সাখাওয়াত হোসাইন
২৩ আগস্ট ২০২৫, ১০:১৩ পিএম
প্রতি বছরের মতো এবারও পাবর্ত্য চট্টগ্রামসহ বেশ কয়েকটি জেলায় বাড়ছে মশাবাহিত রোগ ম্যালেরিয়ার প্রকোপ। এর মধ্যে বেশি উদ্বেগ বাড়াচ্ছে রাঙামাটি ও কক্সবাজারে। সেইসঙ্গে আক্রান্তের দিক থেকে পিছিয়ে নেই খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান।
ম্যালেরিয়ার আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে পাবর্ত্য অঞ্চলসহ বেশ কয়েকটি জেলায়। ব্যাপকহারে ম্যালেরিয়ার আক্রান্ত হওয়ায় চিন্তার ভাঁজ পড়েছে স্বাস্থ্য বিভাগের কপালে। যাতায়াত সুবিধা না থাকা ও দুর্গম এলাকা হওয়ায় যথাযথ সেবাও নিতে পারছেন না স্থানীয়রা। সেইসঙ্গে চিকিৎসায় রয়েছে অপ্রতুলতা।
আরও পড়ুন: বাড়ছে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ, প্রয়োজন বাড়তি সচেতনতা
সিভিল সার্জন অফিসের তথ্য অনুযায়ী, অন্যান্য সময়ের তুলনায় রাঙামাটি জেলায় গত দুই মাসে ম্যালেরিয়া আক্রান্ত রোগী বেড়েছে আট থেকে নয় গুণ। জুলাই মাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৮৬৪ জন আর জুন মাসে ৯৮৭ জন। আর এবছরে সবচেয়ে কম আক্রান্ত হয়েছে ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে, এই দুই মাসে আক্রান্ত হয়েছেন ১১০ জন।
এছাড়া কক্সবাজার জেলায় গত জুন মাসে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পাঁচ রোহিঙ্গাসহ ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে। গত ছয় মাসে (জুন পর্যন্ত) কক্সবাজার জেলায় ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন ৪৩১ জন। সমানতালে আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে। এর মধ্যে খাগড়াছড়িতে রোগ শনাক্তে দেরি হওয়ায় সিবিয়ার ম্যালেরিয়ার আক্রান্ত হয়ে রুবেল হোসেন নামে এক তরুণের মৃত্যু হয়েছে।
আরও পড়ুন: শয্যা বাড়ছে ৯ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের
সংশ্লিষ্টরা জানান, বর্ষা এলেই পাবর্ত্য চট্টগ্রামসহ বেশ কয়েকটির জেলার দুর্গম এলাকায় সুপেয় পানির সংকটের পাশাপাশি বাড়ে ম্যালেরিয়ার উপদ্রব। পাহাড় ধুয়ে ঝিরি বয়ে আসা রোগ জীবাণুযুক্ত পানি পান করে বিভিন্ন রোগের পাশাপাশি ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হন। বৃষ্টির পানিতে পাহাড় স্যাঁতস্যাঁতে থাকায় ম্যালেরিয়া জীবাণুবাহী আনোফেলিশ মশার উপদ্রবও বেড়ে যায়। ফলে একবার এ দুই রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। প্রতি বছর মে থেকে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর পর্যন্ত অনেক মানুষ আক্রান্ত হন ম্যালেরিয়ায়। আবার কারও কারও মৃত্যু হয়।
এরমধ্যে পাহাড়ি দুর্গম এলাকার বাসিন্দাদের মধ্য সবচেয়ে বেশি আতঙ্ক ছড়িয়েছে ম্যালেরিয়া। বিশেষ করে দুর্গম সীমান্ত অঞ্চলের রাঙামাটি জেলার চার উপজেলা বাঘাইছড়ি, বিলাইছড়ি, জুরাছড়ি ও বরকলের বাসিন্দাদের জন্য এটিকে মোকাবিলা করা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ এ বছর জেলায় আক্রান্ত রোগীর ৮৩ শতাংশের বসবাস এই চার উপজেলায়।
আরও পড়ুন: অগ্নিদগ্ধ রোগী সংকটে: প্রকল্পে অগ্রগতি নেই, খরচ বাড়ছে
স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ব্র্যাক বিনামূল্যে মশারি বিতরণ করে থাকে তিন বছর পরপর। জেলায় ২০২৩ সালে পাঁচ লাখ ৭৪ হাজারের কিছু বেশি মশারি বিতরণ করা হয়েছিল। এরপর থেকে আর বিতরণ হয়নি। স্থানীয় বাসিন্দারা রাতে ঘুমানোর সময় মশারি টাঙিয়ে রাখলেও দিনে জুমের মাঠে কাজ করার সময় মশা কামড়ায়। তখনই মূলত ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন তারা। এ বছর ইউএসএইডের ফান্ডিং বন্ধ থাকায় সীমিত পরিসরে চলছে ম্যালেরিয়া প্রতিরোধ কর্মসূচি। যার ফলে উদ্বেগও বাড়ছে।
দুর্গম অঞ্চলে নাজুক স্বাস্থ্যব্যবস্থা
দুর্গম অঞ্চল হওয়ায় নাজুক পরিস্থিতিতে রয়েছে যোগাযোগ ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা। সেইসঙ্গে হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) না থাকা এবং প্রয়োজনের তুলনায় বিশেষ করে সরকারি স্বাস্থ্যকর্মীর ঘাটতিতে ম্যালেরিয়া বেড়ে যাচ্ছে। এছাড়া রোগটি নিয়ে দুর্গম পাহাড়ে সচেতনতার অভাবও রয়েছে। যদিও সরকারের লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে দেশ থেকে ম্যালেরিয়া নির্মূল করা। কিন্তু সেটি সম্ভব হবে না বলছেন স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা। দুর্গম এলাকার বাসিন্দা হওয়ায় দ্রুত রোগ নির্ণয় করতে না পারায় বাড়ছে জটিলতা।
আরও পড়ুন: মায়ের দুধ থেকে বঞ্চিত ৪৫ শতাংশ শিশু, বাড়ছে ঝুঁকি
স্বাস্থ্যকর্মীরা বলেন, আগে শুধু বর্ষা মৌসুমে ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা যেত। এখন সারা বছর রোগী পাওয়া যাচ্ছে। আমরা সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে এই রোগ প্রতিরোধে কাজ করলেও ভারতের ওই অংশে সেভাবে কাজ হয় না। ফলে ওই এলাকার মানুষ ও মশার কারণে রোগ প্রতিরোধ করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
অসচেতনতায় বাড়ছে আক্রান্ত রোগী
দুর্গম অঞ্চলে অসচেতনতা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাবে বাড়ছে ম্যালেরিয়া আক্রান্ত রোগী। বেশির ভাগ মানুষই মানছেন না স্বাস্থ্যবিধি, রাতে ঘুমানোর সময়ও ঠিকমতো ব্যবহার করছেন না মশারি। এবিষয়ে কক্সবাজার জেলা সিভিল সার্জন মোহাম্মদুল হক ঢাকা মেইলকে বলেন, সরকারি হাসপাতাল ও কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। পাশাপাশি রোগ নির্ণয় করে দ্রুত আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসা গ্রহণের জন্য প্রচার-প্রচারণা, ডেঙ্গু-ম্যালেরিয়াবিষয়ক সচেতনতা ও সামাজিক উদ্বুদ্ধকরণ কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।
আরও পড়ুন: দশকের পর দশক ধরে অকার্যকর জরুরি স্বাস্থ্যসেবা
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডেঙ্গু ও ম্যালেরিয়ার প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি মশার প্রজনন স্থান ধ্বংস করতে কাজ করা হচ্ছে। এছাড়া নালা-নর্দমা পরিষ্কার এবং ওষুধ ছিটানোর কার্যক্রম নিয়মিত রয়েছে।
কক্সবাজার হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মং টিং ঞো ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘ম্যালেরিয়া রোগীর তথ্য সংগ্রহ করে দেখা যায়, বেশির ভাগই পাশের পার্বত্য এলাকায় গিয়ে আক্রান্ত হয়েছে। মারা যাওয়া রোহিঙ্গারাও আক্রান্ত হওয়ার আগে রাঙামাটি ও বান্দরবানে অবস্থান করছিল। আক্রান্ত হওয়ার পর তারা যথাসময়ে চিকিৎসা নেয়নি। অনেকটা শেষ সময়ে এসে হাসপাতালে ভর্তি হয়।’
স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, দুর্গম এলাকা হওয়ায় এই জেলা থেকে ম্যালেরিয়া পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব হচ্ছে না। এ কারণে ২০৩০ সালের মধ্যে দেশ থেকে ম্যালেরিয়া নির্মূলের সরকারের যে লক্ষ্য অর্জন, তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। সাধারণত এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত এই রোগের প্রকোপ থাকে জেলাজুড়ে।
আরও পড়ুন: ঢাকার ৯৮ শতাংশ শিশুর রক্তে সিসার উপস্থিতি: গবেষণা
জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল কর্মসূচির সার্ভিল্যান্স মেডিকেল অফিসার ডা. বিশ্ব জ্যোতি চাকমা ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘দেশের ১৩টা জেলায় ম্যালেরিয়া প্রকোপ থাকলেও তিন পার্বত্য জেলায় সবচেয়ে বেশি। সারাদেশের ৯০-৯৫ ভাগ রোগীই এই তিন পার্বত্য জেলায়। তাই আমরা যারা পার্বত্য জেলায় বসবাস করি তারা সবাই ম্যালেরিয়া ঝুঁকিতে আছি। ম্যালেরিয়া প্রতিরোধের উপায় ও এ ব্যাপারে মানুষকে সচেতন করতে কাজ করছি। পুরো জেলায় আমাদের কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।’
প্রতিরোধে করণীয়
সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা জানান, ম্যালেরিয়ার ঝুঁকি এড়াতে মশার উৎসস্থাল ধ্বংস করা জরুরি। যখনই কারও জ্বর হয়, দ্রুত রক্ত পরীক্ষা করাতে হবে। উপজেলা স্বাস্থ্যা কমপ্লেক্স ও কমিউনিটি ক্লিনিকে ম্যালেরিয়ার জীবাণু পরীক্ষা করা যাবে। রক্ত পরীক্ষা ও ওষুধ বিনামূল্যে দেওয়া হয়। মশারি বিতরণ বাড়ানো দরকার। জনসাধারণকে সচেতন করতে হবে, যাতে সিবিয়ার ম্যালেরিয়ায় কেউ আক্রান্ত না হয়। সে ক্ষেত্রে রোগী বাঁচানো যাবে না। যেহেতু পাহাড়ি এলাকা অনেকে কাজে বের হয় সে ক্ষেত্রে মশা যাতে না কামড়ায় খেয়াল রাখতে হবে। মশারি ব্যবহার করতে হবে।
আরও পড়ুন: ঘরে ঘরে জ্বরের প্রকোপ, নানা উপসর্গে কাবু আক্রান্তরা
জানতে চাইলে রাঙামাটি জেলার ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. অমিত দে ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘এই সময়টাতে ম্যালেরিয়ার সময়। সাধারণ জুন মাস থেকে ম্যালেরিয়া রোগী বাড়তে থাকে এবং সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রকোপ থাকে। এরপর আস্তে আস্তে কমতে থাকে। গত বছরের তুলনায় এবছর ম্যালেরিয়া রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। যাদের সন্দেহ হয়, তাদের ম্যালেরিয়া পরীক্ষা করা হয়। উন্নয়ন সংস্থা হিসেবে ব্র্যাক আমাদের সঙ্গে কাজ করে। ইউএসএইডের ফান্ডিং বন্ধ থাকায় উন্নয়ন সংস্থার কার্যক্রম কিছুটা বন্ধ। তাই সরকারিভাবেই করতে হচ্ছে। রোগীদের যথাযথ সেবা দেওয়ার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’
এবিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের ম্যালেরিয়া প্রকল্পের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. শ্যামল কুমার দাশ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামসহ কয়েকটি জেলায় ম্যালেরিয়ার হটস্পট। বৃষ্টির সময়ে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ বাড়ে। সরকারের পক্ষ থেকে মশারি দেওয়া হয়েছে। ম্যালেরিয়ার জরিপ কাজ এবং সচেতনতা প্রোগ্রাম চলমান রয়েছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা ঠিক মতো করা হচ্ছে। সরকারিভাবে ২৫টি ল্যাব এবং বেসরকারি পর্যায়ে ৩০টি ল্যাব রয়েছে। পর্যাপ্ত পরিমাণে ওষুধ রয়েছে। এছাড়া ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে নানা কার্যক্রম চলমান রয়েছে।’
এসএইচ/জেবি