রাজধানীর আফতাবনগরে, যা আইনত দণ্ডনীয়। যেহেতু গোডাউনটি জাহাঙ্গীর কবিরের, সেহেতু জরিমানা জাহাঙ্গীর কবিরকেই করা হয়েছে।

Kabir2
তার বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগও আছে। ছবি: সংগৃহীত

সেই সময় ডা. জাহাঙ্গীর কবির বলেন, ‘প্যাকেজিংয়ের কারণে জরিমানা করা হয়েছে এটা আমি মেনে নিয়েছি। এটা আইনেই সিদ্ধ। তবে আমার নাম জড়িয়ে যেভাবে বিভিন্ন মাধ্যমে সংবাদ প্রচার করা হচ্ছে এটা ঠিক হচ্ছে না’

জাহাঙ্গীর কবির যেভাবে আলোচনায়

প্রচলিত ধারার চিকিৎসার তুলনায় একটু আলাদা ধরনের চিকিৎসা পরামর্শ দিয়ে গত কয়েক বছরে আলোচিত হয়ে উঠেছেন জাহাঙ্গীর কবির। তার ইউটিউব পাতায় যেসব ভিডিও আপলোড করা হয়েছে, সেখানে ওষুধ ছাড়াই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ, ওজন কমানো, জীবনধারা পরিবর্তন, সেক্স হরমোন বাড়ানোর উপায় ইত্যাদি পরামর্শ রয়েছে।

আরও পড়ুন

পাস না করেই নামের সঙ্গে এফসিপিএস, জাহাঙ্গীর কবীরকে শোকজ

এর আগে করোনা মহামারিকালে ‘রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় নেই’ এমন শিরোনামে একটি ভিডিও প্রকাশ করেছিলেন ডা. জাহাঙ্গীর কবির। নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক ও ইউটিউব দুই প্লাটফর্মেই এই ভিডিও সেই সময় প্রকাশ করা হয়েছিল। প্রায় দুই ঘণ্টার ওই ভিডিওর শেষ দিকে ড. জাহাঙ্গীর কবির আলোচনার প্রাসঙ্গিকতায় কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন নিয়ে বিভিন্ন তথ্য ও ব্যাখ্যা দেন।

সেই সময় ড. জাহাঙ্গীর কবিরের ওই আলোচনাটি ভ্যাকসিনবিরোধী ষড়যন্ত্র-তত্ত্বের পক্ষে প্রচলিত কিছু ভ্রান্ত ধ্যান-ধারণাকে সমর্থন করায় বিপুলসংখ্যক ফলোয়ার ও অ্যান্টি-ভ্যাক্সিন চিন্তাধারার গোষ্ঠীর মাধ্যমে ভাইরাল হয়। এরপর সেই ভিডিওতে উপস্থাপিত ভ্যাকসিনসংক্রান্ত তথ্যগুলো বিভিন্ন মাধ্যম ছড়িয়ে পড়লে সমালোচিত হতে হয় এই চিকিৎসককে। যদিও পরবর্তীকালে সমালোচনার মুখে সেই ভিডিও ডিলিট করার পাশাপাশি নিজের অবস্থানও ব্যাখ্যা করেছিলেন তিনি। সেই সঙ্গে দাবি করেছিলেন- তার সেই ভিডিওটি উদ্দেশ্যমূলকভাবে আংশিক কেটে প্রচার করে বিভ্রান্তি তৈরি করা হয়েছে এবং তার সেই ভিডিওর উদ্দেশ্য ছিল শুধু ভ্যাকসিনের ওপর নির্ভর করে কোভিড-১৯ এর আক্রমণ প্রতিরোধ করা যাবে না- এটা বোঝানো।

এসব বিষয়ে জানতে ঢাকা মেইলের পক্ষ থেকে ডা. জাহাঙ্গীর কবিরের সঙ্গে পরপর দুদিন যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। একবার তিনি ফোন রিসিভ করলেও কথা বলেননি।

এসএইচ/জেবি