ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ পাঠ্যবইয়ে রাখার সিদ্ধান্তে ইতিবাচক ভূমিকা থাকায় জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) এক শীর্ষ কর্মকর্তাকে বদলির সিদ্ধান্ত নিয়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। পরে সেই বদলির বিষয়টি সুরাহা করেন এনসিটিবির আরেক শীর্ষ কর্মকর্তা।
শুধু এই একটি ঘটনাই নয়—এনসিটিবি একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হলেও এর প্রায় প্রতিটি কাজে মন্ত্রণালয়ের চরম হস্তক্ষেপ রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এনসিটিবির স্বাভাবিক কার্যক্রমে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের এমন হস্তক্ষেপে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেক কর্মকর্তা। এ বিষয়ে এনসিটিবির একাধিক সূত্র তথ্য দিয়েছে।
বিজ্ঞাপন
এনসিটিবির কর্মকর্তাদের অভিযোগ, এনসিটিবি শুধু নামেই একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে এটি মন্ত্রণালয়ের ছায়া সংগঠন। কোন বইয়ে কী ধরনের কনটেন্ট থাকবে, সেটির সিদ্ধান্ত এনসিটিবি নেওয়ার কথা। এছাড়া এখানে চাকরি পাওয়া থেকে শুরু করে পদায়ন—সব ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের সর্বোচ্চ হস্তক্ষেপ থাকে। এর আগেও বইয়ের টেন্ডার নিয়ে তদবির করার অভিযোগ রয়েছে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের ১৮ আগস্ট ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ বইয়ে রাখা হবে কি না—এ বিষয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। বিষয়টি নিয়ে শিক্ষা প্রশাসনের আরেকটি পক্ষ তুমুল বিরোধিতা করলেও শেষ পর্যন্ত অষ্টম ও দ্বাদশ শ্রেণির বইয়ে ৭ মার্চের ভাষণ সংক্ষিপ্ত আকারে রাখার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। তবে সভায় ভাষণটি রাখার পক্ষে ইতিবাচক ভূমিকা থাকায় এনসিটিবির এক শীর্ষ কর্মকর্তাকে বদলির সিদ্ধান্ত নেয় মন্ত্রণালয়, যেটি এনসিটিবির শীর্ষ কর্মকর্তাদের একজন ঠেকিয়ে দেন।
আরও জানা যায়, গত ১৯ আগস্ট ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির বইয়ের টেন্ডার মন্ত্রণালয়ের সভায় ক্রয়াদেশ অনুমোদন না দিয়ে বাতিল করা হয়। কোনো কারণ না জানিয়ে গত ২ সেপ্টেম্বর পুনরায় টেন্ডার আহ্বানের নির্দেশ দেয় মন্ত্রণালয়। ওই তিন শ্রেণির বইয়ের টেন্ডার এখনো অনুমোদিত হয়নি। ফলে মাধ্যমিকের বই বছরের শুরুতে পাওয়া যাবে না বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এনসিটিবির কর্মকর্তাদের অভিযোগ, কোনো কারণ না দেখিয়ে টেন্ডার বাতিলের যৌক্তিকতা নেই। টেন্ডারের বড় কোনো শর্তও পরিবর্তন করতে বলা হয়নি। শুধু ওই টেন্ডারকে পুনরায় আহ্বান (রি-টেন্ডার) করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এর ফলে ওই তিন শ্রেণির বই পেতে অন্তত মার্চ মাস পর্যন্ত সময় লাগতে পারে, যা দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ও এনসিটিবির জন্য নেতিবাচক।
প্রাথমিকের বই ছাপার কাজ যাচ্ছে অধিদফতরে
সম্প্রতি এনসিটিবি আইন কাটছাঁট করে অধ্যাদেশের মাধ্যমে প্রাথমিকের বই ছাপার কাজ অধিদফতরকে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধনের জন্য সর্বসাধারণের মতামত চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। আইন সংশোধন হলে ২০২৭ শিক্ষাবর্ষ থেকে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের বই ছাপানোর দায়িত্ব পাবে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই)। এ নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির ভেতর-বাইরে ব্যাপক বিতর্ক ও সমালোচনা সৃষ্টি হয়েছে।
এনসিটিবির কর্মকর্তাদের অভিযোগ, বই ছাপানোর কাজে তাদের একাধিকবার দেরি হয়েছে, তবে সেটি শুধু এনসিটিবির কারণে নয়; বরং মন্ত্রণালয়ও এ ক্ষেত্রে সমানভাবে দায়ী।
বই ছাপানোর কাজে এনসিটিবিকে শক্তিশালী না করে ভেঙে ফেলা হলে তার নেতিবাচক প্রভাব শিক্ষার সব স্তরে পড়বে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
এনসিটিবির ইতিহাস
দেশভাগের পর ১৯৪৭ সালে গঠিত হয় ‘পূর্ববঙ্গ স্কুল টেক্সটবুক কমিটি’। পরে ১৯৫৪ সালে আইন পাস করে ‘স্কুল টেক্সটবুক বোর্ড’ গঠন করা হয়। ১৯৮৩ সালে স্কুল টেক্সটবুক বোর্ড ও জাতীয় শিক্ষাক্রম উন্নয়ন কেন্দ্রকে একীভূত করে বর্তমান এনসিটিবি গঠন করা হয়। ২০১৮ সালে নতুন আইন পাস হয়।
২০১০ সাল থেকে বছরের শুরুতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের হাতে বিনা মূল্যে বই বিতরণ করছে সরকার।
আইন অনুসারে এনসিটিবির কাজ হলো শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যবই প্রণয়ন, উন্নয়ন ও অনুমোদন করা। কিন্তু বাস্তবে প্রতিটি কাজেই মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ থাকে।
এছাড়া বই ছাপার কাজ দিতে প্রেস মালিকদের সঙ্গে বড় অঙ্কের লেনদেনের মাধ্যমে এনসিটিবির ওপর হস্তক্ষেপের অভিযোগ রয়েছে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে।
এনসিটিবির এক শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আসলে দীর্ঘদিনের চর্চায় এনসিটিবি এমন হয়েছে। বিভিন্ন সময় অযোগ্য ব্যক্তিরা চেয়ার দখল করে নিজেরাই মন্ত্রণালয়ের দ্বারস্থ হয়েছেন, যার ফলে এখন মন্ত্রণালয় সব বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারে।
আরেক কর্মকর্তা বলেন, এনসিটিবি শিক্ষার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এখানে সেরকম মেরুদণ্ড-দৃঢ় মানুষ আসেননি, যারা নিজের ক্ষমতার সঠিক ও সুষ্ঠু প্রয়োগ করবেন। ফলে নিজের ব্যর্থতা ও অযোগ্যতার ফলেই বর্তমান এনসিটিবির এই পরিস্থিতি।
সার্বিক বিষয়ে এনসিটিবির চেয়ারম্যান (রুটিন দায়িত্ব) অধ্যাপক রবিউল কবির চৌধুরীর সঙ্গে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি।
এএসএল/এআর

