নিজস্ব প্রতিবেদক
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৯:০৯ পিএম
রাজধানীর ল্যাব-এইড হাসপাতালে এন্ডোস্কোপি করাতে গিয়ে কার্ডিক অ্যারেস্টে রাহিদ রেজা (৩১) নামে এক রোগীর মৃত্যু হয়েছে। রোগীর পরিবারের অভিযোগ, চিকিৎসক তার সব রিপোর্ট ঠিকভাবে না দেখেই জেনারেল অ্যানেস্থেশিয়া প্রয়োগ করেছেন। এতে তার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়েছে। তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট অবস্থায় রোগীকে পেয়েছে। যথাসাধ্য চেষ্টা করার পরেও রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি।
রাহিদ রেজা নামে ওই রোগী রাজধানীর স্টার্টিক ইঞ্জিনিয়ারিং নামক একটি প্রতিষ্ঠানে প্রোডাক্ট ম্যানেজার ও আইটি কনসালটেন্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তার স্ত্রী ও তিন বছর বয়সী কন্যা শিশু রয়েছে। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশনের প্রধান অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীলের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তার অধীনেই রোগী এন্ডোস্কোপি করা হয়। পরে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হলে তাকে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাত আড়াইটাই ল্যাব-এইডের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় সোমবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) সকালে তার মৃত্যু হয়।
রোগীর স্বজনদের অভিযোগ, রাহিদ রেজা অবস্টাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়াসহ নানা রোগে ভুগছিলেন। তারা কোনো রিপোর্টই স্বাভাবিক ছিল না। অধ্যাপক স্বপ্নীল তার রিপোর্ট ভালোভাবে না দেখেই তাকে এন্ডোস্কোপি করাতে বলেন। সেখানে তাকে জেনারেল অ্যানেস্থিসিয়া দেওয়া হয়। এন্ডোস্কোপি করার পর তাকে পর্যাপ্ত সময় অবজারভেশনে না রেখেই বেডে দিয়ে দেওয়া হয়। পরে তার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফারহান ইসলাম নামে রোগীর এক স্বজন ঢাকা মেইলকে বলেন, রাহিদ রেজা ল্যাব এইড হাসপাতালের ধানমন্ডি শাখায় অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীলের তত্ত্বাবধানে এন্ডোস্কোপি করাতে গিয়েছিল। গত বৃহস্পতিবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) ছয়টার সময় এন্ডোস্কোপি করাতে হাসাপাতালে যান ওই রোগী। তবে অধ্যাপক মামুন আল মাহতাব দেরিতে আসায় রাত আনুমানিক ১০টার পর তাকে এন্ডোস্কোপি করানোর জন্য নেওয়া হয়। তিনি মোটাসোটা মানুষ ছিলেন। তার মধ্যে অবস্টাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া ছিল। চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার আগে করানো পরীক্ষা অনুযায়ী তার প্রায় সব রিপোর্টই অস্বাভাবিক ছিল। পরবর্তী সময়ে কথা বলা চিকিৎসদের বক্তব্য অনুযায়ী তিনি স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করলেও ইনজেক্টেবল বা জেনারেল অ্যানেস্থেশিয়া দেওয়া অবস্থায় ছিলেন না রোগী।
তিনি আরও বলেন, এন্ডোস্কোপি জন্য চিকিৎসক তার রিপোর্টগুলো ভালো করে দেখেনি। তারা তাকে জেনারেল অ্যানেস্থেসিয়া দিয়েছিলেন। এরপর তার এন্ডোস্কোপিও করা হয়। ওখানে রোগীদের অনেক চাপ ছিল, ফলে প্রপার প্রটোকল মেইনটেইন করা হয়নি বলে আমাদের বিশ্বাস। তারা এন্ডোস্কোপির পর তাকে মনিটরিং না করে বেডে দিয়ে দিয়েছিলেন। অ্যানেস্থেনিয়া প্রয়োগের পর রাত ১১টা ১৫ মিনিটে তার এন্ডোস্কোপি করা হয়। বেডে দেওয়ার পর সেখানে প্রায় ঘণ্টাখানেক তাকে রেখে দেওয়া হয়। কারণ তার জ্ঞান ফিরছিল না। সেখানেই তার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়। পরে তাকে সাতবার সিপিআর দেওয়া হলে তিনি রিভাইভ করেন। এর পর সাথে সাথে তাকে ল্যাব-এইডের আইসিইউতে নেওয়া হয়। তখন আনুমানিক রাত দুইটা বাজে। সেখানে তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। ওইদিন রাত থেকে তিনি আইসিইউতে ছিলেন। আজ সকালে চিকিৎসকরা তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে মৃত ঘোষণা করে।
বিলের বিষয়ে জানতে চাইলে ফারহান ইসলাম বলেন, হাসপাতালে ঠিক কত বিল এসেছিল, তার সঠিক এমাউন্টটি আমার জানা নেই। আর ল্যাবএইড কর্তৃপক্ষ রোগীর অবস্থা বিবেচনা করে আমাদের জন্য চিকিৎসকের বিষয়টি ওপেন করে দিয়েছিল। তাদের ভাষ্য ছিল, আপনারা আপনাদের পছন্দমতো যাকে ইচ্ছা নিয়ে আসেন। ফলে বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আমাদের নিজস্ব ছিল।
অভিযোগ ও আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ প্রসঙ্গে রোগীর এই স্বজন বলেন, অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব তার অবহেলার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। যে অ্যানেস্থিশিয়া প্রয়োগ করেছিল তার বিষয়ে আমরা এখনো কোনো কিছু জানি না। তবে পরিবারের পক্ষ থেকে ওই চিকিৎসক ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে দায়ী মনে করা হচ্ছে। মামলাসহ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
‘রোগীকে বাঁচানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়েছে’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ল্যাব-এইড হাসপাতালের জনসংযোগ কর্মকর্তা চৌধুরী মেহের-এ-খোদা বলেন, আমরা রোগীকে কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের পর পেয়েছি। এন্ডোস্কোপি করানোর পর রোগীর কার্ডিয়াক এরেস্ট হয়। এন্ডোস্কোপির সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে হয়েছে। যে অ্যানেস্থিওলজিস্ট অ্যানেস্থেসিয়া দিয়েছেন তিনি ওই চিকিৎসকের ব্যক্তিগত অ্যানেস্থিওলজিস্ট। তিনি আমাদের হাসপাতালের কেউ নন।
ল্যাব এইডে চিকিৎসা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কার্ডিয়াক অ্যরেস্টের পর আমরা তাকে পেয়েছি। এরপর সরাসরি তাকে আইসিইউতে নেওয়া হয়। তখনই রোগী ভ্যান্টিলেশনের চলে গেছেন। আমরা আসার সাথে সাথে তাকে মেকানিক্যাল ভ্যান্টিলেশনে দিয়েছি। আমরা ৭২ ঘণ্টা চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখজনকভাবে তিনি মারা গেছেন। আমরা বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত আনুমানিক আড়াইটা-তিনটার দিকে তাকে পেয়েছি। শনিবার আমরা ছয় সদস্যের একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করেছিলাম। সেখানে একজন করে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, গ্যাস্ট্রোএন্টোলজিস্ট, পালমোলজিস্ট, নেফ্রোলজিস্ট, নিউরোলজিস্ট এবং আইসিইউর চিকিৎসক ছিলেন। এই ছয়জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তাকে চিকিৎসা দিয়েছেন। তারা রোগীর পরিবারকে সম্পূর্ণ পরিস্থিতি জানিয়েছেন। এরপর আজ সকালে রোগী মারা গেছেন।
বিল ও অভিযোগ প্রসঙ্গে চৌধুরী মেহের-এ-খোদা বলেন, রোগীর পরিবার আমাদের কাছে লিখিত বা মৌখিক কোনো অভিযোগ করেননি। তারা লাশ নিয়ে যাওয়ার সময়ও বলেছেন, হাসপাতালের ওপর তাদের ক্ষোভ নেই। তারা হাসপাতালের সেবায় সন্তুষ্ট। তারা সম্পূর্ণ বিল দিয়ে যাননি। আমরাও তাদের কোনো চাপ দিইনি। কারণ, আমরা তাকে যে অবস্থায় পেয়েছিলাম তার কোনো উন্নতি আমাদের এখানে থাকাকালীন হয়নি। আমরা মানবিক দিক বিবেচনা করেছি।
এমএইচ/জেবি