সেলিম আহমেদ
৩১ অক্টোবর ২০২২, ০৭:৫৭ এএম
মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার সীমান্তবর্তী এক গ্রাম ফটিগুলী। ওই গ্রামের এক অভিভাবক রেনু মিয়া। তার দুই ছেলে। বড় ছেলে পড়ে ৭ম শ্রেণিতে আর ছোট ছেলে চতুর্থ শ্রেণিতে। সপ্তাহে ক্লাস দুইদিন বন্ধ থাকায় কী প্রভাব পড়ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, করোনার কারণে দেড়বছর স্কুল বন্ধ থাকায় আমার ছেলেরা ইন্টারনেট ও গেম আর খেলাধুলায় আসক্ত হয়ে পড়েছিল। ওইসময় লেখাপড়া না করায় তারা এখন আর পড়ালেখায় খুব একটা মনোযোগী হতে পারছে না।
তিনি আরও বলেন, স্কুল বন্ধের প্রভাবও পড়ছে। দুইদিন বন্ধ থাকায় তারা ওই দুইদিন আর পড়ালেখায় বসতে চায় না। শাসন করেও তাদের পড়ায় মনযোগী করতে পারছি না। তাছাড়া গ্রামের স্কুলে পড়ালেখাও খুব ভালো হয় না। তাদের ভবিষৎ নিয়ে শঙ্কিত আমি। বুঝতেছি না কী হবে।
আরও পড়ুন: এক শিফট হচ্ছে সব প্রাথমিক বিদ্যালয়
এই জেলার বড়লেখা উপজেলার আরেক অভিভাবক তপন সরকার। তিনি পেশায় একজন শিক্ষক। তপন বলেন, করোনা শিশুদের মনোজগতে অনেক পরিবর্তন এনেছে। আমার বাচ্চারাসহ প্রায় সব বাচ্চারাই পড়ালেখায় অমনোযোগী হয়ে উঠেছে। আমি আমার ছেলেকে কয়েকদিন পড়াতে বসে দেখেছি তার ব্যাপক শিখন ঘাটছি রয়েছে। বাড়িতে যত পড়াই না কেন স্কুলের পড়ানো কিন্তু বড় বিষয়। স্কুলে ক্লাসে পাঠদান থেকে শিশুরা যত সহজে শিখতে পারে বাসায় পড়ালে কিন্তু তা হয় না। কিন্তু সরকার কেন সপ্তাহে দুইদিন স্কুল বন্ধ করে দিল তা বুঝে আসে না। স্কুল বন্ধ করলে কতটুকু আর বিদ্যুৎ সাশ্রয় হয়? এছাড়াও এমনিতে বছরে কয়দিন আর ক্লাস হয়। সবমিলিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে আমি খুব হতাশ।
করোনার প্রাদুর্ভাবে টানা দেড় বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ছাত্রছাত্রীদের শিখন দক্ষতায় অনেক ঘাটতি তৈরি হয়েছে। কিন্তু স্কুল খোলার পর এ ঘাটতি পুষিয়ে নিতে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর। শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে শিক্ষাবছর বৃদ্ধি, শিক্ষা পুনরুদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনাসহ কোনো পদক্ষেপ নিতেও উদ্যোগী ভূমিকা দেখা যায়নি।
করোনার পর কীভাবে শিক্ষার পুনরুদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে এ ব্যাপারে শিক্ষকদের জন্য কোনো গাইডলাইন বা নির্দেশিকা রয়েছে কি না তা-ও জানেন না শিক্ষা কর্মকর্তারা। ‘কোভিড-১৯-পরবর্তী শিক্ষা পুনরুদ্ধার ও আগামীর ভাবনা’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এমন তথ্যই উঠে এসেছে।
আরও পড়ুন: শিক্ষকদের যৌক্তিক দাবি বাস্তবায়নে সচেষ্ট সরকার
ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সহযোগিতায় গণসাক্ষরতা অভিযান গত বছরের নভেম্বর থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গবেষণা চালিয়ে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক, শিক্ষা কর্মকর্তা, কারিগরি প্রতিষ্ঠান প্রশিক্ষকসহ সংশ্লিষ্টদের সাক্ষাৎকার নিয়ে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। উপজেলা ও জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদেরও মতামত নেওয়া হয় প্রতিবেদন তৈরিতে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৮৪ শতাংশ অভিভাবক সন্তানের শিখন ঘাটতির জন্য প্রাইভেট টিউটর নিয়োগ দিয়েছেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৮০ শতাংশ অভিভাবক এ টিউটর রেখেছেন। অনেক শিক্ষার্থী কোচিং সেন্টারের শরণাপন্ন হয়েছেন।
এতে আরও বলা হয়, ৪৭ শতাংশ উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার শিখন ক্ষতি পুষিয়ে নিতে অতিরিক্ত ক্লাসের ব্যবস্থা করার সুপারিশ করেছেন। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৮৮ শতাংশ ও প্রাথমিকের ৮৫ শতাংশ শিক্ষক ছাত্রছাত্রীদের ক্ষতির মূল্যায়ন এবং এ সংকট কাটিয়ে উঠতে তাদের জন্য নির্দিষ্ট কোনো নির্দেশিকা বা গাইডলাইন নেই বলে জানিয়েছেন। শিক্ষকদের জন্য নির্দিষ্ট কোনো নির্দেশিকা রয়েছে কি না- এ ব্যাপারে কিছুই জানাতে পারেননি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের ৯০ শতাংশ কর্মকর্তা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিখন ক্ষতির মূল্যায়ন ও পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কর্তৃপক্ষকে কোনো নির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিতে দেখা যায়নি।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, প্রাথমিক পর্যায়ের ৫৩ ও মাধ্যমিক পর্যায়ের ৪৪ শতাংশ শিক্ষক শিক্ষার ক্ষতি পুনরুদ্ধারের কার্যক্রম দুই থেকে তিন বছর বাড়ানোর পক্ষে মত দিয়েছেন। কেউ কেউ এ কার্যক্রম তিন থেকে চার বছর চালিয়ে নিতে বলেছেন। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা স্তরের ছাত্রছাত্রীর এক-তৃতীয়াংশের বেশি অভিভাবক শিক্ষা পুনরুদ্ধার কার্যক্রম দুই থেকে তিন বছর মেয়াদি করার পরামর্শ দিয়েছেন। দুই-তৃতীয়াংশ উপজেলা ও জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাও শিখন পুনরুদ্ধার কার্যক্রমের মেয়াদ তিন থেকে চার বছর করার পক্ষে মত দিয়েছেন।
আরও পড়ুন: পড়াশোনা শুধু ডিগ্রি আর সার্টিফিকেটের জন্য নয়: শিক্ষামন্ত্রী
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত বলেন, ‘শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে শিক্ষাবছর বাড়ানোর ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। তবে নিয়মিত ক্লাসের মাধ্যমে কীভাবে ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা যায় সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।’
এএসএ/এএস