images

শিক্ষা

শুধু শিক্ষক আন্দোলনেই কেটেছে বছরের দুই মাস!

মো. আব্দুস সবুর (লোটাস)

২৮ নভেম্বর ২০২৫, ১০:১১ পিএম

চলতি বছরের শুরু থেকেই নানা দাবি-দাওয়া নিয়ে রাস্তায় বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষকরা। জাতীয় প্রেসক্লাব, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ও শাহবাগে প্রায় দুই মাস ধরে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন তারা। এছাড়া দাবি আদায়ে সচিবালয় ও প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন ঘেরাওয়ের মতো কর্মসূচিতে পুলিশের হামলার শিকারও হয়েছেন শিক্ষকরা। সব পর্যায়ের আন্দোলনের মূল দাবির মধ্যে রয়েছে সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো। দীর্ঘ আন্দোলনের পর শিক্ষকরা অনেকাংশেই সফল হয়েছেন। তবে বছরজুড়ে শিক্ষাঙ্গনে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে।

শিক্ষকদের এত আন্দোলন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে নানা মহলে। কেউ কেউ বলছেন, সরকারকে বিব্রত করতে এসব আন্দোলনের পেছনে ভিন্ন উদ্দেশ্য রয়েছে। তবে এসব আন্দোলনের কিছু যৌক্তিকতাও রয়েছে বলে জানিয়েছেন শিক্ষা সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ও সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তারা। একই সঙ্গে শিক্ষকদের এত দাবি মেনে নেওয়া সম্ভব নয় বলেও স্পষ্ট জানিয়েছেন অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা।

চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে সপ্তাহব্যাপী আন্দোলন করেন প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষকরা। তারপর মে মাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিভিন্নভাবে কর্মবিরতি পালন করে প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকরা। ফেব্রুয়ারি মাস থেকে বিভিন্ন মেয়াদে আন্দোলন করে আসছেন এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা। জুলাই মাসে ১০ দিনের বেশি সময় ধরে আন্দোলন করেন তারা। আবার গত ২৫ নভেম্বর থেকে আবার কর্মবিরতি শুরু করেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা। এভাবে বছরের ১১ মাসের মধ্যে প্রায় দুই মাসব্যাপী আন্দোলন করেছেন শিক্ষকরা। এর নেতিবাচক প্রভাব সরাসরি শিক্ষাঙ্গনে পড়ছে বলে জানান শিক্ষা সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।

Primary-
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আন্দোলনের একটি চিত্র। 

সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের আন্দোলন

বছরের শুরু থেকে উচ্চতর গ্রেডে বেতনের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২৪ এপ্রিল প্রধান শিক্ষকদের বেতন ১১তম থেকে ১০তম গ্রেডে এবং ১৩তম গ্রেডের শিক্ষকদের ১২তম গ্রেডে উন্নীত করার উদ্যোগ নেয় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। 

তবে এতে সহকারী শিক্ষকরা অসন্তুষ্ট হন। তারা গত ৩০ আগস্ট তিন দাবিতে শহীদ মিনারে মহাসমাবেশ করেন। ২৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে দাবি না মেনে নেওয়ায় পরদিন থেকে আমরণ অনশন কর্মসূচি শুরু করেন তারা। পরবর্তী সময়ে ১২ নভেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের সচিবের সঙ্গে বৈঠকে তিন দফা দাবি পূরণে যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, তা বাস্তবায়ন না করা পর্যন্ত তারা কর্মবিরতি চালিয়ে যাবেন বলে ঘোষণা দেন। সেটির জেরে গত ২৫ নভেম্বর থেকে পূর্ণ দিবস কর্মবিরতি পালন করছেন প্রাথমিকের শিক্ষকরা। এতে আগামী ২ ডিসেম্বর থেকে বার্ষিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়া নিয়ে শঙ্কা দেখা গেছে।

তিন দফা দাবি হলো- প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে এন্ট্রি পদ সহকারী শিক্ষকদের ১১তম গ্রেডে বেতন-ভাতা দেওয়া, শতভাগ শিক্ষককে পদোন্নতি এবং ১০ ও ১৬ বছরপূর্তিতে উচ্চতর গ্রেড প্রাপ্তির জটিলতা নিরসন।

2
বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আন্দোলনের একটি চিত্র।

বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কর্মসূচি

এদিকে ২০১৩ সালে সারাদেশের ২৬ হাজার ১৯৩টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করা হয়। সমান যোগ্যতা থাকার পরও শুধু রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে দেশের চলমান যোগ্য চার হাজারের অধিক বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ থেকে বাদ পড়ে। এসব বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত বিভিন্ন সময় ৩০ দিনের বেশি আন্দোলন করেন। বিভিন্ন দফায় আন্দোলন ও আশ্বাসের পর আবার গত ২ নভেম্বর থেকে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন।

আন্দোলনরত শিক্ষকদের দাবি, রাজনৈতিক কারণে আগের ফ্যাসিস্ট সরকার তাদের বেতন-ভাতা থেকে বঞ্চিত করেছে। কিন্তু তারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মতো সব সেবা দিয়ে কেন অবহেলায় থাকবে। সরকার দ্রুত প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এসব বিদ্যালয় জাতীয়করণ করবে। এই দাবি পূরণ হওয়ার আগে আন্দোলন চলমান থাকবে।

3
ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষকদের আন্দোলনের একটি চিত্র।

ইবতেদায়ি মাদরাসার আন্দোলন

দেশে ২৬ হাজারের বেশি নন-এমপিওভুক্ত মাদরাসা রয়েছে। সব স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা জাতীয়করণের দাবিতে অবস্থান ধর্মঘট করছেন শিক্ষকরা। চলতি বছরের ২৮ জানুয়ারি সরকারের পর্যায়ক্রমে জাতীয়করণ ঘোষণা দ্রুত বাস্তবায়নের দাবিতে এ অবস্থান ধর্মঘট করেন তারা। সর্বশেষ গত ৪ নভেম্বর শর্তসাপেক্ষে অনুদানভুক্ত ১ হাজার ৮৯টি স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা এমপিওভুক্তির নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তবে এই সিদ্ধান্তে অসন্তোষ প্রকাশ করে আন্দোলন চলমান রেখেছেন অনুদানবিহীন মাদরাসার শিক্ষকরা।

সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের হুঁশিয়ারি

নিয়োগে এন্ট্রি পদ নবম গ্রেডভিত্তিক পদ সোপানের দাবিতে গত ২৪ সেপ্টেম্বর থেকে আল্টিমেটাম দিয়ে আসছিলেন দেশের সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। ১ ডিসেম্বরের মধ্যে দাবি পূরণ না হলে কমপ্লিট শাটডাউনে যাওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তারা। গত বৃহস্পতিবার (২৭ নভেম্বর) সকালে শিক্ষাভবনের সামনে বাংলাদেশ সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির ব্যানারে অবস্থান নিয়ে এ ঘোষণা দেন তারা।

4
জাতীয়করণের দাবি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আন্দোলনের একটি চিত্র।

জাতীয়করণের দাবি

এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জাতীয়করণের আন্দোলন বাংলাদেশের শিক্ষা আন্দোলনের অন্যতম আলোচিত বিষয়। ১৯৭২ সালের পর ২০১৩ সালে সব প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করা হয়। কিন্তু মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, কলেজ ও মাদরাসার এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা বাইরে রয়ে যান। একই ধরনের শিক্ষায় অবদান রাখার পরও তারা সরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের তুলনায় কম সুযোগ-সুবিধা পান। ৪৫-৫০ হাজারের বেশি এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেখানে কয়েক লাখ শিক্ষক কর্মরত। তারা আংশিক সরকারি ভাতা পেলেও চাকরির স্থায়িত্ব, পেনশন, উৎসব ভাতা, চিকিৎসা ভাতা, সরকারি স্কেল অনুযায়ী সমান বেতন ইত্যাদি থেকে বঞ্চিত।

দীর্ঘদিন আন্দোলনের পর আশ্বাসেও দাবি পূরণ না হওয়ায় গত ১৩ অক্টোবর থেকে শহীদ মিনারে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা। পরে গত ২১ অক্টোবর বাড়িভাড়া ভাতা মূল বেতনের ১৫ শতাংশ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত জানায় সরকার। অর্থ দুই ধাপে পাবেন শিক্ষক-কর্মচারীরা। ১৫ শতাংশের মধ্য ৭ দশমিক ৫ শতাংশ (ন্যূনতম ২ হাজার টাকা) কার্যকর হবে এ বছরের ১ নভেম্বর থেকে। আরও ৭ শতাংশ ৫ কার্যকর হবে আগামী বছরের ১ জুলাই থেকে। এরপর শিক্ষকরা নিজ নিজ স্কুলের ক্লাসে ফিরে যান।

5
এমপিওভুক্তির দাবিতে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান নেন প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।

প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবস্থান

দেশের প্রায় দুই হাজারের মতো প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয় রয়েছে। তবে এসব বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সরকারি কোনো বেতন-ভাতা পান না। দীর্ঘদিন শিক্ষকতার পরও তারা নিজেদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলে আন্দোলন শুরু করেছেন। বছরের বিভিন্ন সময় আন্দোলন করলেও আবার গত ২৬ অক্টোবর থেকে এমপিওভুক্তির দাবিতে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে আন্দোলন শুরু করেছেন।

শিক্ষকদের দাবি, তারা দেশের সবচেয়ে কঠিন কাজ করছে। দেশের অনেক প্রতিবন্ধী শিশু রয়েছে। তাদের শিক্ষার জন্য সাধারণ স্কুলে সেভাবে কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে বিশেষায়িতক স্কুলে তাদের শিক্ষা দেওয়া হয়। যা সাধারণ স্কুলের চেয়ে তাদের কাজ কঠিন। কিন্তু এই কাজ করার পরও সরকার কোনো সুযোগ-সুবিধা দেয় না। দ্রুত এসব স্কুল এমপিওভুক্ত করার দাবি জানিয়েছেন তারা।

এছাড়া সম্মিলিত নন-এমপিও ঐক্য পরিষদের ব্যানারে গত ২ নভেম্বর থেকে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা আন্দোলন করে আসছেন। তাদের দাবি একই দেশে দুই ধরনের নীতি চলতে পারে না। তাই স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্তির আওতায় নিয়ে আসতে হবে।

এএসএল/জেবি