images

হেলথ

নার্সদের একাংশের অপকর্মে বিপর্যস্ত স্বাস্থ্যসেবা

মাহাবুল ইসলাম

২১ এপ্রিল ২০২৫, ০৯:৫২ পিএম

জান্নাতুল ফেরদাউস। নার্স হিসেবে কর্মরত রয়েছেন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে। দেখতে সুন্দরী ও কথায় চটপটে এই নার্সের সঙ্গে রোগীদের কোনো সম্পর্ক নেই। এক বছরে ২০৩ দিনই কর্মস্থলে অনুপস্থিত তিনি। মাত্র ৬২ দিন অফিস করেও বাজিমাত করে যাচ্ছেন সুযোগ-সুবিধায়। যে কয়দিন এসেছেন তাকে নার্সিং সুপারিনটেনডেন্ট ও হাসপাতাল পরিচালকের রুম ছাড়া ওয়ার্ডে দেখা যায়নি- এমন অভিযোগ সাধারণ নার্সদের। আর প্রতিনিয়তই কর্তাদের রুমে সাধারণ নার্সদের ডেকে নিয়ে মানসিক নির্যাতনসহ চাঁদাবাজি ও ইন্টার্ন বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। প্রতিবেদকের অনুসন্ধানেও এই অভিযোগের সত্যতা উঠে আসে।

শুধু এই জান্নাতুল ফেরদাউস নন; দেশের স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নার্সদের একাংশের অপকর্ম যেন এখন ওপেন সিক্রেট। মূলত প্রতিষ্ঠানপ্রধানকে ম্যানেজ করে তারা এই অপকর্ম চালাচ্ছে। এতে একদিকে যেমন সাধারণ নার্সরা কোণঠাসা হয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছে, তেমনি অপেশাদারি আচরণে বিপাকে পড়ছে সাধারণ রোগীরাও। এসব দেখার যেন কেউ নেই!

অনুসন্ধানের তথ্য বলছে, পেশাগত দায়িত্ব পালনের চেয়ে অপেশাদারি কর্মকাণ্ডে বেশি জড়িয়ে পড়ছে নার্সদের একটি অংশ। অনেকে বছরের পর বছর প্রতিষ্ঠানে অনুপস্থিত থেকেও বেতন-ভাতা তুলছে। অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানে হাজিরা দিয়েই ‘নার্সগিরি’ দেখিয়ে নিজের ব্যক্তিগত কাজে চলে যাচ্ছে অনেকেই। এছাড়া সেবা নিতে এসে নার্সদের দুর্ব্যবহারও কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।

আরও পড়ুন

সুফল মিলছে না দেড় হাজার কোটি টাকার বিশ্বমানের হাসপাতালটির

রাজধানীর বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএমইউ) মায়ের চিকিৎসার জন্য এসেছিলেন গণমাধ্যমকর্মী ইমরান মাহফুজ। হাসপাতালে নার্সদের দৌরাত্ম্য দেখে বিস্ময় প্রকাশ করে তিনি বলেন, রোগীদের সঙ্গে নার্সদের একটা গভীর সুসর্ম্পক হওয়ার কথা। কিন্তু আমাদের চিকিৎসাসেবায় সেটি এখনো পরিলক্ষিত হচ্ছে না। নার্সদের অপেশাদারি আচরণে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে সাধারণ রোগীদের। তাদের বারবার ডাকলেও তারা সাড়া দেন না। ফোন নিয়েই পড়ে থাকেন।

Nars2
অন্যদের সঙ্গে অভিযুক্ত নার্স জান্নাত (সর্ব বামে লাল ওড়না)। ছবি: সংগৃহীত

 রোগী নিবারা বেগম বলেন, ‘আমি কিছুদিন আগে টানা ১৫ দিন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। মাঝেমধ্যে দু-একজন নার্সকে ভালো পেয়েছি। কিন্তু বাকিদের ডাকলেও আসে না। অপারেশনের রোগী তাও নিজে হেঁটে গিয়ে কথা বলি। কিন্তু ফোন নিয়ে এত মেতে থাকে, ঘুরে তাকানোর সময়ও যেন তাদের নেই! উল্টো আমাদেরই বাজে কথা শোনায়।’

আরেক রোগী ইব্রাহিম হোসন বলেন, ‘মানুষ যন্ত্রণায় ছটফট করে। ওষুধ দেওয়ার জন্য ডাকলে সাড়া দেয় অনেক দেরিতে। ফোন টেপা নাকি তাদের গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আর এত বাজে আচরণ অন্য কোথাও দেখা যায় না। কর্মস্থলে থাকার সময় নার্সদের ফোন ব্যবহার করা নিষিদ্ধ করা উচিত।’

শুধু রোগীদের এই দুর্ভোগই নয়, বছরের পর বছর অনুপস্থিত থেকেও বেতন-ভাতা উত্তোলনে সরকারের বিপুল অঙ্কের ক্ষতি হচ্ছে। আর এই অপকর্মে ইন্ধন দিচ্ছেন খোদ প্রতিষ্ঠানপ্রধানরা। সম্প্রতি মাসের পর মাস কর্মস্থলে অনুপস্থিত থেকেও বেতন নেওয়ার অভিযোগে সিলেটের ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অনুসন্ধানে যায় দুদক।

আরও পড়ুন

কেমন আছেন বাংলাদেশের নার্সরা?

পরে নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদফতরের নির্দেশে অনুপস্থিতির একটি তালিকা ঢাকায় পাঠায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। সেখানে ১৬ জন নার্স অনুপস্থিত থেকেও বেতন-ভাতা তুলে নেওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। এছাড়া ছুটি ছাড়াই আরও ২৯ জন নার্স অনুপস্থিত থাকার বিষয়টিও উঠে আসে। বিষয়টি সম্প্রতি ধরা পড়ার পর  ১৬ জনকে প্রতারণার মাধ্যমে উত্তোলনকৃত বেতন-ভাতার টাকা ফিরিয়ে দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। যারা প্রতারণার মাধ্যমে এক কোটি ৭০ লাখ টাকা তুলে নিয়েছিলেন।

এর আগে, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের দুই নার্স ছুটি নিয়ে লাপাত্তা হয়ে যান। একজন ১৪ দিনের ছুটি নিয়ে এক বছর সাত মাস ধরে হাসপাতালে অনুপস্থিত। আরেকজন ৪৫ দিনের ছুটি নিয়ে নয় মাস ধরে উধাও। পরবর্তী সময়ে গণমাধ্যমে সংবাদ হওয়ার পর তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

রামেক হাসপাতালের অনিয়মের বিষয়ে জানতে পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনালের শামীম আহম্মদের মুঠোফোনে একাধিক দিন কল করা হলে ব্যস্ততার অজুহাতে এ নিয়ে কথা বলতে চাননি তিনি।

Nars3
সম্প্রতি সিলেটে হাসপাতালে অভিযান চালায় দুদক। ছবি: সংগৃহীত

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নার্স নেত্রী ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘দেশের অনেক প্রতিষ্ঠানেই এই ‘নার্সগিরি’র চর্চা ভয়ংকর আকার ধারণ করছে। সাধারণ নার্সরা এর শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়তই। কিন্তু প্রকাশ্যে এসে তারা প্রতিবাদ করতে পারে না। কারণ অতীতে যারাই প্রতিবাদ করেছে, তাদেরই নানাভাবে হেনস্তা করা হয়েছে। অনেক হাসপাতালেই কর্তা ব্যক্তিদের শক্তিশালী সিন্ডিকেট আছে। তাদের সঙ্গী হয়ে কাজ করে এক শ্রেণির নার্স অবৈধ সুবিধা হাসিলে ব্যস্ত। আর ডিজিটাল হাজিরা সিট এক ধরনের আইওয়াশের মতো। দুর্নীতি ধরার মতো আধুনিকায়ন এখনো হয়নি। প্রতিষ্ঠানপ্রধান চাইলেই যা খুশি করতে পারছেন। এটার সংস্কার এখন জরুরি।

আরও পড়ুন

কষ্টে ভরা নার্সদের জীবন

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদফতরের একাধিক কর্মকর্তা জানান, এই প্রতারণার সঙ্গে ওই নার্স যে প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন, সে প্রতিষ্ঠানের কর্তাদের একটা জোগসাজস আছে। এখন ডিজিটাল সিস্টেমে হাজিরা হয়। প্রতিষ্ঠান প্রধান জানেন না এমনটা হওয়ার কথা না। কিন্তু তারা জানার পরেও বিষয়টি লুকানোতে ব্যতিব্যস্ত থাকেন। এইখানে নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদফতরের সরাসরি হস্তক্ষেপের সুযোগ থাকে না। প্রতিষ্ঠানপ্রধান অভিযোগ দিলে তখন আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া যায়।

এ বিষয়ে নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদফতরের পরিচালক (শিক্ষা ও শৃংখলা) মোসাম্মৎ মঞ্জু আখতারের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘এবিষয়ে গণমাধ্যমে আমি কোনো কথা বলতে পারব না। মহাপরিচালকের অনুমতি লাগবে।’

আর মহাপরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. আনোয়ার হোছাইন আকন্দের (যুগ্মসচিব) ফোন নম্বরে কল করা হলে নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়। একারণে তার বক্তব্যও পাওয়া যায়নি।

এবিষয়ে স্বাস্থ্য বিভাগ ও অধিদফতরের একাধিক সিনিয়র কর্তাকে ফোন করা হলেও রিসিভ না করায় বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

এমআই/জেবি