images

হেলথ

রিং নিয়ে অস্থিরতা কাটবে কবে?

মাহফুজ উল্লাহ হিমু

৩০ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৯:৩০ পিএম

বাংলাদেশে হৃদরোগের চিকিৎসায় সর্বাধিক ব্যবহৃত পদ্ধতি হচ্ছে স্টেন্ট বা রিং পরানো। কারো হৃদপিন্ডে রক্ত সঞ্চালনে ব্লক বা বাধার সৃষ্টি হলে চিকিৎসকের পরামর্শে এক বা একাধিক রিং পরানো হয়। এটি হৃদরোগের চিকিৎসায় বহুল ব্যবহৃত ও অতিপ্রয়োজনীয় পদ্ধতি। তবে ব্যয়বহুল এ চিকিৎসা পদ্ধতিতে ব্যবহৃত রিংয়ের দাম নিয়ে সাধারণ মানুষের অভিযোগ রয়েছে। পার্শ্ববর্তী ভারতসহ অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে রিংয়ের দাম অত্যন্ত বেশি বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে এর দাম কমাতে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি এক ধরনের চাপ রয়েছে।

বাংলাদেশে হৃদরোগের রিং ২৭টি কোম্পানির মাধ্যমে ইউরোপ-আমেরিকা থেকে আমদানি করা হয়। এরমধ্যে ২৪টি ইউরোপিয়ান ও ৩টি আমেরিকান। আর ঔষুধ প্রশাসন অধিদফতর আমদানি খরচ, মার্কেটিং, ডাক্তারদের প্রশিক্ষণ ও প্রফিট বিবেচনায় মার্কআপ ফর্মুলার মাধ্যমে কেনা মূল্যের চেয়ে ৪৩ শতাংশ বেশি রেখে দাম নির্ধারণ করে থাকে। চলতি বছরে একাধিকবার সরকারি প্রতিষ্ঠানটি দাম নির্ধারণ করেছে। সর্বশেষ গত ১৬ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হওয়া নতুন দাম নিয়ে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে ইউরোপীয় আমদানিকারকদের মধ্যে। এর প্রতিক্রিয়ায় ১২ দিন ধরে ধর্মঘট পালন করছে কোম্পানিগুলো। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছে সাধারণ রোগীরা।

  • নতুন দাম নিয়ে আমদানিকারকদের ধর্মঘট
  • বাংলাদেশে রিংয়ের দাম অনেক বেশি
  • চরম ভোগান্তিতে রোগীরা
  • অর্ধেকে নেমেছে রিং বসানো

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ধর্মঘটের আগে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে দৈনিক ৩৫-৪০ জনের হার্টে রিং বসানো হলেও এখন তা নেমেছে ২০-২৫ জনে। ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে দৈনিক ৪০ জনের হার্টে রিং বসানো হলেও এখন তা ঠেকেছে অর্ধেকে। একই অবস্থা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়েও (বিএসএমএমইউ)। ১৫-২০টি রিং পরানোর স্থলে এখন ৮-১০টি বা তারও নিচে নেমে এসেছে। এ অবস্থায় দ্রুত এ অবস্থার অবসান চান রোগীসহ সংশ্লিষ্টরা।

দাম নির্ধারণ ও ধর্মঘট

দাম নিয়ে নানা অভিযোগ ও ডলারের দাম ওঠা-নামা বিবেচনায় নিয়ে সম্প্রতি জাতীয় মূল্য নির্ধারণ কমিটির সাথে বৈঠক করে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর। সে বৈঠকে কমিটির মোট ৬ জন সদস্য উপস্থিত ছিলেন। এরপর ১২ ডিসেম্বর ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ ইউসুফ স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে ২৭টি কোম্পানির ৪৪ ধরনের হার্টের রিংয়ের দাম বেঁধে দেওয়া হয়। এতে সব ধরনের হার্টের রিংয়ের দাম দুই হাজার থেকে ৫৬ হাজার টাকা পর্যন্ত কমানো হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের রিংয়ের দাম ধরা আছে ২০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ১ লাখ ৪০ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত। আর অন্যান্য রিংয়ের মূল্য সর্বনিম্ন ১৪ হাজার টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ আয়ারল্যান্ডের রিং আছে ১ লাখ ৪০ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত। যা ১৬ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হয়। একটা কমিটির মাধ্যমে অনেক দিন ধরে সবার সঙ্গে কথা বলে নতুন মূল্য তালিকা দেওয়া হয়েছে বলেও জানায় ঔষধ প্রশাসন।

তবে নতুন নির্ধারিত দামে আপত্তির কথা জানিয়েছে ইউরোপ থেকে রিং আমদানিকারী ২৪টি কোম্পানি। এতে আমেরিকান কোম্পানিগুলোকে সুযোগ দেওয়ার অভিযোগ তাদের। কোম্পানিগুলোর দাবি, এই দাম নির্ধারণে শুধু আমেরিকার তিনটি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের ২০১৭ সালের মার্কআপ ফর্মুলা অনুসরণ করা হয়েছে। বাকি ২৪ প্রতিষ্ঠানের স্টেন্টের মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে মার্কআপ ফর্মুলা মানা হয়নি। নতুন দামে রিং বিক্রিতে তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তাই মূল্য নতুন করে সমন্বয় না করা পর্যন্ত স্টেন্ট সরবরাহ ও বিক্রি বন্ধ রেখেছেন তারা।

 

আরও পড়ুন

বেশি দামে হার্টের রিং বিক্রি ‘মানবাধিকার লঙ্ঘন’
হার্টের রিংয়ের বৈষম্যমূলক দাম কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না: হাইকোর্ট
হার্টের স্টেন্টের দাম কমানোর ঘোষণা, কতটা সাশ্রয় হবে রোগীদের?

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করা শর্তে একটি প্রতিষ্ঠানে প্রধান ঢাকা মেইলকে বলেন, সব ধরনের মেডিকেল যন্ত্রপাতি ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরে নিয়ন্ত্রণের নিবন্ধনের মাধ্যমে আমদানি এবং নির্ধারিত দামে বিক্রি করতে হয়। এটি জাতীয় মূল্য নির্ধারণ কমিটি মার্কআপ ফর্মূলার মাধ্যমে নির্ধারণ করে। আমরা ২০১৭ সালের আইনের অধীনে আমদানি করা যন্ত্রপাতি নিবন্ধন করে থাকি। ওই মার্কআপ ফর্মূলার মাধ্যমে ডলার রেট ৮৪-৮৬ টাকা ধরে দাম নির্ধারণ করা হয়। গত বছর থেকে ডলারের দাম বাড়তে থাকে। তখন আমাদের দাবি ছিল নতুন ডলার রেট অনুযায়ী দাম সমন্বয় করে দেওয়ার জন্য। এতে যে পণ্যের দাম ৭২ হাজার টাকা ছিল তা বেড়ে ৮৬ হাজার টাকা হয়ে যায়। এরপর দাম বেড়ে যাওয়ায় জনগণের ভোগান্তির বিষয়টি গণমাধ্যমে উঠে আসে। পরে পরামর্শক কমিটি দাম কমিয়ে আনার চেষ্ঠা করে। এর অংশ হিসেবে আমেরিকান তিনটা কোম্পানিসহ সবার সাথে কথা বলা হয়। তারা দাম কমানো কথা বলেন। পরে আলাদাভাবে আমেরিকান তিনটা কোম্পানির সাথে বসে রিংয়ের দাম কমানো হয়।

বর্তমান সমস্যা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কথা ছিল অন্যদের সাথে বসে নতুন দাম নির্ধারণ করা হবে। তবে আলাদা আলাদভাবে বসায় কাদের সাথে বসা হয়েছে তা বলা কঠিন। ইউরোপীয় আমদানিকারকদের দাবি তাদের সঙ্গে আলোচনা না করেই দামটা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। যা আমেরিকান কোম্পানিগুলোর দামের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এতে করে তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

সমাধান কি?

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ ইউসুফ জানান, দাম নির্ধারণ কমিটির মাধ্যমে আলোচনার ভিত্তিতে রিংয়ের দাম পুনর্নির্ধারণ করেছি। আলোচনায় আমদানিকারকদের অনেকেই ছিলেন। তাদের সম্মতি নিয়ে দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল। সেখানে টেকনিক্যাল কমিটির অধিকাংশ সদস্য উপস্থিত ছিলেন।

তবে তার এ দাবির সাথে ভিন্নমত রয়েছে ধর্মঘটকারীদের। এ দামকে বৈষম্যমূলক দাবি করেছে তারা। এমনকি বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ১৮ ডিসেম্বর আধুনিক স্টেন্টের (হার্টের রিং) ‘বৈষম্যমূলক’ দাম কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি রাজিক-আল-জলিলের হাইকোর্ট বেঞ্চ দুই সপ্তাহের মধ্যে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব, ঔষুধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্টদের রুলের জবাব দিতে বলেছেন।

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মোহাম্মদ হুমায়ন কবির বলেন, ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর যে দাম নির্ধারণ করেছে, তা বৈষম্যমূলক। এর ফলে চারটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্যদের জন্য যে দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। তারা ওই দামে হার্টের রিং আমদানিই করতে পারবে না। ফলে বাজারে কেবল টিকে থাকবে চারটি প্রতিষ্ঠান। এতে বাজারে সিন্ডিকেট তৈরি হবে। সাধারণ মানুষ ভোগান্তিতে পড়বে। আশা করছি, বিবাদীরা যথাসময়ে রুলের জবাব দেবেন।

 

আরও পড়ুন

শিশুদের হার্টে ছিদ্র কেন হয়, চিকিৎসা কী?
হার্ট ব্লক হওয়ার লক্ষণ ও চিকিৎসা 
হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে হৃদয়হীন কারবার!

এরই মধ্যে গত মঙ্গলবার (২৬ ডিসেম্বর) হার্টের রিংয়ের দাম পুনর্নির্ধারণের দাবি নিয়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে আসেন ইউরোপিয়ান ২৪টি কোম্পানির প্রতিনিধি দল। এ সময় তাদের সাথে ‘রুদ্ধদ্বার’ বৈঠক হয়। এ বিষয়ে মেডিকেল ডিভাইস ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি ওয়াসিম আহমদ বলেন, ঔষধ প্রশাসনের মহাপরিচালকের সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎ হয়েছে। তিনি আমাদের জানিয়েছেন, সমস্যা সমাধানে ব্যক্তিগতভাবে তার আন্তরিকতার অভাব নেই। তবে টেকনিক্যাল কমিটির বাইরে গিয়ে তিনি কিছুই করতে পারছেন না। এ সময় ঔষুধ প্রশাসন অধিদফতর এ বিষয়ে ভূমিকা নিতে চাইলেও শক্ত একটা সিন্ডিকেট সেটা হতে দিচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন তিনি।

পরদিন ২৭ ডিসেম্বর ঔষুধ প্রশাসনের পারিচালক মো. সালাহউদ্দিন স্বাক্ষরিত এক নোটিসে অধিদফতরের মাহপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ ইউসুফের সভাপতিত্বে দাম পুনর্নির্ধারণে আগামী ৩১ ডিসেম্বর একটি সভা আহ্বান করা হয়েছে। এতে দাম নির্ধারণে বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্যদের উপস্থিত থাকার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।

সমস্যা সমাধানের আশা করে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আমদানিকারক একটি প্রতিষ্ঠানের চেয়াম্যান বলেন, পরামর্শক কমিটিতে থাকা চিকিৎসকরা প্রত্যেকে ব্যস্ত মানুষ। তার হয়তো তাদের চেম্বার ও রোগী রেখে বৈঠক ততটা ইচ্ছুক না। তবে আমরা আশা করি নতুন বৈঠকে সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে একটা ডেভেলপমেন্ট হবে। এ জন্য স্টেকহোল্ডার সবার সাথে কথা বলতে হবে। যাতে রোগী, কোম্পানিসহ সবার স্বার্থ সংরক্ষিত হয়। আমাদের সুস্পষ্ট দাবি, ব্যবসায়ীদের কাছে একটি মার্কআপ ফর্মূলা থাকবে। এর মধ্যে সব ট্যাক্স উল্লেখ করা থাকবে। বর্তমান মার্কআপে অনেক ট্যাক্স উল্লেখ করা হয়নি। এ অবস্থায় মার্কআপ ফর্মূলাটি রিভাইস কারা উচিত।

তিনি আরও বলেন, হৃদরোগ চিকিৎসায় বাংলাদেশ আজ গর্ব করে। এর জন্য এখন আর দেশের বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। এর পেছনে হাসপাতাল, চিকিৎসক, নার্স, টেকনেশিয়ান এবং আমদানিকারকদের ভূমিকা রয়েছে। আমরা চাই এই সমস্যার একটি ভালো সমাধান হোক যেন এ নিয়ে কোনো বিভ্রান্তি তৈরি না হয়।

এমএইচ/